হরতালের বিকল্প ভাবুন

হরতালের বিকল্প ভাবুন

নির্দলীয় সরকারপ্রধানের দাবিতে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি যে আপোষহীন, তা তাদের বিগত কয়েকদিনের কর্মসূচিতেই প্রতীয়মান। দলটি তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বেশ কিছু কর্মসূচির ঘোষণা অনেক আগেই দিয়েছিল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ অগাস্ট মাসের এক প্রতিবাদী সমাবেশে হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, “ঈদের পর থেকে আগামী দুই মাস রাজপথ রেলপথ অবরোধ এবং লাগাতার হরতালের মাধ্যমে দেশ অচল করে দেয়া হবে। কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটানো হবে। আমরা দেশব্যাপী রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধ করবো, ঘেরাও কর্মসূচি দেব, হরতাল দেব এবং অক্টোবরে লাগাতার হরতাল দেব।” তারা তাদের কথা রেখেছেন। অক্টোবরে লাগাতার হরতাল দিয়েছেন। অক্টোবর পেরিয়ে নভেম্বরেও তারা হরতাল দিচ্ছেন এবং সন্দেহ নেই আগামীতেও দেবেন।

তবে মওদুদ আহমেদ এবং সেই সাথে বিরোধীদলের এই হুমকি কিন্তু আমাদের জনগনের কাছে নতুন কিছু নয়। এর আগেও ক্ষমতাসীন আওয়ামিলিগ যখন বিরোধীদলে ছিল, ঠিক একই সুরে তত্কালীন ক্ষমতাসীন বিএনপিকে এভাবেই দেশ অচল করার হুমকি দিত। বলাবাহুল্য, হরতালে হরতালে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে ছেড়েছিল। কাজেই হরতালের ক্ষেত্রে, জনগনকে জিম্মি রেখে গদিতে বসার দাবি আদায়ে দু’দলের নীতিতে যে, কোনো পার্থক্য নেই তা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয় না।

কথা হল, বিরোধীদলের দাবি অনুযায়ী তারা দেশের মানুষকে আওয়ামীলীগের কুশাসন থেকে মুক্ত করতে বদ্ধ পরিকর। আর দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্যই নাকি তারা দাবি আদায়ে পথে নেমেছেন। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো নেতাকেই আমরা হরতালে পথে নামতে দেখিনি, আহত কিংবা অগ্নিদগ্ধ হতে দেখিনি। তবে হরতালের প্রতিটি দিন আমরা দেখেছি গাড়ি ভাংচুর, চালকসহ অগ্নিদগ্ধ গাড়ি, ককটেলের আঘাতে ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের পঙ্গুত্ব, গান পাউডারের লেলিহান শিখায় পুড়ে যাওয়া বেশ কিছু খেটে খাওয়া হাড্ডিসার দিনমজুর আর দেখেছি তাদের অসহায় পরিবারের করুন মুখ।

প্রশ্ন হলো এই মানুষগুলোর দোষ কি? তারা কি মস্ত বড় ক্যাডার? তারা কি টেন্ডারবাজির ভাগ পায়? দল ক্ষমতায় এলে পঙ্গু শিশু রহিমা কি স্কলাস্টিকায় পড়ার সুযোগ পাবে? না এরা কিন্তু কিছুই না। এরা এদেশের খেটে খাওয়া এবং অনাহারে থাকা জনগণ। এরা ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগ পায়নি, পাবেও না কখনো। তবে কেন তারা হরতালে ভুক্তভোগী হবে? পঙ্গুত্ব বহনকরি ছোট শিশুগুলো তো কোনো দলের নয়, তবে ওরা কেন আজীবন ধুঁকে ধুঁকে বাঁচবে? এদের মঙ্গলের জন্যই আপনারা হরতাল দিচ্ছেন বলে কি দাবি করছেন না? মৃত্যুর দুয়ারে পাঠিয়ে এভাবেই কি তাদের মঙ্গল করছেন?

এ যুগে হরতালে কি আদৌ কোনো দাবি আদায় হয়? হয় না। বরং তা হিতে বিপরীত হতে পারে। হরতাল না দিয়ে বিকল্প কিছু চিন্তা করুন। নিজেদের মধ্যে কথা বলুন, আলোচনায় আসুন। ঝগড়াঝাটি, হাতাহাতি, মান-অভিমান যাই হোক, একটা সময় ঠিকই সমধান বেরিয়ে আসবে। কিন্তু দেশের মানুষকে জিম্মি করে এভাবে দয়া করে সহিংস আন্দোলনের পথ পরিহার করুন।

হরতাল এখন আসলেই দাবি আদায়ের একটা ব্যাকডেটেড পলিসি। দেশের মানুষকে জনে জনে জিগ্যেস করুন। সবাই এক বাক্যে বলবেন হরতাল চাই না। হরতালের সহিংসতায় কার ঘরে কখন কার বুকের মানিক ছিনিয়ে নেবে কেউই বলতে পারে না।

সাবেক এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে “আল্লাহর মাল আল্লাহয় নেবে” জেনেও আমরা সবাই স্বাভাবিক মৃত্যু কামনা করি। এভাবে আগুনে শরীরের ৬৫ ভাগ পুড়ে যন্ত্রনাদগ্ধ মৃত্যু কেউ আমরা কামনা করিনা কখনই।

আইন করে হরতালকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করুন। নিজেদের স্বার্থের জন্য যখন তখন দেশ অচল করে দেবার হুমকি দু’দলকেই ত্যাগ করতে হবে। কারণ দেশ অচল করে নয়, দেশকে সচল রেখেই দাবি আদায় করা যে সম্ভব তা পৃথিবীর প্রায় সব সভ্য দেশেই উদাহরণ হিসেবে আমাদের চোখের সামনে আছে।

আমরা নিশ্চয়ই স্বাধীন দেশের সভ্য নাগরিক। পরাধীন কোনো জাতি নই। আলোচনার মধ্য দিয়েও দাবি আদায় করা নিশ্চয়ই সম্ভব। দরকার শুধু রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ক্ষমতার প্রতি সীমাহীন লোভের লাগাম টানা ও সত্যিকার দেশপ্রেম।

আমরা বিশ্বাস করতে চাই, আপনারা প্রধান রাজনৈতিক দু’দল আমাদের জনগনের মঙ্গল কামনা করেন। জনগনের মঙ্গল কামনায় যদি মনে হয় আন্দোলন করা দরকার, অবশ্যই করবেন। তবে তা দেশের মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নয়, অবুঝ শিশুদের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে নয়। দেশের মানুষের ভাবনা চিন্তার ভার যখন আপনাদের হাতেই তখন দাবি আদায়ের অহিংস পথ আপনারাই খুঁজে বের করুন।

ইতিহাস দেখুন, জরিপ করুন, গ্রামে গঞ্জে ঘুরুন। দেখতে পাবেন আপনারা দু’দল নিজেদের ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে দেশের মঙ্গলের জন্য যত ভালো কাজই করুন না কেন, এদেশের জনগণ ১০ বছর টানা এক দলকে ক্ষমতায় বসায়নি, বসাবেও না। কাজেই হরতাল দিয়ে শুধু শুধু জনসমর্থন হারানোর মত বোকামি না করে সমঝোতায় আসুন।

সমাবেশগুলোতে একে অপরকে ব্যক্তিগত আক্রমন না করে, কার শাড়ির রং কেমন, কে কখন ঘুম থেকে উঠে, আর কে কত সকালে উঠে নামাজ পড়ে এসবের ফিরিস্তি না দিয়ে গঠনমূলক চিন্তা করুন। আপনারা দু’দল সিদ্ধান্তে পৌছাতে যত দেরী করবেন, মুড়ি-মুড়কির মত আমরা জনগণ মারা পড়ব। গায়েবানা জানাজা পড়েও এই সব মৃত্যুর দায়ভার এড়ানো যাবে না।

ভুলে যাবেন না আমাদের মত খেটে খাওয়া জনগণই আপনাদের ভোট দিয়ে গদিতে বসাই। ক্ষমতায় বসার ইচ্ছে থাকলে দয়া করে হরতালের মত সহিংস কর্মসূচি পরিহার করে বিকল্প কিছু ভাবুন।

আমাদের শান্তিতে বাঁচতে না দিলেও, অন্তত শান্তিতে মরতে দিন।


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment