Sarkar Ki Bolche, Jonogon Ki Bujche

Sarkar Ki Bolche, Jonogon Ki Bujche

সরকার কি বলছে, জনগন কি বুঝছে

অধ্যাপক বিজন বিহারী শর্মা

১৯৭১এ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশে অনেক সরকার এসেছে, গেছে । এই প্রক্রিয়ায় এখন চলছে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরববাহী দল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শাসন। স্বাভাবিক কারনেই এই দলটির উপর মানুষের আস্থা অনেক বেশী । তবে, সঙ্গত কারনেই মানুষের আস্থা এখন অনেক কমে গেছে । ঢাকা শহরের একটি শিশুকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এই সরকারের আমলে ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থার সমাধান হবে, একথা কি তুমি বিশ্বাস কর ?, তাহলে শিশুটি দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দেবে, প্রশ্নই ওঠে নাসরকারের বড় বড় পরিকল্পনা, যেমন এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে সম্বন্ধে মানুষের ধারনা, পরবর্তী নির্বাচন কালে শহরে দু একটি খুটি দেখা যাবে এবং বড় বড় চুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত বড় কমিশন নির্বাচনে ব্যয় হবে ।

অধিক টেলিভিশিন দেখার কারনে সারা পৃথিবীতেই মানুষের বুদ্ধিমত্তা কমে গেছে । তবে বৃটিশদের ষড়যন্ত্র, পাকিস্তানীদের চক্রান্ত, বাংলাদেশের কিছু রাজনীতিকের মিথ্যাচারিতা দেখে অভ্যস্থ অভিজ্ঞ বাঙ্গালী কিন্তু সরকার বা রাজনীতিকদের কথার আসল অর্থ বুঝতে না পারার মত বোকা হয়ে যায় নি । সাধারন জনগনের মনোভাবের প্রকাশ আর সরকারের বক্তব্য প্রচারের মধ্যে বিরাট পার্থক্য এই যে, সরকার রাষ্ট্রীয় সকল মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু জনগন তাদের মনোভাব সেভাবে প্রকাশ করতে পারে না । গনতান্ত্রিক দেশে তারা তাদের মনোভাব নিয়ে অপেক্ষা করে এবং নির্বাচনের সময় ব্যালটের পুর্ন স্বাধীনতার সদব্যবহার করে তা জানিয়ে দেয় ফলে তাদের অপছন্দের দল পরাজয়ের স্বাদ পেয়ে যায়উল্লেখ করা যায় যে, দেশের জন্য অনেক ভাল ভাল কাজ করেও জনগনের বর্তমান প্রয়োজনকে অবজ্ঞা করায় জনগন ইতিপূর্বেও আওয়ামী লীগকে পরাজয়ের স্বাদ পাইয়ে দিয়েছে ।

পদ্মা সেতু হলে ভবিষ্যতে দেশের অনেক উপকার হবে, এটি মানুষের মনে থাকলেও নির্বাচনী বুথে গিয়ে মানুষ যখন বুঝতে পারে, এখন তার হাতে এসে গেছে একটি দেশের শাসনকারী দল নির্বাচনের ক্ষমতা, তখন তার মনে পড়ে যায়, লোড শেডিংএর কষ্ট, ঘন্টার পর ঘন্টা যান জটের কারনে আটকে থাকার যন্ত্রনা, জনপ্রতিনিধির নির্লজ্য এবং জঘন্য জমি দখলের কাহিনী, টেন্ডার-বিশারদ জনপ্রতিনিধির কীর্তি এবং, সর্বোপরী এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী ব্যাক্তির নীরবতা, তখন সব ভালবাসা ছাপিয়ে জেগে ওঠে এক ধরনের প্রতিহিংষা । আর তাতেই অনেক ভাল ভাল কাজ করা রাজনৈতিক দলও অবিশ্বাস্য পরাজয়ের স্বাদ পায় । আর নির্বাচন কমিশন যখন নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করে তখনই জনগন এই সুযোগটি বেশি কাজে লাগাতে সক্ষম হয়

বাংলাদেশের জনগনের বুদ্ধির কথা বলছিলাম । দেশে রাজনৈতিক কাজ পরিচালনার জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন । জনগন কাউকে এই উদ্দেশ্যে টাকা দিতে দেখে নাতবুও সব কাজই চলে এবং অধিকাংশ রাজনীতিকদের অর্থনৈতিক উন্নতি হয় । এর কারন কি জনগন বোঝে না ? যারা রাজনীতিকদেরকে অর্থ দিয়ে থাকে তারা তো এই জনগনেরই আত্মীয় । ভেতরের ব্যপরারটি কি দেশে এখন কারও অজানা ?

জনগন ভালই জানে যে, আইন ভঙ্গ বা জনগনের কষ্ট দিয়ে যারা আর্থিক সুবিধা লাভ করে থাকে তারা তাদের বাড়তি লাভ রাজনীতিক এবং সংশ্লিষ্ট আমলাদের সঙ্গে ভাগ করে নেয় । আর ঠিক এই কারনেই সমস্যার কোন সমাধান হয় না । যেমন, ঈদ সামনে রেখে সম্প্রতি সরকার ঘোষনা করে, ফুটপাথ থেকে হকার সরানো হবে । জনগন তখনই বুঝে গেছে, ঈদের বিরাট ব্যবসা বজায় রাখতে হকাররা এখনই সরকার, আমলা বা রাজনীতিকদের সঙ্গে সমঝোতা করবে । দুদিন পরেই সরকার জানালো, ঈদের আগে উচ্ছেদ হচ্ছে না । জনগন বুঝে গেল, সমঝোতা হয়ে গেছে । জনগন এখন জানে, কেন সরকার মাঝে মাঝে বিভিন্ন কড়া ব্যবস্থা গ্রহনের ঘোষনা দেয়, আর দুদিন পরেই তা বাস্থুবায়ন করা থেকে বিরত থাকে । যেহেতু তাদের শক্তিশালী সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করার নেই, আবার যেহেতু তারা বিরোধীদলের দাবীর সঙ্গেও একমত নয়, তাই তারা আন্দোলনে যায় নাবরং নির্বাচনী বুথের সেই চমৎকার সুযোগটির জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করে । এ ছাড়া তারা আর কিইবা করতে পারে ?

উপরে যা বলা হল তা কি শুধুমাত্র অনুমান করে বলা হয়েছে ? মোটেই তা নয় । এর প্রমানও দেয়া সম্ভব । খুলনার একটি আসনের কথা ধরা যাক। হিন্দু অধ্যুষিত বা আও্য়ামী লীগের ভোট ব্যাঙ্ক বলে পরিচিত এই আসনে হিন্দুরা চেয়েছিল এক জন হিন্দু প্রার্থি, আওয়ামী চাইল অন্য কিছু । বিবাদ এড়াতে দলীয় প্রধান (বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা) কেই দাড় করান হল । শর্ত, তিনি আসন ছেড়ে দিলে হিন্দুদের প্রার্থীকে দেয়া হবে। শেখ হাসিনা নির্বাচিত হলেন, আসন ছাড়লেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ অন্য প্রার্থী দিলো হিন্দুদের প্রার্থী দাড়ালো নিরপেক্ষ প্রার্থী হিসেবে । আওয়ামী লীগের শাসন আমলে প্রধান মন্ত্রীর আহবান উপেক্ষা করে তাদের ভোট ব্যাংক আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিল।

যশোরের এক নির্বাচনী এলাকায় এক নির্বাচনে বি এন পির প্রার্থী জিতেছিলো, কিন্তু এই প্রার্থির মনে হয়েছিলো অনেকে তাকে ভোট দেয় নি । তাই তাদের বাড়ী পোড়ানো হয়েছিলো । পরের নির্বাচনে ঐ এলাকার ভোটারগন দূর দুরান্ত থেকে গাঁটের পয়সা খরচ করে এসেছিল শুধুমাত্র ঐ প্রার্থীকে হারানোর জন্য এবং হারিয়েছিল ।

সর্বশেষে, চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। যে জিতেছে জনগন তাকে চেয়েছে কি না সন্দেহ । তবে তারা এক জনকে হারাতে চেয়েছিল, এবং ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের সকল আহবান উপেক্ষা করে তাই করেছে ।

