গৌলগঞ্জ, সাহেব আর রতন – হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির নাম

গৌলগঞ্জ, সাহেব আর রতন – হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির নাম

আমরা বলতাম গৌলগঞ্জ। প্রকৃত নাম হতে পারে – গকুলগঞ্জ। গোপালগঞ্জ হলেও হতে পারে। প্রশন্নপুরের খিলা বাজারে আমাদের বাড়ি। সে খান থেকে দশ পনোরো মিনিটের হাঁটা গৌলগঞ্জ। এই গ্রামটিতে অনেকগুলি জেলে পরিবার ডাকাতিয়ার পাড় ঘেঁষেই বসবাস করে। পোদ্দার, বর্মন , পাল নানান জাতের হিন্দুদের বসবাস এই গ্রামে। কিশোর বয়সে যখন পায়ে হেটে কালীগঞ্জ যেতাম। এই গ্রামের উপর দিয়েই হেঁটে যেতে হতো। যতদূর মনে পড়ে মুসলমান পরিবার খুব বেশি ছিল না। সুন্দর সুন্দর বাগান, বাড়ী, পুকুর – প্রশস্ত, বাড়িতে যাবার সুন্দর রাস্তা গুলো বেশির ভাগই হিন্দুদের ছিল। আজ ভাবলে অবাক হই – ওই সময় – এমন অজ পাড়া গায়ে – এমন পরিপাটি ছবির মতো বাড়ি গুলি – কাদের ভালোবাসার, কাদের স্বপ্নের ছিল? বাড়ি গুলি দূর থেকে দেখলেও মন প্রশান্তিতে ভরে যেতো। যারা তৈরী করেছেন, করিয়েছেন, থেকেছেন ওই বাড়িগুলিতে তাদের কথা বাদই দিলাম।

রতন, রতন পোদ্দার আমার সহপাঠী। গৌলগঞ্জ পোদ্দার বাড়ীর ছেলে। পোদ্দারদের গরম মসলার ব্যবসা। গ্রামের বিভিন্ন হাটে – হাট বারে মসলা বিক্রি করে। বেশ বড়োসড়ো ব্যবসায়ী তাঁরা। সেই প্রথম শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত। খিলা বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় এ ছিলাম রতনের সাথে। উচ্চ বিদ্যালয় এ এসে – মানে ষষ্ঠ শ্রেণীতে এসে আমাকে পাঠানো হলো দেবকরা উচ্চ বিদ্যালয়ে। কয়েক মাসের জন্যে ছিলাম – ভালো না লাগাতে ফিরে এসেছিলাম খিলা বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে।

রতনকে, না দেবকরা স্কুলে, না খিলাবাজার স্কুলে – কোথাও পাওয়া গেলো না। ১৯৭৬ বা ৭৭, জানুয়ারির শেষের দিকে বা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে এক গাদা বই বগলে করে দেবকরা স্কুলে যাচ্ছি। কাচারী বাড়ি পেরিয়ে – পোদ্দারদের বাড়ির সামনে – বড় রাস্তায় দেখলাম – অনেক গুলি পুলিশের গাড়ি। রাস্তা থেকে দেখা যায় – অনেক হাড়ি পাতিল – খাবার সহ – বাড়িতে ঢোকার রাস্তার আসে পাশে – ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। খুব একটা লোকজনও দেখলাম না আসে পাশে। সম্ববত ভয়ে লোকজন নিজের বাড়ি থেকে বেরোনোর সাহস করেনি। একটু দাঁড়িয়ে থেকে স্কুলে চলে আসলাম – পুলিশ দাঁড়াতে দিলো না।

বিকালে স্কুল থেকে ফিরার পথে দেখলাম। পুরা পোদ্দার বাড়ি লণ্ডভণ্ড। মানুষ অনেক দূর দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। বাড়ির উঠোন – সদর দরজা – সব খানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে – ঘরের মালামাল। কাউকেই রাস্তায় দাঁড়াতে দিলো না পুলিশ – বাড়ি ফিরে এলাম।

শুনেছিলাম পোদ্দারদের বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়া হয়েছে – নিজে নিজে না ছাড়লে – উচ্ছেদ করা হবে। তৎকালীন আইজিপি ওই বাড়িটার নতুন মালিক। আইজিপি’র কাছে বিক্রি করলে কিছু টাকা পাবে, নয় তো উচ্ছেদ। শুনেছি পরে পোদ্দার’রা বিশাল বাড়ি, জমি জমা নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করে এক রাতের আঁধারে সবাই ভারত চলে গিয়েছিলেন। তার পর আমার আর রতনের আর কখনো দেখা হয়নি।

তার কিছু দিন পর আবার রাস্তায় পুলিশের গাড়ি। আবার হাড়ি পাতিল রাস্তায়। আলিয়াকাব্বর বা আলী আকবার এর বাড়ি। একেবারে স্থানীয় না। বাবা দাদা’রা ১৯৪৭ এ সম্পত্তি বদল করে আসাম থেকে এই এলাকায় এসেছেন। আসামের যে জায়গা ছেড়ে এসেছেন – তার তুলনায় এখানে পেয়েছেন অনেক অল্পই। তার পরও অনেক জায়গা জমির মালিক আলী একাব্বরের বংশধরেরা। পরিশ্রমী পরিবার,নানা কারণে স্থানীয়দের চক্ষু শুল।

হিন্দু বাড়ির মতোই, প্রথমে বাড়ি বিক্রির আহবান। তার পর – মামলা, হামলা, পুলিশ। শেষে পুরা আলিয়াকাব্বর ফ্যামিলি বিতাড়িত হলো – রামগড়। খাগড়াছড়ির রামগড়ে। প্রথম চার পাঁচ বছর মাঝে মাঝে আসতো বন্ধু, বান্ধব, বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করার জন্যে। আমার সাথে ফুটবল খেলতো একজন – আসলে – আমাদের বাসায় আসতো, আমার সাথে দেখা করতে। তার পর ধীরে ধীরে কমে গেলো আসা। গত কয়েক দশকে আর কখনো দেখিনি তাদের।

কয়েক বছরের মধ্যেই আইজিপি সাহেব বিশাল এলাকার মালিক হয়ে গেলেন। আসে পাশের যত জায়গা, খালি বাড়ি – সব ই – সাহেবদের। সাহেব, মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতেন। একা। দীঘির ঘাটে, সান বাঁধানো ঘাটে বসে নানান মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কিছু দিন থেকে আবার চলে যেতেন। পরিবারের কাউকে আমি কখনো দেখিনি। শুনেছি – তারা খুব একটা আগ্রহীও নয়, এ বাড়িতে আসার জন্যে। মাসের পর মাস খালি পড়ে থাকতে দেখিছি পুরা এলাকা। বাড়ি দেখা শুনার লোকজন বা কর্মচারী বা পাশের পুলিশ ফাঁড়ির লোকজনকে মাঝে মাঝে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি, কখনো সখনো।

এক সময় সাহেবের আসাও বন্ধ হয়ে গেলো। ততদিনে হাজীগঞ্জ থেকে আলাদা হয়ে আমরা হয়ে গেছি শাহরাস্তি থানা। এবং গৌলগঞ্জ হয়ে গেছে নগর – সাহেবের নামে – আহমেদ নগর।

সাহেব আইজিপি ছিলেন ২১ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে ২৬ অগাস্ট ১৯৭৮ পর্যন্ত। সচিব ছিলেন স্থানীয় সরকার বিভাগ, সংসদ সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

মঙ্গলবার, ২১ জুন ২০১৩, সাহেব ৮৪ বছর বয়সে বেইলি রোডের নিজ বাসভবনে দেহ ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে দুই ছেলে, দুই মেয়ে রেখে যান তিনি।

এখন কালে ভদ্রে, যখন এই কাচারী বাড়ির সামনে দিয়ে যাই – খুব অনুভব করি রতনকে। অনুভব করি গৌলগঞ্জকে, অনুভব করি আলিয়াকাব্বর এর পরিবার কে। সাহেব বা তার পরিবার যদি এই বাড়ি গুলিতে থাকতো – তাও হয়তো এই দীর্ঘশাস গুলি এতো দীর্ঘ হতো না।

মানুষের চাওয়া পাওয়ার সীমানা – অত্যাচারী রিপু’র তাড়না – অনেক সময় তার শিক্ষিত বিবেকেও বিভ্রান্ত করে ফেলে।

Khila Bazar, Puddar Bari Map link here…

Shahadat Manik

Shahadat Manik

Writer, poet, lyricist and social activist.


Place your ads here!

Related Articles

প্রবাসে আমাদের শিশুরা

মাঝে মাঝেই ভাবি, দেশ ছেড়ে সুদূর এই বিদেশে এসে আমাদের থাকবার প্রধান কারনই হচ্ছে বুঝি ছেলেমেয়েদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত তৈরি করা।

Agun na Golap

আগুন না গোলাপ? -ড. ফরিদ আহমেদ ড. কামাল হোসেন, বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকী,অলি আহমেদ এবং আরোও অনেকে বলছেন দেশ সংঘাতের

Climate Change, Food and Energy Security: Bangladesh Context

While climate change is slowly and surely affecting agricultural production in Bangladesh, the fear is growing by the reports that

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment