মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে তিন ভাই – আবু সালেহ রনি
মনজুরুল আহসান খান, কামরুল আহসান খান ও খায়রুল আহসান খান_ তারা তিন ভাই। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত যৌথ বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সশস্ত্র যোদ্ধা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পাশে শান্তিনগর এলাকার চামেলীবাগে তাদের বাড়ি।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানিদের হামলা শুরু হলে তাদের বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন ভীতসন্ত্রস্ত ও আহত শতাধিক পুলিশ সদস্য। পরে পুলিশের রেখে যাওয়া অস্ত্র নিয়েই তিন ভাই ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর হাতে বাহাত্তর সালের ৩০ জানুয়ারি তারা ঢাকা স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমর্পণ করেন।
একাত্তরে মনজুর ছিলেন উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান রূপসী বাংলা) শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এবং কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা ট্রেড ইউনিয়ন সাব-কমিটির সম্পাদক। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে বৃহত্তর ঢাকা, নোয়াখালী, কুমিল্লা এলাকা নিয়ে গঠিত ডেল্টা সেক্টরের সামরিক কমান্ডারও ছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান বলেন, ‘একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে আন্দোলন-সংগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহতদের জন্য আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছিলেন। আমরা শ্রমিকরা তখন কিছু চাঁদা তুলে মার্চের মাঝামাঝি একদিন বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যাই। তবে তার আগে থাকতেই যাবতীয় আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলাম।’ তিনি ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘২৫ মার্চ রাতে ঢাকার আরও সব এলাকার মতো রাজারবাগের পুলিশ লাইনেও শেলিং শুরু হয়। ভয়ঙ্কর গোলাগুলি, চিৎকার, শেল এসে পড়ছিল আমাদের বাড়ির চারদিকে। পুলিশ সদস্যরা দলেবলে অস্ত্রসহ আমাদের বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমি, কামরুল, খায়রুলসহ পরিবারের সবাই পুলিশ সদস্যদের পোশাক পরিবর্তন, চিকিৎসাসহ তাদের পালাতে সহায়তা করি। তখন অনেক পুলিশ কিছু অস্ত্র আমাদের বাসায় লুকিয়ে রেখে যায়। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে আমি, আলাউদ্দিন ভাই, মমতাজ ভাই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, শ্যামপুর ও পোস্তগোলায় শ্রমিকদের সংগঠিত করার চেষ্টা চালাই। আমাদের তখনকার ক্যাম্পটি ছিল শ্যামপুরের উল্টো দিকে আইনতা এলাকায়। যুদ্ধের আগেই আমার বিয়ের তারিখ নির্ধারিত ছিল। তাই বাসায় দেখা করতে এসেছিলাম, তবে বিয়ে তখন আর করা হয়নি। এর মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির নেতা জ্ঞান চক্রবর্তীর একটি চিরকুট পেলে আমি গাইডের সহযোগিতায় মেরাদিয়া চলে যাই। সেখান থেকে সম্ভবত এপ্রিলের মাঝামাঝি পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম, খোকা রায়সহ অন্যান্য নেতার সঙ্গে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ক্রাফট হোস্টেলে পেঁৗছাই। সেখানে আমাকে গেরিলা বাহিনীর সদস্য বাছাই, ক্যাম্প পরিদর্শন, মতবিনিময় সভাসহ যুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ড পালন করতে হয়। এর পর জুলাই-আগস্টে তেজপুরে দ্বিতীয় ব্যাচে চারশ’ যোদ্ধাকে নিয়ে শুরু হয় আমাদের গেরিলা প্রশিক্ষণ। দ্বিতীয় ব্যাচের কমান্ডার ছিলাম আমি এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য চট্টগ্রামের শাহ আলম ও কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান উপদেষ্টা রংপুর অঞ্চলের শাহাদাত হোসেন। সেপ্টেম্বরে মূল প্রশিক্ষণ শেষে নেফাতে আমাদের কয়েকজনকে গেরিলা কমান্ডো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর পর ১১ নভেম্বর বেতিয়ারায় গেরিলা বাহিনীর নয় যোদ্ধা শহীদ হলে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম দিয়ে দ্বিতীয় ব্যাচের চারশ’ যোদ্ধাকে দেশে প্রবেশ করানো হয়। এর মধ্যে ডেল্টা সেক্টরের কমান্ডার ছিলাম আমি। দেশে প্রবেশ করে বাংলাদেশ-ভারতের মিত্র ও অন্যান্য বাহিনীর সহযোগী হিসেবে ৬ ডিসেম্বর ফেনী, ৭ ডিসেম্বর নোয়াখালীর পানিয়ালা গ্রামে যুদ্ধ করে চাঁদপুর থেকে নৌকায় ১৪ ডিসেম্বর নরসিংদীর রায়পুরায় এসে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের ক্যাম্পে অবস্থান নিই। এ সময় শাহ আলম একটি গ্রুপ নিয়ে চট্টগ্রাম ও শাহাদাত হোসেনের একটি গ্রুপ রংপুরের দিকে চলে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পেলে ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় বাসায় এসে পেঁৗছাই।’
কামরুল :একাত্তরে সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাস করা কামরুল আহসান খান বলেন, ‘স্কুল থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন ও নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। একাত্তরের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে আমাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়। আমি আগে স্কাউট করতাম, তাই আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় দলের লেফট-রাইট করানোর। ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হওয়ার কিছু আগে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী বাদল, মজনু, ছোটভাই খায়রুল, শাহীনসহ কয়েকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকায় স্থানীয় মানুষের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক ঠেকাতে রাস্তায় ব্যারিকেড দিই। পাকিস্তানিদের তীব্র আক্রমণে প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে খায়রুল ও আমি তখন চামেলীবাগে নিজেদের বাসায় এসে পড়ি। এলাকায় এসে দেখি, আমাদের বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে পুলিশের অনেক সদস্য আশ্রয় নিয়েছেন। তারা লুকিয়ে রেখে যান অস্ত্রশস্ত্র।’
কামরুল বলেন, ‘২৫ মার্চের কয়েক দিন পর আমরা সেসব অস্ত্র কাপড়চোপড় দিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে শহীদবাগ হয়ে ত্রিমোহনী যাই। ত্রিমোহনী ছিল ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের ঘাঁটি। সেখান থেকে নরসিংদীর রায়পুরায় যাই। তবে একদিন পরেই আওয়ামী লীগ নেতা ফকির শাহাবুদ্দিনকে (স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল) নিয়ে যেতে ফের ত্রিমোহনী আসতে হয়। সেখান থেকে ডা. শাহাদাত হোসেন ফকির ও শাহাবুদ্দিনকে নিয়ে সোনারগাঁ হয়ে ভারতের ক্রাফট হোস্টেল ক্যাম্পে পেঁৗছাই। এটাই তখন পার্টির ক্যাম্প। ক্যাম্পে দু-একদিন থাকার পর গেরিলা যোদ্ধা সংগ্রহে আমাদের কয়েকজনকে ফের ঢাকায় আসতে হয়েছিল। ঢাকায় আসার পর পার্টি থেকে বলা হলো, উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেনকে ভারতে নিয়ে যেতে হবে। সত্যেনদা তখন খুব অসুস্থ; মুন্সীগঞ্জের ষোলঘরে গ্রামে ছিলেন। আমি আর শাহাদাত ইছাপুর লঞ্চঘাটে যাই। সেখান থেকে দাদাকে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নজর এড়িয়ে হেঁটে কুমিল্লায় এক বাড়িতে পাঁচ-ছয় দিন থেকে ভারতে পার্টির ক্যাম্পে পেঁৗছাই। লঞ্চঘাটে তখন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এর পর একাত্তরের ২৮ মে তেজপুরে দুইশ’জনকে নিয়ে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ দিতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা। প্রশিক্ষণে প্রথম ব্যাচের কমান্ডার ছিলেন ওসমান গনি। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার। জুলাইয়ের শেষ দিকে আমরা ফিরে আসি ত্রিপুরার বাইখোড়া ক্যাম্পে। সেপ্টেম্বরে ইনডাকশন শুরু হলে প্রচুর গোলাবারুদ, অস্ত্র নিয়ে গ্রুপ করে আমরা দেশে ঢুকে পড়ি। আমরা ২৫ থেকে ২৬ জনের একটি টিম সন্ধ্যার পর সীমান্ত অতিক্রম করে, রাতে কুমিল্লার একটি গ্রামে ঘাঁটি গাড়ি। পরদিন আমরা নৌকাযোগে সরে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে বহনকারী একটা লঞ্চের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানিরা দু-এক রাউন্ড গুলি ছুড়লে আমরা নৌকা থেকে নেমে দ্রুত অন্য একটি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিই। সেখানে শ্রমিক নেতা শহীদুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি গেরিলা গ্রুপের গাইড হিসেবে কাজ করছিলেন। তার পর আমরা গ্রুপ নিয়ে মনোহরদী আসি এবং অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে দ্রুত অ্যাকশন নেওয়া শুরু করি। মনোহরদীতে থাকাবস্থাতেই বেতিয়ারা যুদ্ধের খবর পাই। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পেলে ডেমরা ঘাট হয়ে ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় এসে শহীদ মিনারে সমবেত হই।’
খায়রুল :মাত্র ১৭ বছর বয়সে খায়রুল আহসান জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। একাত্তরের জুনের প্রথম দিকে সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন (শহীদ), হারুনসহ কয়েকজনের সঙ্গে কুমিল্লার সীমান্ত দিয়ে আগরতলার ক্রাফট হোস্টেলের ক্যাম্পে ওঠেন। এর পর বরদুয়ালী ক্যাম্প হয়ে তেজপুরে তৃতীয় ব্যাচে গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কমান্ডার ছিলেন প্রয়াত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মর্তুজা খান। প্রশিক্ষণ শেষে ত্রিপুরার বাইখোড়া বেজ ক্যাম্পে থাকাবস্থায় নভেম্বরের মাঝামাঝি কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের প্রথম ব্যাচে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
প্রতিক্রিয়া :মুক্তিযোদ্ধার সনদ প্রসঙ্গে মনজুরুল আহসান খান বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। স্বীকৃতি বাতিলের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চরম অবমাননাকর।’ অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কামরুল আহসান খান (বর্তমানে দেশে) বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। এতদিন সনদ চাইনি। এখন পার্টির সিদ্ধান্তে যখন সনদ চাওয়া হয়েছে, তখন সেটা দিতেই হবে। অন্যথায় সংশ্লিষ্টদের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে।’ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবসায়ী খায়রুল আহসান বলেন, ‘গেরিলা বাহিনীকে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট জারির পর তা বাতিলের মাধ্যমে সরকার সংশ্লিষ্টদের লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। দ্রুত এর সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।’
Original source at http://www.samakal.net/2015/03/08/123273
আমার নাম খায়রুল আহসান খান। আমাকে নিয়ে যে রিপোর্ট করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে আমার সাথে সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আগরতলায় গিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন এর ছেলে শামিম রেজানুর আমার সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আগরতলায় গিয়েছিলেন ।