আমরা গল্প শুনেছি, প্রভাবশালী কেউ ভয় দেখিয়েছে, তাকে ভোট না দিলে ভোটারদের ক্ষতি করা হবে । সেই ভয়ে তারা তাকে ভোট দিয়েছে । নির্বাচনী বুথের অসীম ক্ষমতা জানার পরে এমন কাজ করার মত বোকা এই দেশে এখন আর আছে কি না সন্দেহ। এখন বরং এ ধরনের ভয় দেখালে তার ফল হয়ে থাকে আত্মঘাতী ।

বাংলাদেশে দুর্নীতি সহ অনেক খারাপ জিনিসের কারন, রাজনীতি করার খরচের টাকা স্বচ্ছ ভাবে সংগ্রহ করার কোন পথ না থাকা। অস্বচ্ছভাবে সংগ্রহ করা হয় বলে এ থেকে অন্যায় ভাবে লাভবান হবার সুযোগ থাকে । এই কারনে সৎ লোকেরা এই পথে যেতে চায় না । বর্তমান সরকার যদি জয়ী দলগুলীর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে তাদের জন্য নির্বাচনী খরচ দেয়ার ব্যবস্থা করে, তাহলে সৎ লোকের রাজনীতিতে আসার পথ সুগম হবে

বর্তমানের কষ্ট মানুষ সহজে ভোলে না । এই রাগ থেকে তারা যে অনেকটা প্রতিহিংষার মতন যে কাজটি করে থাকে তার ফলে অনেক সময়েই খারাপ দলটি নির্বাচিত হয়ে আসে । আবার, ন্যায্য কারনে মানুষ কষ্ট সহ্য করতে পারে, কিন্তু অন্যায্য বা বিনা কারনে কষ্ট দেয়া হলে তা সহ্য করা তাদের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পরে। আওয়ামী লীগ সরকার অনাবশ্যক ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে বা সি এন জি স্টেশন বন্ধ রেখে মানুষের জন্য যে দুর্বিসহ যাতনা তৈরী করেছে তা ভোলা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হবে না । আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়া স্বাভাবিক । আমাদের জন প্রতিনিধিদের সবাই ভাল হবে এটা জনগন আশা করে না । কিন্তু চরম খারাপদের তারা অবশ্যই পছন্দ করে না। আর তারা চরম বিরক্ত হয় যখন তারা অবাক হয়ে দেখে যে, এই জঘন্য ধরনের লোকদেরকেও সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে তাদের আস্থাভাজন ব্যাক্তি কিছুই বলছেন না ।

নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথা সকলেরই স্মরন রাখা দরকার। শুধুমাত্র এই দলটিই জিতবে এমন ধারনার বশে মানুষ অনেক সময় বেশী বেশী কাজ করে ফেলতে পারে। বলা বাহুল্য, দল পরিবর্তন হলে তাদের খুব বিপদে পড়ার সম্ভাবনা। আগামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক মেয়র নির্বাচনের ঘটনাটি খুবই গুরুত্ব দিয়ে স্মরন রাখা উচিত।

আমরা গল্প শুনেছি, কাক কোন কিছু লুকানোর সময় নিজের চোখ বন্ধ করে রাখে। সে মনে করে, আমি যখন দেখছি না তখন অন্য কেউও দেখছে না । সরকারের অবগতির জন্য বলি, সরকারের প্রতিটি পরিকল্পনা, উদ্দ্যোগ, কিছুদিন পরেই উদ্দ্যোগ বা পরিকল্পনা বদলে ফেলা ইত্যাদির পেছনে সরকার যে যুক্তিই দেখাক না কেন, মানুষ তাদের পুরানো অভিজ্ঞতা দিয়ে তার অন্য মানে করে নেয় । যোগাযোগের এই চরম উন্নতির যুগে সরকার যে সব কাজ গোপনে করে বলে মনে করে, তার অনেক কিছুই জনগন জানে। আর জনগন যে সেই জানার উপর ভিত্তি করেই যে তাদের নির্বাচনী রায় দিয়ে থাকে তা আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি

অধ্যাপক বিজন বিহারী শর্মা , ডীন, স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদ, আহসানুল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ।

pdf/2010/People_s_thought_583939040.pdf ( B) 


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment