অনীকের অন্তর্ধান ও এন্ডির মতিভ্রম
(গল্পটি উৎসর্গ করা হল ছোট্ট উইলিয়াম ট্যারলকে)
সপ্তান্তের পত্রিকাতে খবরটা দেখে বহুবছর আগে এ পাড়াতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা সবারই একটু আধটু মনে পড়লো। সেবার যখন স্কুলে গরমের দীর্ঘ ছুটি শুরু হল। ঠিক সে সময়ে অনীকরাও এই পাড়ায় বাড়ী কিনে উঠলো। পাড়াপড়শীর সবার পছন্দের প্রতিবেশী এন্ডির সাথেও তাদের পরিচয় হল। তার স্ত্রী মারা গেছে আট নয় বছর হয়। এন্ডির বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে তখন । অবসর জীবনে নিঃসন্তান মানুষটি নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের নানা কাজে হাত লাগায়। কারোরও গাছ ছাটতে বা কারোর ঘাস কাটতে সে হাসি মুখে এগিয়ে যায়। বয়সের তুলনায় সে এখনো বেশ শক্তসমর্থ এবং কর্মপ্রিয় একজন মানুষ। অলস সময় কাটায় না মোটেও। পড়শীরাও তাকে নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে ডাকে। এই পাড়াতে অনেক দেশ, অনেক জাত, অনেক ধর্মের মানুষ বাস করে। এন্ডি বোস সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য। সেও মিশুক স্বভাবের, তাই সবার সাথে মিশতে সে পছন্দ করে।
বাড়ী কেনা, বাড়ী পাল্টানোর খরচের ঝামেলায় অনীকের পরিবার ওই বছরে বেড়াতে যাওয়া বাদ দিয়েছে। অনীক নতুন বাড়ীতে এসে খুশী। আগে শহরের ছোট এক এ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা ছিল তারা। এখন বাগান, উঠোন নিয়ে খোলামেলা বাড়ী। পাড়াটাও ছিমছাম। এন্ডির সঙ্গে পাড়ার নানা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পাড়াটা চেনার চেষ্টা করছে প্রাইমারী স্কুল শেষ করা ছাত্র অনীক। পড়শী এন্ডি তাদের ঝোপঝাড় কেটেছেটে বাড়ীর চেহারা সুন্দর করে দিয়েছে। অনীকের বাবার সাথে ছুটির দিনে বারান্দায় বসে চা-কফি পান ও বাদাম, চিপস্ খেতে খেতে কত কত গল্প করে । চল্লিশ পয়তাল্লিশ বছরে পাড়ার কত রূপ পাল্টেছে সে সব কথা এন্ডি ওদের শোনায়। এন্ডি তার বোস পদবীর ইতিহাস বলেছে ওদের। তার দাদা বোস যার পদবী তিনি ভারত বা ফিজি থেকে নৌকাতে করে এসে এদেশীয় মেয়েকে বিয়ে করে ঘরসংসার পাতেন। তাই তারও পদবী বোস।
শান্তশিষ্ট অনীক চারপাশের সব জিনিস খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে ভালবাসে। এন্ডির সাথে ঘুরে ঘুরে অনীক এরই মাঝে আশপাশের বাড়ী গুলোর কোনটাতে কি কি গাছ সব মুটোমুটি জেনে ফেলেছে। এক বাড়ীতে দেখলো শুধুই গোলাপের গাছ। গাছ ভর্তি গোলাপ ফুল ফুটে আছে। সে বাড়ীর পাশ দিয়ে হেটে গেলে ফুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে মৃদু ঝাপটা দিয়ে যায়। সে বাড়ীর মালিক রোজমেরীও এন্ডির খুব চেনা। অনীককে ওর সাথে দেখে ডেকে কথা বললো। গোলাপের ডাল থেকে তৈরী একটি চারা অনীকের হাতে দিয়ে বললো
-তোমার মায়ের জন্য সুগন্ধী গোলাপ চারা
অনীক মহাখুশী হয়ে চারা নিয়ে বাড়ী ফিরলো। মা চারা পেয়ে খুশী হয়ে বললো
-রোজমেরীর সাথে যখন দেখা করতে যাব তখন একটা চকোলেট নিয়ে যাব বুঝলি অনীক।
পাড়ার একটা গলিতে দু’পাশের রাস্তায় বেশ বড় বড় গাছ। একজন মানুষ দু’হাত দিয়ে একটা গাছকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না। অনীক বললো
-এন্ডি চলতো দেখি দু’জনের দু’হাত দিয়ে গাছকে ঘিরে ধরতে পারি কি না
-চল দেখি
দু’জনে মিলে গাছ ঘিরে ধরার খেলা খেললো আধা বেলা। কোন কোন গাছ ছিল সত্যিই মোটা সোটা। অনীক গাছগুলো গুনে দেখলো। একপাশের ন্যাচার স্ট্রীপে ছিল দশটা অন্যপাশে ছিল এগারোটা গাছ। অনীকের গাছ গুণার কাজে এন্ডিও যোগ দিল।
-জান অনীক এ পাড়ার সবচেয়ে পুরান দিক এটা, গাছগুলোও তাই বিশাল বিশাল সব।
ক’দিন পর ওই একই রাস্তায় এক আশ্চর্য বিষয় দেখে অনীক অবাক। এন্ডিকে ডেকে উত্তেজিত গলায় অনীক বললো
-দেখ দেখ এন্ডি কি অবাক কান্ড
-কি? কি হয়েছে?
-একটা গাছ উধাও
-কোথা থেকে কি ভাবে উধাও?
-এই যে রাস্তার এক পাশে এগারোটা গাছ ছিল আর অন্য পাশে দশটা ছিল এখন দেখ একটা গাছ নাই
-কোন গাছটা নাই?
-বুঝতে পারছি না
এন্ডি এবার আগ্রহ নিয়ে রাস্তার দু’পাশে টহল দিল কয়েক বার। সে আর অনীক দু’জনে মিলে আবার গাছগুলো গুণলো। নাহ্ কোন ভুল নেই। গাছ দশটা করেই আছে। তবে একটা গাছ সত্যিই সত্যিই চলে গেছে। সব জায়গা ঘাসে ঢাকা। কোনখানে শিকড় উপরানোর চিহ্নমাত্র না রেখে গাছটা চলে গেছে। বেশ কিছুটা সময় তারা ব্যয় করলো বিষয়টা বুঝতে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সব সময়ই যেন রাস্তার দু’পাশে এরকম দশটি করেই গাছ ছিল বা আছে। তবে ওরা জানে গত সপ্তাহে ওরাই দশটা একপাশে, এগারোটা অন্যপাশে গুণে দেখেছে। হঠাৎ অনীক একটা বুদ্ধি আটলো
-এন্ডি আমরা এখন গাছ নিয়ে কাউকে কিছু বলবো না। আগামী সপ্তাহে আবার এসে দেখবো গাছগুলো তারপর ভাববো
-ঠিক আছে অনীক তাই হবে।
-আমরা আগামী সোমবারে আবার এই রাস্তায় আসবো ঠিক আছে।
এন্ডি মজা করে গম্ভীর স্বরে বললো
-ঠিক আছে বস তাই হবে।
কথামত পরের সোমবারে ওরা দু’জন আবার সে রাস্তাতে ঘুরতে গেল। শুরু হল তাদের গাছের তথ্য তালাশ করার কাজ। অবাক কান্ড! দেখা গেল রাস্তার দু’পাশে সব মিলিয়ে একুশটা গাছ রয়েছে। একপাশে এগারোটা, অপর পাশে দশটা। সমস্যা হল কোন গাছটা যে উধাও হয়েছিল এখন আবার ফিরেও এসেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ওরা পড়লো ধন্ধে। অনীক এবার কাগজ কলম নিয়ে এসেছিল। ছোট ছোট করে কাগজ কেটে নাম্বার লিখলো। সে নাম্বারগুলো এক একটা গাছের গায়ে গ্লু দিয়ে সেটে দিল।
তারপর অনীক গাছের নীচে বসেই একটি চিঠি লিখলো। চিঠিতে এই কয়দিনে ওরা গাছ নিয়ে যা যা দেখেছে সব বৃত্তান্ত নিখুঁতভাবে লিখলো। এন্ডি লেখাপড়া তেমন জানে না। সে বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামালো না। জানতে চাইলো
-কাকে পাঠাবে চিঠি? আকাশের ঠিকানায় নাকি পুলিশকে?
-দেখি। মনে হয় বিষয়টা বৈজ্ঞানিকদের জানাতে হবে।
-ওরা কোথায় থাকে?
-ওদের ঠিকানা খুঁজে বার করতে হবে। তবে এন্ডি এখনো বিষয়টা কাউকে বলবে না।
-বলবো না।
তারপর ঘটলো দুঃখজনক এক ঘটনা। এক বিকেলে অনীককে খুঁজে পাওয়া গেল না। প্রথমে আত্মীয়বন্ধু, পাড়াপড়শী সবাই মিলে খুঁজলো। না পেয়ে পুলিশে খবর দেওয়া হল। পুলিশ চারপাশ তোলপাড় করে খুঁজলো। কোনভাবেই অনীকের সন্ধান পাওয়া গেল না। মানুষের ফিসফাস কথাবার্তা শুনে এন্ডির উপর পুলিশের নজর পড়লো। একদিন জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে পুলিশ এন্ডিকে ডেকে নিয়ে গেল। মাস খানেক পর এন্ডি ফিরে আসলো। সে এক অন্য এন্ডি। কেমন জানি আপন ভোলা কখনো। কখনো বা মতিচ্ছন্ন।
গুজব শোনা গিয়েছিল পুলিশের কড়া পাহাড়া থেকে এন্ডি একদিন উধাও হয়ে গিয়েছিল। আবার পুলিশের হেফাজতেই ফিরে এসেছিল। ফিরে এসে এক অদ্ভুত গল্প বলেছিল। সে এমন এক জায়গায় গিয়েছিল যেখানে সে আকাশে দু’টো চাঁদ দেখেছিল। সেখানে সে অনীককেও দূর থেকে দেখেছে। কাছে যেতে পারে নি। কিভাবে সে ওখানে গিয়েছিল আর কিভাবেই বা ফিরে এসেছে তার কিছুই সে মনে করতে পারে না। বিষয়টা নিয়ে বেশ হৈ চৈ হয়েছিল। শোনা যায় কয়েকজন পুলিশকে চাকরী থেকে ছাটাই করা হয় পর্যন্ত। কোন এক সময়ে অনীকের পরিবার ওই পাড়া ছেড়ে চলে গিয়েছিল।
এরপর থেকে এন্ডি নিখোঁজ হওয়া মানুষ নিয়ে না না ঘটনা শুনতো ও শুনাতোও সবাইকে। পাড়ার বাচ্চারাও গল্পগুলো শুনতে চাইতো।
-অষ্ট্রেলিয়া থেকে প্রতিবছরই অনেক মানুষ হারিয়ে যায়
একটি ছোট্ট ছেলে জানতে চাইলো
-কোথায় যায় তারা?
-কেউ জানে না।
আরেকটি মেয়ে বললো
-পুলিশ কেন তাদের খুঁজে বার করে না?
-পুলিশ চেষ্টা করলেও পারে না,
আরেকজন বললো
-বোধহয় আকাশ থেকে এ্যালিয়েন এসে নিয়ে যায়। এন্ডি তোমাকেও তো একবার নিয়ে গিয়েছিল।
-হ্যাঁ আমি ওখানে আকাশে দু’টো চাঁদ দেখেছি।
বুদ্ধিমতী ছোট্ট মেয়েটি বললো
-আমি জানি তুমি কোথায় গিয়েছিলে
-তুমি জানলে কি ভাবে? আমিতো জানি না আমি কোথায় গিয়েছিলাম
-দু’টো চাঁদ আছে মঙ্গলগ্রহে। তুমি ওখানেই গিয়েছিলে এন্ডি।
মেয়ের কথা শুনে এন্ডি মাথা চুলকালো। এন্ডি জানেই না মঙ্গলগ্রহ কোথায় আছে, দুই চাঁদ বা কেন থাকবে। শুধু জানে প্রতি বছর তার দেশ অষ্ট্রেলিয়া থেকে অনেক মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়। খুব কম মানুষকেই খুঁজে পাওয়া যায়।
সে সময়ে যে বাচ্চারা ছোট্ট ছিল তারা আজ বুড়োবুড়ি হয়েছে। খবরের কাগজে এখন যখন উইলিয়াম ট্যারলের খবরটা পড়লো তাদের মনে পড়লো অনীকের নিখোঁজ হওয়ার কথা।
ছোট্ট উইলিয়াম যার বয়স মাত্র তিন বছর। তিন বছরের জীবন তার নানা ঘটনায় ঠাসা। জন্ম থেকেই ওর কপালে বিড়ম্বনার শুরু। উইলিয়ামের জন্মদাতা মা-বাবা তেমন দায়িত্বশীল ও সুবিধার মানুষ ছিল না। তাই জন্মের পর পরই সরকারের সমাজ কল্যাণ দপ্তর উইলিয়ামকে নিয়ে আসে। তাকে এক পরিবারে পালক দেওয়া হয়। তারাও তেমন সুবিধার মানুষ ছিল না। এভাবে দু’টি কি তিনটি পরিবারের আশ্রয় বদল করে শেষে এক যত্নশীল পরিবারে সে ঠাই পায়। এবারের পালক মা উইলিয়ামকে নিয়ে একবার পালক নানীর বাড়ী বেড়াতে যায়। নিরিবিলি শান্ত এক গ্রামে নানীর বাড়ী। উইলিয়াম এক সকালে পালক মায়ের সাথে খেলাধূলা করছিল পর মুহূর্তে বাড়ীর সামনে থেকে সে নিখোঁজ হয়ে যায়। সময়টা ছিল ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। পত্রিকা লিখেছে পুলিশরা শত চেষ্টা করেও পারছে না উইলিয়ামের খোঁজ পেতে। ঘোষণা হয়েছে উইলিয়ামের খবর এনে দিলে এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। এমন কি পৃথিবীর সব এক্সপার্টরা মাথা ঘামিয়েও উধাও উইলিয়ামের কোন হদিস বের করতে পারে নি। কোথায় সে আছে, কি নেই কেউ জানে না। অনীকের পাড়ার লোকজন ভাবে সেও কি অন্য কোন গ্রহে আছে? এন্ডির মত কেউ একজন থাকলে আকাশে উধাও হয়ে হয়তো বা উইলিয়ামের দেখা পেতো।
Related Articles
স্বপ্ন-বিধায়ক (অন্তরা ১)
মা ছোটোবেলায় সবসময় একটা কথা বলতেন,” বাবা মেয়েদের সবসময় সন্মান করে চলবা, নিজের বোনের মত দেখবা, তুমি একা তোমার তো
অসাধ্য সাধন
আজন্ম শিখেছে তাই বৈঠা বেয়ে যায় নয় তরী ভরাডুবি সাধু সাবধান গণিতের ছকে চলে গায় জয়গান ঘাটে ঘাটে নাও ভিড়ে
মায়ের কাছে চিঠি
মা তুমি কেমন আছো? শুধুই জানতে ইচ্ছে করে, তোমার কথা মনে হলে চোখের পানি ঝরে। এখন কেন আমায় ছেড়ে অনেক