দিন যায়, দিন আসে: পর্ব ১

দিন যায়, দিন আসে: পর্ব ১

শীতের বিকালে মতি মিঞার চায়ের দোকানে তিন বন্ধুর আড্ডা জমে- সবুজ, লাল্টু আর আকাশ।

লাল্টুঃ নসীব, নসীব, মধ্যবিত্তের নসীব। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড থেইক্যা অনার্স-মাস্টার্স পাস কইরা এখন চাকরীর জন্য ফ্যা ফ্যা কইরা ঘুরি। ইন্টারভিউ দিতে দিতে, ইন্টারভিউয়ের জন্য কেনা শার্ট-প্যান্টের দশা কাহিল। বুঝলি, ম্যাডাম্‌দের ঘরে জন্ম নিলে এখন আমেরিকায় চার-পাঁচখান বাড়ি, নাইলে সদরঘাটে চার-পাঁচখান কোকো জাহাজ দৌড়াইতাম। এইদিকে লোক-লজ্জায় ছোট কামও করতে পারিনা। তই শেষ-মেষ সেলস্‌ রিপ্রেজেনটেটিভ-ই হওয়া লাগবো বুঝতাছি। এ-বি-বিস্কুটের ভ্যান লইয়া মতি চাচাদের দোকানে দোকানে ঘুরুম।

আকাশঃ শোন্‌ লাল্টু, তোর এইসব হতাশা ভরা কথবার্তা ভালো লাগেনা। সবকিছু তো আর শেষ হয়ে যাচ্ছেনা। আমারওতো একই শিচুয়েশন, তাই বলে কি হাল ছেড়ে দেব?

সবুজঃ থাম্‌, থাম্‌, তোদের এইসব অপ্টি-প্যাসি [মিষ্টিক্‌] কথাবার্তা থামা। রাজনীতিতে যাই……

আকাশ আর লাল্টু ইশারায় শায় দেয়।

আকাশঃ দেখ্‌, আমেরিকায় কি দারুণ একটা নির্বাচন হয়ে গেল। প্রার্থীদের যোগ্যাতা প্রামাণের দীর্ঘ অগ্নি-পরীক্ষা। আমাদের দেশটাতে যদি এরকম হতো।

সবুজঃ কল্পনায় হতে তো সমস্যা দেখিনা। ধর্‌, চাচাকে প্রশ্ন করা হলো “দেশের মানুষের জন্য আপনার ভিশন কি?”

লাল্টুঃ কি আর কইবো, কইবো “দেখুন, আপনাদের জন্য বিপদ ক্রিয়েট করে, তারপর বিপদের সাথী হওয়াই আমার ভিশন। আমার বিখ্যাত গানটি শুনেছেন তো ‘তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথী হতে আজকের চেষ্টা আমার, তোমাদের কাছে বসে সব ব্যথা বুকে নিয়ে আমিও যে হব একাকার…’”।

তিন বন্ধু মুচকি হাসে।

আকাশঃ ধর্‌, আপাকে জিজ্ঞাসা করা হলো “দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ডঃ ইউনুসের দেওয়া দিকনির্দেশনা সম্পর্কে আপনার মতামত কি”?

লাল্টুঃ কইবো “ওই সুদখোর, দ্যাট সুদখোর, ওয়াই ডঃ ইউনুস নেম কাম ইন হিয়ার? হি’চুরি দা গ্রামীণ ব্যাঙ্ক কনসেপ্ট ফ্রম ওয়ান অফ মাই থিসিস। আপনারা জানেন আমার ২৩টা ডক্টরেট আছে। সো, নো ডঃ ইউনুস, ক্লিয়ার, পরিস্কার?”

আবারও মুচকি হাসি।

সবুজঃ আর ম্যাডামকে দুর্নীতি নিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয়?

লাল্টুঃ উত্তর পাইবি “চুপ বেয়াদ্দপ, এই বেয়াদ্দপ, সাট্‌ আপ”!

“বাবারা” মতি মিঞার কথায় তিন বন্ধুর রাজনীতির আড্ডায় ছন্দপতন ঘটে। “এককাপ চা আর এক সলাকা বিড়ি খাইয়া দুই ঘন্টা বেঞ্চি আটকাইয়া রাখলেতো আর এই বুইড়ার বেচাকিনি চলেনা। আগেতো তাও প্যাকেট ঘইরা বেনচন কিন্‌তা, আজকালতো এক সলাকা, এক সলাকা আকিজ বিঁড়িতে নামছো…”।

দোকানের সামনে দিয়ে লাল্টুর প্রতিবেশী ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কন্যা ‘আশা’ হেটে যায়। লাল্টু তটস্থ থাকে আশা এইদিককার কথাবার্তা শুনে ফেলে কিনা।

মতি মিঞা বলতে থাকে, “… শুনো বাবারা, আজকাল রাজনীতির গপ্প শুনলে গতরে আগুন জ্বলে। এই যে আমার একটা পা নাই দেখ্‌তাছো, এইটা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। তখন তোমাগো জন্মও হয় নাই। বঙ্গবন্ধুর ডাক শুইন্না যুদ্ধে গেছিলাম। বঙ্গবন্ধু কইছিল- মুক্তি মিলবো, স্বাধীনতা মিলবো। যুদ্ধ কইরলাম, পা হারাইলাম, আম্‌গো আর কি মিললো? হুনছি বঙ্গবন্ধুর মাইয়ার কানে ব্যাদনা ওইলে বিদাশ ডাক্তার দেখাইতে যায়। আমগো শইলের ব্যাদনায় গতর কাটার যোগার হইলেও উপায় নাই। বউটা সারাদিন বিছনায় পইড়া থাকে, চিকিৎসা করাইতে পারিনা। পোলাটারে পার্টির লোকেরা পিকাটিংয়ে লইয়া গেছিলো, সেই থ্যাইক্কা জেলে। আমগো মুক্তি-স্বাধীনতা-উন্নতি কিছুই হয় নাই। যাও বাবারা, ওই বট গাছটার তলায় গিয়া বিঁড়ি ফুগো আর রাজনীতির আড্ডা মারো। এই ল্যাঙ্গড়ারে একটু রহম করো…”।

মতি মিঞার কথার ঝাঝানিতে তিন বন্ধু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়ে বটগাছের দিকে হাটতে থাকে। লাল্টু বিড় বিড় করে “বুইড়া, একাত্তরে পাকি মারছোস, আর এখন আমার প্রেসটিজ মারার মিশন নিছস। আকিঁজ বিড়ির কথাটুকু আশা শুনে থাকলে বারোটা”।

রিক্সা ডাকার নাম করে আশা পেছন ফিরে তাকায়। লাল্টু ছেলেটাকে তার বেশ লাগে। মুশকিল হচ্ছে পড়শুনা শেষে ছেলেটা কোন চাকরী পাচ্ছেনা। বাবা মাকে ম্যানেজ করাও কষ্ট হবে। বাবা-মা খুজছেন প্রবাসী পাত্র। বাবা বলেন এই দেশটাতে কিচ্ছু হবেনা, যত তাড়াতাড়ি পারিস দেশ ছেড়ে বাঁচ।। তাছাড়া কে জানি শত্রুতা করে বাবার নামে দূর্নীতির অভিযোগ দিয়েছে…। আশা বড় রাস্তা থেকে একটা মিছিল এগিয়ে আসতে দেখে, “আমাদের দাবি মানতে হবে, আমাদের দাবি মানতে হবে। নেতা তুমি এগিয়ে যাও, আমরা আছি তোমার সাথে”। মিছিলের প্রথম শারিতে আট-দশজন বয়স্ক ও মাঝ বয়সী লোক। পেছনে গোটা পঞ্চাশেক শিশু-কিশোর, বেশ ফুর্তিতে শিখিয়ে দেওয়া স্লোগান আওরাচ্ছে। আশা ভাবে এই মিছিল আয়োজনের খরচ কত? আশা সাউথ-ওয়েষ্ট ইউনিভার্সিটির ম্যানজমেন্টের ছাত্রী। এই সেমিষ্টারে প্রজেক্ট ম্যানজমেন্টের উপর একটা কোর্স করছে। স্পিলট্‌-সেকেন্ডে সে মনে মনে মিছিল ম্যানজমেন্টের একটা কসট্‌-বেনিফিট এনালাইসিস করে ফেলে। কসট্‌- সামনের শারির দশজনের মাথাপিছু দু’হাজার, পেছনের পঞ্চাশের মাথাপিছু একশ, ব্যানার দু’শ, অন্যান্য আটশ। মোট ছাব্বিশ হাজার। কিছুক্ষন পরে এরা হয়ত ভাংচুর করবে, তার জন্য ক্ষতি বাবদ লাখ দু’ইয়েক। যদি পথচারী অথবা মিছিলকারী কেউ মারা যায়- এই হিসাবটা জটিল- ডিপেন্ড করবে কে মারা গেল তার উপর। যেহেতু অধিকাংশ সময় মিছিলের টোকাই ছেলেগুলোই মারা যায়, ধরা যাক, পত্রিকায় ছবি উঠানোর জন্য গরিব পিতা-মাতার কাছে চেক হস্তান্তর বাবদ বিশ-চব্বিশ হাজার। মোট আড়াই লাখ। যে নেতা পর্দার পিছন থেকে এই মিছিল পরিচালনা করছেন, তাকে চার-পাচ বছরে এই রকম অন্তত্য চার-পাচটা মিছিল করতে হবে। এই হিসাবে দশ লাখ। তারপর নমিনেশন এর জন্য পার্টি ফান্ডে লাখ চল্লিশেক। মোট কস্ট বাবদ পঞ্চাশ লাখ। বেনিফিট-একবার নিজে এবং নিজের পার্টি যদি জিততে পারে তাহলে কয়েকশ কোটি। ফাইনান্সিয়াল ম্যানাজমেন্ট কোর্সে শেখা হিসাব মতে রেট অফ রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট খুবই ভাল। বিশ্বের বিনিয়োগকারিরা যদি বিনিয়োগের এই মারাত্মক সুযোগটার কথা জানত, তাহলে আজ বিদেশী এম্বেসির সামনে আমরা যেভাবে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, বিদেশী বিনিয়োগকারিরা বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশ এম্বেসির সামনে সেভাবে লাইন দিত……।

“আপা কই যাইবেন?” রিক্সাচালকের প্রশ্নে আশা কসট্‌-বেনিফিটের হিসাব থেকে বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার রিক্সা ভাড়ার হিসাবে ফিরে আসে। ভাড়া ঠিক হলে রিক্সায় উঠার আগে লাল্টুকে সে আরও একপলক দেখে লাল্টুর চিন্তায় ফিরে যায়, “লাল্টুকে তার ভীষণ ভাল লাগে……”। মিছিল থেকে ভেসে আসা “জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো”র কর্কশ চিৎকারে আশার লাল্টুকে নিয়ে সুন্দর ভাবনাগুলো চাপা পড়ে যায়।

পিছন থেকে তাকিয়ে থাকা লাল্টু রিক্সায় চড়ে আশাকে আস্তে আস্তে দূরে চলে যেতে দেখে।

[শাওন খান, নভেম্বর ২০০৮, ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়া। E: shawon@gmx.com.]


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment