গোপন প্রেমে মুখর কবি কাজী নজরুল
নজরুলকে নিয়ে লেখা আমার জন্যে বেদনার। এক শ্রেণির বাঙালি জীবদ্দশায় তাঁর মূল্যায়ন হয়নি বলে যত রাগ দেখান না কেন মূলত : এরাই তাঁকে ক্রমাগত বিস্মরণের আড়ালে নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের মানুষ আমরা যত বেশি আবেগপ্রবণ তত বেশি হুজুগে। একটা সময় ছিলো যখন কাজী নজরুলকে সাম্প্রদায়িকতার আড়ালে নিজেদের রক্ষা করার ব্যর্থ চেষ্টা চলতো। সে চেষ্টা এখন আর হালে পানি পায়না। কারণ সবাই জেনে গেছে তিনি আমাদের অবিচ্ছেদ্য এক জীবন অনুভূতি। ব্যস। তারপর থেকে তিনি ক্রমাগত আড়ালে যাচ্ছেন। এখন দেশে রবীন্দ্র বিরোধিতা যত বেশি ঠিক ততটাই তাঁর চর্চা হয়। না হলেও কাছাকাছি। কিন্তু নজরুল কোথায়?
ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, বুকে হাত দিয়ে বলুনতো শেষ কবে আপনি তাঁর একটা কবিতা পুরো পড়েছেন? কবে দেখেছেন তাঁর নাটক? পদ্মাগোখড়া নামের যে গল্পটি তার অতিপ্রাকৃত রস আস্বাদন ব্যতীত মানুষের পেটে মানে জোহরার পেটে সাপের বাচ্চার অলৌকিক আনন্দে বিভোর আমরা বুঝিই না কি আসলে বলা হয়েছে এতে। বলছিলাম তাঁর প্রতি আমাদের অমনযোগের কথা। কবিতা কি শুধু গাহি সাম্যের গান বা আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত? না কি আরো আছে? কি এক অজ্ঞাত কারণে তাঁকে আমরা এমন এক ফ্রেমে বন্দী করেছি যে খুলতেই ভয় পাই। ভাবখানা এমন, খুললেই জটাধারী কেউ বেরিবে এসে প্রলয় নৃত্য শুরু করবেন। এই ভাবটা তাঁর জন্য বড় অপমানের। তিনি নিজেই কিন্তু লিখেছিলেন, আমাকে বিদ্রোহী বলে ভয় ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। বিনীত নজরুল সে লেখায় এও লিখেছিলেন, দোহাই আপনাদের, আমি কবি হতে এসেছিলাম। এই যে মিনতি সেখান থেকেই তাঁকে জানার শুরুটা হলে আমাদের জীবনে তিনি বেদনা ও ভালোবাসার এক অনন্য মানুষ ও কবি হতে পারেন।
আজকাল যারা লেখালেখি করেন তাদের মূল সমস্যা পড়াশোনার অভাব। তার আগে বলি নজরুল বিষয়ে আমার মতে আবদুল মান্নান সৈয়দ আর বুদ্ধদেব বসুর লেখাগুলো পড়া উচিত। বিশেষত বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যে নতুন গদ্যের জনক। তাঁর পঠন ও মেধা নিঃসন্দেহে সর্বজন স্বীকৃত। এও বলা হয় তাঁর পত্নী প্রতিভাময়ী প্রতিভাবসুর সাথে প্রেমময় সম্পর্ক ছিলো কাজী নজরুলের। এবং যখন প্রতিভা বসুর নাম রানু সোম তখন ঢাকার নাম সোনার গাঁ বলে কোন কূলে মোর ভিড়লো তরী কোন সে সোনার গাঁয় লেখা হয়েছিল বলেও জানা যায়। অন্যদিকে বুদ্ধদেবের রাত ভরে বৃষ্টি উপন্যাসের জয়ন্তও নাকি নজরুল। আর মালতী প্রতিভা বসু। যে কথা বলছিলাম, বুদ্ধদেব বসুকে আমরা জানি নজরুলের কবিতা ও সৃষ্টির সমালোচক হিসেবে। তিনি কাজীর কবিতার দীর্ঘায়ু সম্পর্কেও সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু একথা কি জানি কি ছিলো তাঁর মূল্যায়ন? আসুন পড়ে দেখি খানিকটা:
১. শুধু বাংলা কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে তাঁর আসন নিঃসংশয়, কেননা তাঁর কবিতায় আছে সেই বেগ, যাকে দেখামাত্র কবিত্ব শক্তি বলে চেনা যায়। ২. সব সত্ত্বেও এ–কথা সত্য যে, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি। ৩. তবু অন্তত এটুকু তিনি দেখিয়ে দিলেন যে রবীন্দ্রনাথের পথ ছাড়াও অন্য পথ বাংলা কবিতায় সম্ভব।
এ–তো তথ্য এবং সনাতন সংজ্ঞা অনুযায়ী সত্য যে, যখন নজরুল অসুস্থ তখন বুদ্ধদেব বসুই ‘কবিতা’ পত্রিকার দশম বর্ষের কার্তিক–পৌষ, ১৩৫১ সংখ্যা নজরুল–সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন। জীবনানন্দকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন ‘নজরুলের কবিতা’৩ নিবন্ধটি। সুতরাং পক্ষপাতহীন যাঁরা তাঁরা তো বটেই, নজরুল প্রেমিকরাও বুদ্ধদেবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বাধ্য।
সমস্যা শুধু সেখানেই যখন বুদ্ধদেব বসু লেখেন: ‘এই যে নজরুল, রবিতাপের চরম সময়ে রাবীন্দ্রিক বন্ধন ছিঁড়ে বেরোলেন, বলতে গেলে অসাধ্য সাধন করলেন এটাও খুব সহজেই ঘটেছিলো এবং এর পিছনে সাধনার কোনো ইতিহাস নেই, কতগুলো আকস্মিক কারণেই সম্ভব হয়েছিলো এটা।
কোন রকম সাহিত্যিক প্রস্তুতি না–নিয়েও শুধু আপন স্বভাবের জোরেই রবীন্দ্রনাথ থেকে পালাতে পারলেন তিনি বাংলা কবিতায় নতুন রঙ আনতে পারলেন।
নজরুল ইসলাম নিজে জানেন নি যে, তিনি নতুন যুগ এগিয়ে আনছেন; তাঁর রচনায় সামাজিক রাজনৈতিক বিদ্রোহ আছে কিন্তু সাহিত্যিক বিদ্রোহ নেই।’
বুদ্ধদেব বসুর লেখায় আমরা এও জেনেছি নজরুল কতটা জনপ্রিয় ছিলেন সে যুগে। তিনি যেখানে যেতেন সেখানেই নায়ক। এমনকি গোরা বনাম মোহনবাগানের ফুটবলে বাকি লেখক শিল্পীরা যখন গ্যালারিতে বসে বাঙালি ফুটবলারদের উৎসাহ যোগাচ্ছিলেন নজরুল বসেছিলেন সাদাদের সাথে মাঠের কিনারে। কিন্তু ভাগ্য তাঁকে কখনো বেশিদিন একজায়গায় থাকতে দেয়নি। অভাব অনটন আর কষ্টে নিত্যদিন অবসাদে ভোগা কবি শেরে বাংলার কাছে পাঁচশ টাকা অনুদান চেয়েও পাননি। পাননি নিজের স্ত্রীকে ভালো করার মত পর্যাপ্ত টাকা।
ফিরে আসি তাঁর সৃষ্টিতে। এমন কবি এমন প্রেমিক এমন বেদনা কাতর মানুষের কবিতা বাদ দিবে আমরা মগ্ন আছি উগ্রতায়। কি এক অজ্ঞাত কারণে তাঁর একটি কবিতাকে আমরা করেছি রণ সঙ্গীত। এর মানে কি? কোন দেশে যদি রণ সঙ্গীতের প্রয়োজন হয় ও সেটা কি তাঁর লেখা থেকে নিতে হবে? ভাবখানা এই কেন তিনি কৈশোরে বা যৌবনের শুরুতে সেনাদলে গিয়েছিলেন এখন তিনি সৈনিকের কবি। কাজী নজরুলের বিচিত্র জীবনের বেশকিছু অংশ প্রয়োজনের তাগিদে করা। এটিও তাই। এতে তাঁর যে অভিজ্ঞতা তাকে তিনি সেনারসদ না বানিয়ে কবিতা ও গদ্যের রসদ করেছিলেন। আর আমরা সেটা ভুলে চল চল চল গানটি কে করেছি রণ সঙ্গীত। যেন সবাই মিলে যুদ্ধে যাবো আর এই গান গাইবো একদিন।
সবচেয়ে বড় ভুল তাঁর বিশ্বাস নিয়ে। তিনি রামকৃষ্ণকে নিয়ে যেমন গান বা কবিতা লিখেছিলেন আবার কালীপুজো নিয়ে লিখতেন তেমনি অসংখ্য হামদ নাত আর ইসলামী গানে বর্ণাঢ্য তাঁর সৃষ্টি। তাঁর কাছ থেকেই শুনি :
নজরুল বলেছেন, ‘আমি হিন্দু–মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের কুসংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেব–দেবীর নাম নিই। অবশ্য এর জন্য অনেক জায়গায় আমার সৌন্দর্যের হানি হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি।’ [শব্দ–ধানুকী নজরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা ২৩৬,২৩৭]
এখানে নজরুল স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন হিন্দু–মুসলমানের মিলনের জন্য তিনি এ কাজ করেছেন। তখনকার রাজনৈতিক আবহাওয়া সম্বন্ধে যাদের ধারণা আছে তারা জানেন কি প্রচণ্ড হিন্দু মুসলিম বিরোধ তখন বিরাজমান ছিল।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর রোববার কলিকাতা এলবার্ট হলে বাংলার হিন্দু–মুসলমানের পক্ষ থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বিপুল সমারোহে ও আন্তরিকতা সহকারে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। সেখানে তিনি বলেন, ‘কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি শুধুমাত্র হিন্দু–মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। [নজরুল রচনাবলী – ৮, পৃষ্ঠা ৩, ৫]
বড় কষ্ট পাই। আজকাল তাঁর উদার জীবন মহৎ চেতনা আর অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কেউ কথা বলেন না। পরিচিত কয়েকটি গান আর কবিতাই যেন কাজী নজরুল। অথচ যখন তিনি রুবাইয়া’ এ ওমর খৈয়াম অনুবাদ করলেন তখন অনুবাদক পণ্ডিত কান্তি ঘোষের অনুবাদকেও ছাড়িয়ে গেছিল ভাবমাত্রায়। যে কারণে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।
আর কতদিকে কতভাবে দীপ্র তিনি। বাংলাদেশে ঘোর অমানিশায় পথ দেখানোর কবিকে সংকীর্ণ করে রাখা হয়েছে। নির্বাক চুপ কাজী কবিকে ঢাকায় এনে যেতে দেয়া না দেয়া কবর দেয়ার পেছনে যে আবেগ তার ধারাবাহিকতা কোথায়? তাঁর চেতনা বা তাঁর মেধা ও বিশ্বাস ধারণ করিনা আমরা। রবীন্দ্রনাথের শিল্প বোধ নজরুলের জীবন এদুটো নিতে পারলেই সব কিছু বদলে যেতো। কেউ নেয়নি।
কয়েকটি মিডিয়া পত্র–পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলে একদিনের মাতম বাদ দিলে সারাবছর কোন খবর আছে কারো? দরিরামপুরের সকল আবেগ দড়িতে বেঁধে রেখে উল্লাসে নজরুল হননের কালে ভুল গেছি, এক হাতে তাঁর বাঁশের বাঁশরী আর এক হাতে রণতূর্য।
এখনো চোখের কাজল, কথার কুসুম ডালা আর বেণু বাজিয়ে আসেন তিনি। আসেন একা। বিদ্রোহীর আড়ালে কাতর প্রেমিক ভালোবাসার কবি আসেন ‘রোদন হইয়া তোমার বক্ষে দুলিতে। ‘বুকের ভেতর রাখার কবি গানের বুলবুল নজরুলের জন্মদিনে ভালোবাসা নিরন্তর।’
অজয় দাশগুপ্ত : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
শুক্রবার , ২৫ মে, ২০১৮
Related Articles
সম্প্রচার নীতিমালাঃ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সরকারের করণীয়
সরকার যেসময়ে, যেকারনে, যে অবস্থায় এ নাজুক সম্প্রচার নীতিমালার বিষয়টি নিয়ে এগুচ্ছে এতে করে স্পষ্টতঃই গণমাধ্যমের সাথে সরকারের সংঘাত সৃষ্টির
Canberra Eid-ul-Adha Sunday 11th August
Assalamu Alaikum. Eid day will be Sunday, 11th August 2019, Inshallah. Salat-ul-Eid at Canberra Mosque 8am sharp. Eid Mubarak. From
Thoughts on the Standard of Education in the Private Universities
PREAMBLE : Education is the root cause of development of human society. Among the various stages of education, university education