বই পড়ি, পত্রিকা পড়ি, সুন্দর হই
আনিসুল হক, ঢাকা: আপনার সন্তানের হাতে যন্ত্র নয়, বই তুলে দিন। বাড়িতে দৈনিক পত্রিকা রাখুন। আপনার কিশোর সন্তানের হাতে বই তুলে দিন, আর তুলে দিন কিশোরদের উপযোগী পত্রিকা (একটার নাম আমি বলতে পারি—কিশোর আলো)। এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো এত নেতিবাচক বিষয়ে আকীর্ণ যে শ্বাস রোধ হয়ে আসে। চারপাশের দরজা-জানালাগুলো খুলে দিন, আমরা একটু বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিতে চাই। দৈনিক খবরের কাগজ আর বই হলো সেই জানালা।
পশ্চিমা দেশগুলোতে ভাবা হয়েছিল, ই-বই জনপ্রিয় হতে থাকবে, আর কাগজে ছাপা বই যাবে উঠে। কিন্তু গত কয়েক বছরে উল্টোটাই ঘটতে শুরু করেছে। গার্ডিয়ান ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল লিখেছে, পুস্তক প্রকাশকদের সংগঠনগুলোর হিসাবে ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যে ই-বইয়ের বিক্রি কমেছে ১৭ শতাংশ। আর কাগজের বইয়ের বিক্রি বেড়েছে ৮ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে এই অনুপাত ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ ও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কোয়ার্টজ ম্যাগাজিনে নাতাশা ফ্রস্ট লিখছেন, ২০১৮ সালে আমেরিকা আর ইউরোপ দুই মহাদেশেই ছাপা বইয়ের বিক্রি বেড়েছে। এবং ২০১৩ সালের পর কাগজে ছাপা বই বিক্রি করার দোকানের সংখ্যা বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।
পশ্চিমে অনেক ছাপা সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এশিয়ায় বিক্রি বেড়েছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতে স্থানীয় ভাষার পত্রিকাগুলোর বিক্রি বেড়ে চলেছে।
রেডিও আবিষ্কার হলো, সিনেমা এল, টেলিভিশন এল—প্রতিবার মনে করা হলো, এবার ছাপা কাগজের দিন শেষ। শেষতম ঢেউ হলো অনলাইন, ইন্টারনেট, ই-বুক। প্রথম যখন বই পড়ার যন্ত্র কিন্ডল রিডার এল, কিন্ডল বয়ে বেড়ানোটাকে ভাবা হলো স্মার্টনেস। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মানুষ ফিরে আসছে সেই চিরপুরাতন সঙ্গী বইয়ের কাছে। বহু গবেষণায় দেখা গেছে, ইলেকট্রনিক যন্ত্রের পর্দায় মানুষ যা পড়ে, তা মনে রাখতে ততটা পারে না; মানুষ বেশি স্মরণে রাখতে পারে ছাপা কাগজে পড়া বিষয়। ইলেকট্রনিক যন্ত্রের সঙ্গে বেড়ে ওঠা শিশুদের মস্তিষ্কের ওপর এর প্রভাব নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা হচ্ছে। সবাই বলছে, ছাপা পত্রিকা, ছাপা কাগজের বই উত্তম। ইতালির বিখ্যাত লেখক আমবার্তো ইকোর ভাষায়, বই হচ্ছে চামচ, কাঁচি, চাকা, হাতুড়ির মতো—একবার আবিষ্কৃত হয়ে গেলে এটাকে আর উন্নত করার অবকাশ নেই।
আর খবরের উৎস হিসেবে ছাপা কাগজের কোনো তুলনা নেই। ভারতের খবরের কাগজগুলো একযোগে পুরো পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন ছেপেছিল, ‘প্রিন্ট ইজ প্রুফ। ছাপা খবর মানে প্রমাণ। তা বিশ্বাসযোগ্য। আর অনলাইনে কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা—আলাদা করা যায় না। ছাপা কাগজের কাজ শুরু হয় প্রমাণাদি হাতে পাওয়ার পর, আর অনলাইনের কাজ হলো চাঞ্চল্য তৈরি করা। আর তাদের দ্রুত ব্রেকিং নিউজ দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। ফলে খবরটা আদৌ সত্য কি না, যাচাই করা হয়ে ওঠে না। তারা প্রথমে খবর প্রকাশ করে, অনেক সময় পরে যাচাই করে। যদি দেখে খবরটা ভুল, তাহলে তা প্রত্যাহার করে। কিন্তু ছাপা কাগজের সেই সুযোগ নেই। প্রমাণ পাওয়ার পরই কেবল কাগজে খবর ছাপা হয়। ফলে, কোনো খবরের কাগজ হাতে নিয়ে আপনি বলতে পারেন, এই যে আমার হাতে প্রমাণ আছে। প্রিন্ট ইজ প্রুফ।’
অসত্য খবরের প্লাবনের এই সময়ে আমাদের ফিরে আসতেই হবে ছাপা সংবাদপত্রের কাছে। বাংলাদেশে যেমন মানুষ জানতে চায়, প্রথম আলো কী খবরটা দিয়েছে? একজন তারকা মারা গেছেন, ক্রিকেটার তাসকিনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে—ছড়িয়ে পড়ল অনলাইনের খবর। মানুষের প্রশ্ন, প্রথম আলো কী খবরটা দিয়েছে? তেমনিভাবে খবরটা অনলাইনের, নাকি খবরের কাগজের, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আজ বাংলাদেশে কী যে অস্থিরতা! কিশোরেরা গ্যাং তৈরি করছে। জড়িয়ে পড়ছে হাঙ্গামায়, খুনোখুনিতে। ওরা যদি ছোটবেলা থেকে সংবাদপত্র পড়ত, কাগজের বই হাতে পেত, অপরাধী হতো না। সারাক্ষণ অনলাইনে থাকি, মন দিয়ে কোনো কিছু দেখি না, পড়ি না, ভাবি না। চিত্ত শুধুই চঞ্চল। তারই পরিণতি এত এত অপরাধ, গুজবের দাবানল, পিটিয়ে মানুষ হত্যা।
কমলকুমার মজুমদারের গল্প থেকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একটা সিনেমা বানিয়েছিলেন, নাম হলো নিম অন্নপূর্ণা। সেই ছবির শুরুতে বলা হয়, অমুক ভদ্রলোক। কারণ, তাঁরা বাড়িতে দৈনিক পত্রিকা রাখেন।
বাড়িতে খবরের কাগজ রাখা মানে রুচি আর সংস্কৃতির পরিচয় দেওয়া। সাভারের একজন প্রধান শিক্ষক একবার বলেছিলেন, যখন কোনো বাড়িতে গিয়ে দেখি, তাঁরা প্রথম আলো রাখেন, তখন বুঝি, সংস্কৃতিমান বাড়িতে এসেছি, তাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যাবে। যদি কেউ বাড়িতে বিজ্ঞানচিন্তা রাখে, কিশোর আলো রাখে, তাহলে বোঝাই যাবে এই বাড়ির কিশোর-তরুণেরা অগ্রসর। আশা করা যায়, তারা আলোকিত হবে।
যে তরুণ ছাপা কাগজ পড়ে, সে-ই স্মার্ট। বিসিএস পরীক্ষাতেও সে-ই ভালো করবে। কারণ, রোজ রোজ পত্রিকা পড়ে সে সেটা ধাতস্থ করেছে।
ভার্চ্যুয়াল জগৎ মানে বিভ্রমের জগৎ, ও আছে কি নেই, আমরা জানি না। মাকে ফেসবুকে শুভেচ্ছা জানানো, আর মায়ের আঁচলে নিজের মুখ মোছা, দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। মা খুশি হবেন দ্বিতীয়টায়। কারণ, দ্বিতীয়টা বাস্তব সত্য, দ্বিতীয়টায় মায়ের স্পর্শ লেগে থাকবে। তেমনিভাবে কাগজের বই আর পত্রিকার জগৎটা বাস্তব ব্যাপার। ওটা আছে এবং তাতে মুদ্রিত খবরগুলোকেও বাস্তবে থাকতে হয়। সত্য হতে হয়। তাই ভুল সংবাদ বা ফেক নিউজ ছাপা কাগজে ঠাঁই পাওয়ার সুযোগ কম।
কাগজ পড়া, বই পড়া মানুষ মানে সুন্দর মানুষ; যাঁরা জীবন, সমাজ ও দেশটাকে সুন্দর করবেন, সুন্দর করবেন পৃথিবীটাকে।
Related Articles
প্রতিক্রিয়া: প্রতিতীর রাবীন্দ্রিক বর্ষবরন
আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই বাংলার আচার অনুস্ঠানে। আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই যে কোন বাংলা গানের জলসায়! আমি আবেগে
Political party branch offices overseas; Doing the expatriate population more harm than good
IT is typical of Bangladeshi expatriates that they often take their home-spun feuding abroad with reckless abandon. They open and
Mother's day special : Women in '71
একাত্তরে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ ১৯৭১ সালে নারীর বিরুদ্ধে যে বিভৎস নির্যাতন চালানো হয়েছিল তা মানব ইতিহাসে বিরল। নারীর প্রতি অত্যাচারে