ক্যানবেরা খেরোখাতা ৬

ক্যানবেরা খেরোখাতা ৬


দিনগুলো যেনো রেসের ঘোড়া, রেসকোর্সের সেই পাগলা ঘোড়ার মতো দৌড়ুচ্ছেই তো দৌড়ুচ্ছেই, থামতে চাইলেও থামতে পারছে না। সপ্তাহ যে কিভাবে কেটে যায় সেটা বোঝার আগেই নতুন সপ্তাহ শুরু হয়ে যায়। এ সপ্তাহের তাজা খবর হলো আমি আধেক বেকার হলাম। পুরো বেকার হবার অভিগ্যতা অতীতে হয়েছে তবে এবারেরটা একটু অন্যরকম, ‘আধেক বেকার’। সপ্তাহ শেষে দুটো বড় বড় প্রেজেন্টেশন দেবার পর মনে হলো দুটো বিশাল বোঝা কাঁধ হতে নেমে গেলো, মনে হচ্ছিলো অনেক কিছুই শেষ হলো। কিন্তু শেষ হলো আরেকটি শুরু হবার দরজা, আরেক পর্ব শুরু হবার পালা। সেই নতুন দরজা দিয়ে নতুন জীবন শুরু করার অপেক্ষার প্রহর গুনছি।


‌ব্যক্তিগত ভাবে আমি খুব একটা বন্ধু বৎসল নই। বেছে বেছে মানুষের সাথে মিশতেই পছন্দ করি। হয়তো এজন্যই বন্ধুর সংখ্যা হাতে গোনা। ক্যানবেরা এসেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মনের মিল না হলে বন্ধু বানাবার অভিনয় আমি করতে পারি না। ক্যানবেরায় আমার একজন বড় ভাই আছেন। উনি হয়তো জানেন না উনাকে আমি দারুন পছন্দ করি। বয়সে অনেক বড় হলেও একজন মানুষ মনের দিক থেকে কি সুন্দর ভাবে তরুন থাকতে পারেন তার একটা উদাহরন হতে পারেন উনি। একবার উনার বাসায় যাবার কথা ছিলো, উনি রান্না করে আমাদের অপেক্ষায় বসে ছিলেন , কিন্তু আমাদের যাওয়া হয়নি। এ লজ্জা-ভয়ে উনাকে অনেকদিন ফোন করতেই সাহস করিনি। বলা হয়নি ট্যাক্সি করে যাবার টাকা ছিলো না বলেই যাওয়া হয়নি। ঠিক করেছি আগামি সপ্তাহে একবার বিরক্ত করবো উনাদের সবাইকে।


বিয়ে করার পর থেকেই সংসার চালানোর আনন্দ-কস্ট-জ্বালা হাড়ে হাড়ে অনুভব করছি। সেদিন আলুর ডাল রান্না করলাম, হঠাৎ করেই । যখন দেশে ছিলাম তখন মাঝে মাঝেই আমাদের পরিবারে বিশাল অর্থসংকট চলে আসতো। তখন মাকে দেখতাম সেই রকম পরিমান ঝোল দিয়ে তরকারী রাঁধতে। আলুর ডাল একম এক আইটেম। আলু সিদ্ধ করে ভেঙে সেটাকে তরকারীর মতো ঝোল ঝোল করে রান্না, মাঝে সাজে সেখানে ডিম ভাজির স্লাইস। বিশাল পরিবারের জন্য উপযুক্ত তরকারী। পরিবারের আকৃতি বড় থাকায় সব তরকারীতেই ঝোল বেশী দেয়া হতো। এ কারনেই হয়তো ভুনা খাবারের প্রতি আমার আগ্রহ কম। আমার বউ অবশ্য আলুর ডালের কথা আগে শুনেনি। আমার এ মুহুর্তে অর্থসংকট নেই তবে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আলুর ডাল খেতে। আজ ব্লগে একটা গাছের ছবি দেখলাম। অনেক বছর আগের কথা, তখন আমরা রংপুরে । সেখানে সেই কাঁটাওলা বুনো গাছটিকে কি ভাবে তরকারী হিসেবে খাওয়া হয় সেটা জেনেছিলাম, মা রান্নাও করতেন, কিছুটা শখে কিছুটা অর্থ সাশ্রয়ের জন্য। ভাবছি ৭৪ এর দূর্ভীক্ষের সময় রংপুরের মানুষ সেটাকে ডাটার বদলে তরকারীতে ব্যবহার করতো, হয়তো আজো করে। দেশ স্বাধীন হবার অনেক বছর হয়েছে কিন্তু সেই গরীব মানুষগুলো গরীবই রয়ে গেছে। বাজারে চালের যে দাম, সেখানে ডাটা কেনা ! সেই বুনো কাঁটাওলা গাছই হয়তো একমাত্র সম্বল।


বাংলাদেশ হাইকমিশন অনেক দিন পর একজন নতুন হাইকমিশনার পাচ্ছে। লে. জে. জহিরুল আলম। ক্ষমতার বলয় হতে বিচ্যুত, স্বর্গ হতে বহিঃস্কৃত একজন মানুষ আমাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে এই ক্যাঙারুর দেশে আসছেন শুনে পুলকিত হতে পারছি না। সচারচর সামরিক বাহিনী হতে আসা এসব মানুষের বুদ্ধিমত্তার প্রতি সন্দেহ আছে আমার। বেশ ক বছর আগে বাংলাদেশ হাইকমিশনে গিয়েছিলাম। অভ্যর্থনা কক্ষে তাক ভর্তি ইনকিলাব দেখে মনে হয়েছিলো দেশে মনে হয় সেটাই একমাত্র পত্রিকা। আশা করি উনি অন্তত এ ধারা হতে বের হয়ে আসতে পারবেন এবং সেই সাথে হাইকমিশনের সেই দেশীয় চালে কাজকর্মের একটু পরিবর্তন আনতে পারবেন। উনার কাছে এর চাইতে বেশী এ মুহুর্তে আশা করতে পারছি না।


গত ২ জুন থেকে ক্যানবেরার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমে বিশাল পরিবর্তন করা হয়েছে। বাসের রুট নাম্বার, প্লাট ফরম, টাইম টেবিল সব কিছুই নতুন করে সাজানো হয়েছে। সিটি সেন্টার ইন্টারচেন্জে গিয়ে দে

খতে পেলাম অনেক মানুষ পথ হারানো শিশুর মতো এলোমেলো ঘুরে বেড়াতে, আমিও তাদের একজন। হয়তো প্রথম দিন বলেই সব কিছু এলোমেলো লাগছিলো। এতো কিছুর মাঝেও সবাইকে শান্তভাবে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখলাম। আমাদের দেশ হলে হয়তো প্রধানমন্ত্রির গায়ের চামড়া তুলে নেবার আগুন গরম শ্লোগান দিয়ে কিছু বাস ভাঙচুর হয়ে যেতো। তবে ঢাকায় বলাকা বাসে ঝুলে যাবার অভিগ্যতা থাকায় এখানে সিটে বসতে পেরে গর্ববোধ করি।


একটা ব্যস্ত সপ্তাহ গেলো। আরেকটি ব্যস্ত সপ্তাহ শুরু হলো। দেশে যেতে খুবই ইচ্ছে করছে, কিন্তু যাওয়া হবে না। কস্ট, শুধুই কস্ট।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment