Eid Zekhane Zemon
ঈদ যেখানে যেমন – ওয়াসিম খান পলাশ প্যারিস থেকে
ঈদ মুসলিম ধর্মালম্বীদের জন্য একটি বিশেষ আনন্দের দিন। ছোট,বড় সবার কাছেই ঈদের আনন্দ অন্য রকম। ছোটদের এক ধরনের আনন্দ ,বড়দের অন্য রকম। তাইতো ঈদ মানে খুশি। অতীতের সব দ্বিধা দ্বন্দ ভুলে যাওয়া। ছোটবেলার ঈদের স্মৃতি কেইবা ভুলতে পারে। নিজের বাড়িতে,কেউ নানার বাড়িতে আবার কখনো দাদার বাড়িতে ঈদ করার আনন্দই অন্য রকম। ছেলেবেলার ঈদের স্মৃতি ভুলা যায়না কখনো। রমজান মাসের পুরোটাই থাকে ঈঁদের আমেজ। সারা মাস ধরে চলে ঈদের জামা কাপড় কেনাকাটা। ভাবতেই আতঁকে উঠে ভিতরটা। ঈদের সকালে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে পায়জামা পানজাবি,টুপি, গায়ে আতঁর লাগিয়ে নামাজ পড়তে যাওয়ার স্মৃতি কারনা মনে পড়ে। নামাজ শেষে সবার সাথে কোলাকোলি। বাসায় এসে নতুন জামা কাপড় পড়ে বন্ধুদের নিয়ে বেড়িয়ে পরা, স্মৃতি গুলো খুবই নাড়া দেয় এখন।
দেশের ঈদে আছে অন্য রকম অনুভুতি, ব্যাপারটা বুঝা যায় প্রবাসে থেকে। প্রবাসে ঈদের অনুভুতি অন্য রকম। ভিন দেশে, ভিন্ন পরিবেশে যেখানে নিজেরা সংখ্যালঘু সেখানে ঈদের আনন্দ খুজেই পাওয়া যায় না । তারপরও আমরা নিজেদের খুজে পাওয়ার চেষ্টা করি এই দিনটিতে।
আয়তনে ফ্রান্স পশ্চিম ইউরোপের সবচেয়ে বড় দেশ। ক্যাথলিকরা সংখ্যা গরিষ্ঠ এই দেশটিতে। জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় কোটি। এর ৯% মুসলমান। মুসলমানদের অধিকাংশই অভিবাসী। এরা এসেছে আফ্রিকা মহাদেশের দেশ আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনেসিয়া, সেনেগাল থেকে। এক সময় আফ্রিকার বিশাল একটি অংশ ফ্রান্সের কোলনি ছিল দীর্ঘদিন। এসব দেশের ভাষাও ছিল ফরাসি, এদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। ফ্রান্স এক সময় বিপুল পরিমান শ্রমিক মাইগ্রেন্ট করেছিল এসব দেশ থেকে।
কয়েক জেনারেশন পেরিয়ে এরা এখানে এখন বেশ সংঘটিত। এদের রয়েছে ধর্মীয় সংগঠন,কোরান শিক্ষা স্কুল, পাঠাগার ও নিজস্ব মসজিদ। যার জন্য মসলমানদের ধর্মীয় উৎসব গুলো বেশ প্রভাব ফেলে এখানে। অনেক মসজিদ রয়েছে এখানে ওখানে। তবে ইসলামিক আর্কিটেক্ট ব্যবহার করে মসজিদ করার অনুমতি নেই এখানে। পাভিওন বাড়িগুলোকে মসজিদের রূপান্তর করা হয়েছে। বর্তমান সরকার আইন করে মেয়েদের বোরকা পড়া নিষিদ্ধ করেছে।
ঈদে এখানের প্রায় প্রতিটি মসজিদেই ঈদের জামাত হয়ে থাকে। শহরতলীর কোথাও কোথাও মাঠে বিশাল ঈদের জামাত হয়।একটি বিশেষ কথা উল্লেখ না করলেই না যে এখানে অনেক বিধর্মীকে ঈদের নামাজ শেষে সেচ্ছায় মুসলমান হতে দেখা যায়। নামাজ শেষে মোনাজাতের আগে ঈমাম একে একে কলমা পরিয়ে মুসলমান করে থাকেন।
এখনকার বড় জামাতগুলোতে এলাকার মেয়রদের আমন্ত্রন জানানো হয়। মেয়র উপস্থিত হয়ে এলাকাবাসীদের ঈদের শুভেচ্ছা জানান এবংএলাকাবাসীর সাথে মত বিনিময় করেন।
আমাদের দেশের মতো এখানেও ঈদের দিনটি নিয়ে দ্বিধা দ্বন্ধে থাকেন সবাই। এখানকার মুস লিম কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ সিন্ধান্ত নিয়ে থাকেন কবে ঈদ পালিত হবে। মসজিদগুলোতে যোগাযোগ করে জেনে নেয়া যায় ঈদের সঠিক দিনটি। বাংলা দোকানকে ফোন করেও জেনে নেয়া যায়। কেউ আবার পরিচিতজনের বাসায় ফোন করে জেনে নেয় ঈদের দিনটির কথা।এদেশের টিভি, রেডিওতেও প্রচার করা হয় ঈদের নিউজ। বাংলা দোকান গুলোতে পাওয়া যায় ঈদের নামাজের সময় সূচি।
দিনটি সরকারি ছুটির দিন না হওয়ায় এখানে ঈদের আমেজ তেমন বুঝা যায় না। তবে মুসলমানরা অনেকটা জোর করে নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে থাকেন। অনেকে আবার কর্মস্থলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সাথে আলোচনা সাপেক্ষে ছুটি নিয়ে থাকেন। এখানকার
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঈদের দিনের ক্লাশগুলোর উপর কোনো বাধ্য বাধকতা রাখে না। ইচ্ছে করলে যে কেউ ক্লাশ করতে পারে আবার না করলেও হয়। ফলে ছেলে মেয়েরা বাবা মায়ের সাথে ঈদ করার সুযোগ পায়। ঈদের দিন সকালে এদিক ওদিক মুসলমানদের মসজিদে যেতে দেখা যায়। এখানকার ঈদের জামাতে ছেলেদের সাথে মেয়েদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা থাকে। অনেক মেয়েদের ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে দেখা যায়।
সাধারনত এখানে ঈদ দেশের একদিন আগে হয়ে থাকে। সবাই নিকট জনদের খুব মিস করে । অন্তত একটিবার ফোন করে খোজ খবর নেয়ার চেষ্টা করে প্রিয়জনদের।
ফ্রান্সে প্রায় পনের হাজারের মতো বাংলাদেশী বসবাস করে। সংখ্যার দিক দিয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক কম। এদের অধিকাংশই প্যারিস ও তার আশেপাশের শহরতলীতে বাস করে। একটি অংশ চলে গেছে অন্যান্য শহরে। এখানে বাংলাদেশীদের দ্বারা পরিচালিত দুটি মসজিদ আছে যেখানে ঈদের জামাত হয় প্রতিবছর। একটি নগরীর ওবারবিলীয়েতে অন্যটি শহরতলীর Staint তে। প্রবাসীরা দলে দলে জমায়েত হয় বাংলা মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে। অদৃশ্য একটা টান যেন কাজ করে সবার মাঝে। দেশের মাঝে হারিয়ে যায় সবাই। দেখা মেলে চেনা সব প্রিয় মুখ। নামাজ শেষে বাংগালী ভাইদের সাথে কোলাকোলির সুযোগ মিলে এ উপলক্ষ্যে।
এত কিছুর পরও এখানে গড়ে উঠেছে একটি সমাজ, বন্ধু সার্কেল। এদেরকে নিয়েই আমাদের আনন্দ বেদনাগুলো ভাগাভাগি করতে হয়। ফোন করে বা গিয়ে শুভেচ্ছা জানায় একে অন্যকে। আমাদের সন্তানরাও ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয় না। নতুন জামা কাপড় পড়ে তারাও নিজেকে খুজে পায় ঈদে।
আমেরিকা, লন্ডন বা রোমের মতো বাংলাদেশী জামাকাপড়ের দোকান নেই প্যারিসে। এখানে ঈদের পোষাক ক্রয়ের কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। কেউ কেউ দেশ থেকে আগাম পোষাক নিয়ে আসেন এসব উৎসবের জন্য। বাকীরা এখানকার মার্কেট থেকে কেনা কাটা সেরে ফেলেন। বিশ্বের অনেক নগরীর মতো এখনো বাংলা টাউন গড়ে উঠেনি এখানে। তবে নগরীর গার্ডো নর্ড,হোস,ওবারবিলীয়ে,বিলভিল, মেরী ক্লিসি এলাকায় বাংলা দোকানপাট ও বাংগালীরা বসবাস করে।
বাংলাদেশি আলিমেন্টেশন দোকানগুলোতে ঈদের সবধরনের পণ্য সামগ্রী পাওয়া যায়। ঈদ উপলক্ষ্যে সেমাই, লাচ্ছি সেমাই ও অন্যান্য সামগ্রী আমদানি হয় বাংলাদেশ থেকে। পাশাপাশি আরব,পাকিস্তান, ইন্ডিয়ান ও শ্রীলংকান দোকান গুলোতেও পাওয়া যায় ঈদের পণ্য সামগ্রী। আরবদের মাংসের দোকানগুলোতে পাওয়া যায় হালাল মাংস। এসব আলিমেন্টাশন দোকানগুলোতে রোজার দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই শুরু হয় ঈদের কেনাকাটা। দেখা যায় ঈদের আমেজ। ব্যবসায়ীরাও ব্যস্ত থাকে বেচা কেনায়।
যারা পরিবার পরিজন নিয়ে বাস করেন তারা যেমন পরিবারের সাথে ঈদ করেন। আবার একটি অংশ আছেন যারা ব্যচেলার কিংবা যাদের পরিবার দেশে থাকে, এখানে মেছ করে থাকেন, তারাও রুম মেটদের নিয়ে হৈ চৈ করে কাটিয়ে দেন দিনটি। যারা কর্মস্থল থেকে ছুটি নিতে পারেননি, কিংবা ব্যবসায়ী, কাজ শেষে ছুটে যান নিকটজনদের কাছে। সব কিছুর মাঝেই থাকে বাংলাদেশী আতিথেওতা।
07/09/10