ব্রাডম্যানের বাড়িতে বাংলাদেশ!
বাউরাল থেকে ঢাকা কতদূর? ৯০৫২ কি:মি:! আর চট্টগ্রাম? ৮৮৩৯ কি:মি:! বাউরাল কোথায়? অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যে। সিডনি থেকে ১১৭ কি:মি: দূর। কিন্তু এই বাউরালে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্বের এই তথ্যগুলো আছে সেখানকার একটি ইলেক্ট্রনিক বোর্ডে! কারন বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলে। ক্রিকেটের জন্যে পাগল বাংলাদেশের কোটি মানুষজন! শুধু বাংলাদেশ না, তাবৎ দুনিয়ার যত দেশ ক্রিকেট খেলে তাদের সবার তথ্য আছে বাউরালে! কারন এখানে যে ডোনাল্ড ব্রেডম্যানের বাড়ি! তার সৃষ্টি সময়ের সব স্মৃতি যে এখানে! তার নামে এখানে গড়ে উঠেছে ব্রাডম্যান মিউজিয়াম এন্ড ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট হল অব ফ্রেম।
ব্রাডম্যানের বাড়ি দেখতে গিয়ে তার নামে গড়া জাদুঘরে তার অনেক কিছু দেখতে দেখতে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা আর নানা তথ্যরাজি দেখতে দেখতে মন ছুঁয়ে যায়! দেয়ালে ঝুলানো প্রথম পতাকাটি বাংলাদেশের! ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয়ের একটি ছবিও সেখানে ঝুলানো! ইলেক্ট্রোনিক বোর্ডের বাংলাদেশ অংশে ঢাকা-চট্টগ্রামের তথ্য উল্লেখ করা আছে! ঢাকা লেখাটি আছে দুবার। প্রথমটায় স্পর্শ করলে ভেসে আসে মিরপুরের শেরে বাংলা নগর স্টেডিয়ামের তথ্য সহ বাংলাদেশের সাবেক স্পিন বোলার মোহাম্মদ রফিকের ছবি! সঙ্গে তার নানান তথ্য! এরপরের ঢাকা লেখাটিতে স্পর্শ করলে ছবি ভেসে আসে সাকিব আল হাসানের! চিটাগং লেখাটায় স্পর্শ করলে ভেসে আসে ছবি তামিম ইকবালের! সঙ্গে তাদের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের নানা তথ্য! এসবতো সম্ভব হয়েছে ক্রিকেটের কারনে। কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয়ী বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের স্বাক্ষর করা ব্যাট, জার্সি, টুপিও এই জাদুঘরে আছে! বাংলাদেশের আর কী আছে এই জাদুঘরে? হ্যাঁ সেটিই আছে! তা হলো ক্রিকেটভক্ত পাগল ক্রাউডের ছবি! রাস্তায় ক্রিকেট খেলা তথা স্ট্রিট ক্রিকেটের ছবি!
সিডনি থেকে গাড়ি দৌড়িয়ে বাউরাল যেতে সময় লেগেছে প্রায় দেড় ঘন্টা! এখানকার ব্রাডম্যান মিউজিয়ামের লোকজনও বাংলাদেশকে চেনেন-জানেন। কারন ব্রাডম্যানের উৎসের খোঁজে এখানেও যে আসেন বাংলাদেশের মানুষজন! যে ক্রিকেট জানে-ভালোবাসে সে কী বাউরাল না এসে পারে? এখানেই যে এক ক্রিকেট লিজেন্ডের সৃষ্টি হয়েছিল তার ১২ বছর বয়সে! যে কীনা টেস্ট ক্রিকেটে একদিনে করেছিলেন ৩০৯ রান! ৫২ টেস্টের ৮০ ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ২৯ টি! টেস্টে তার গড় ৯৯:৯৪! আর ৯৫:১৪ গড় একদিনের ক্রিকেটে! ২২ বলে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন ডোনাল্ড ব্রাডম্যান! তাকে শুধু ক্রিকেট না, রাজা বলা হয় অস্ট্রেলিয়ার সব ধরনের খেলাধুলার!
বাউরালের ৫২ শেফার্ড স্ট্রিটের বাড়িতে শৈশব কেটেছে ব্রাডম্যানের। ১৯১১ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এখানে ছিলেন ব্রাডম্যান। যে পানির ট্যাংকে বল ছুঁড়ে ব্রাডম্যান অনুশীলন করতেন, সেটি এখনও অবিকল সংরক্ষন করা আছে! সে বাড়িটা অবশ্য এখন এন্ড্রু লিমিং নামের এক ক্রিকেটপ্রেমীর মালিকানাধীন! একাধিক হাত ঘুরে বাড়িটি এন্ড্রুর হাতে আসে। মঙ্গলবার সে বাড়িতে ব্রাডম্যানের শয়নকক্ষ, পিয়ানো সহ নানাকিছু দেখান এন্ড্রু। বাড়িটি কেনার সময় এর ক্ষয়িষ্ণু নানাকিছু, এরপর পুরোনো স্মৃতিময় সবকিছু অবিকল ঠিক রেখে সেসবের পুননির্মানের ধারাবাহিক ছবিগুলো দেখান! সে বাড়িটায়ও পৃথক একটু জাদুঘর করার পরিকল্পনা এন্ড্রুর। সেখানে থাকবে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর ক্রিকেট লিজেন্ডদের ছবি সহ নানাকিছু। ভারতের শচিন টেন্ডুলকারের ছবি সেখানে থাকবে এটা তিনি নিশ্চিত বলে দিলেন? বাংলাদেশের কার ছবি রাখা যায়? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, ব্রাডম্যানকে নিয়ে তার ছবির সংগ্রহশালার প্রদর্শন উপলক্ষে বাংলাদেশে আসার ইচ্ছা আছে এন্ড্রু লিমিং’এর। এসব নানা তথ্য,ব্রাডম্যানের বাড়ির নানাকিছু আন্তরিকভাবে দেখালেও এই ভদ্রলোক কিন্তু কিছু বিষয়ে বেশ কড়াকড়িই দেখিয়েছেন! যেমন বাড়ির ভিতর আর তার ছবি তোলা নিষেধ! যে পানির ট্যাংকে গলফের বল ছুঁড়ে ব্রাডম্যান অনুশীলন করতেন, শুধু সেই ট্যাংকের ছবি তুলতে দেয়া হয়েছে! উপহার দেয়া হয়েছে ব্রাডম্যানের শৈশবের বাড়ির স্মৃতিচিহ্নের ছাপযুক্ত গলফের বল একটা! আর ব্রাডম্যান আর ক্রিকেট নিয়ে দূর্লভ সব ছবির সংগ্রহশালা নিয়ে ব্রুশিয়ার একখানা!
৫২ শেফার্ড স্ট্রিটের বাড়িটি ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতেই আজকের ব্রাডম্যান ওভাল! বাউরাল স্কুলে যখন ব্রাডম্যান পড়তেন, এখানেই স্কুল টিমের হয়ে প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ তিনি খেলেন! প্রথম ম্যাচেই তার রান ছিল ১১৫ নটআউট! এরপর ১৯২৫-২৬ মওসুমে এখানে তিনি ১৩১৪ রান করেন! রানের গড় ছিল ৯৪:১৪! তখন বাউরালের এই মাঠের নাম ছিল গ্লেভ ক্রিকেট। ১৯৪৭ সালে এর নাম পাল্টে ব্রাডম্যান ওভাল করা হয়। ক্রিকেটের এমন এক রাজার সৃষ্টি যে মাঠে, সেটির নাম কী তার নামের চেয়ে বড় কিছুতে হতে পারে! মঙ্গলবার সেই ওভালের মাঠে পা রেখে অনুভব করা গেছে ব্রাডম্যানের অস্তিত্ব! তার নানা স্মৃতি আছে সিডনিতে, এডিলেইডে, মেলবোর্নে। কিন্তু বাউরালের স্মৃতির তুলনা যে আর কিছুতে হবার নয়। সেই মিউজিয়ামে আছে ব্রাডম্যানের সৃষ্টি থেকে শুরু করে শীর্ষে ওঠার নানা বৃত্তান্ত! তার ব্যাট, বল, পোশাক থেকে শুরু করে কী নেই সেখানে! মিউজিয়ামটি প্রথমে ব্রাডম্যানের জন্যে করা হলেও সেটির নাম বদল থেকে শুরু করে নানান সংগ্রহ থেকে উপস্থাপনের আঙ্গিকটি এখন বিশ্ব ক্রিকেট কেন্দ্রিক ও ভিত্তিক! অস্ট্রেলিয়ান ব্রাডম্যান যে এখন বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম স্মারক মানব! তাই তার নামের মিউজিয়ামটিও পাল্টে হয়ে গেছে বিশ্বজনীন!