আততায়ীর সঙ্গে পুলিশের এই লুকোচুরি খেলা…আর কতো?

লুৎফর রহমান রিটন
রাজিব-অভিজিৎ-ওয়াশিকুর-অনন্ত-নীলাদ্রির পর ফয়সল আরেফিন দীপন। লাশের মিছিল দীর্ঘ। ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের এই চলমান প্রক্রিয়ায় আততায়ীর সঙ্গে চলছে উটপাখি সদৃশ্য পুলিশের লুকোচুরি খেলা। ফলাফল বিচারহীনতা। সাসপেক্টের অনায়াস জামিন প্রাপ্তি এবং পুনরায় আরেকটি হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার কারণে পুনঃগ্রেফতারের খবর। নেপথ্য কারণ–মন্ত্রীর ভ্রাতুষ্পুত্র। মুক্তবুদ্ধি-মুক্তচিন্তার ব্লগার-চিন্তক-লেখক থেকে এবার প্রকাশক। হ্যাঁ, অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক। আপাতত এটাই মূখ্য কারণ দীপনের অকাল মৃত্যুর। দীপনের প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতি থেকে বেরিয়েছিলো অভিজিৎ রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’। সুতরাং টার্গেট আততায়ীর। অভিজিতের লেখা বইয়ের প্রকাশক হবার অপরাধে শুদ্ধস্বরের টুটুলকেও হত্যার জন্যে নিখুঁত ছকে অফিসে ঢুকে একই পদ্ধতিতে আক্রমন। টুটুলের সঙ্গে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত লেখক রণদীপম বসু এবং কবি তারেক রহীম। দীপন-টুটুল-তারেক এবং রণদীপম প্রত্যেকেই আমার বিশেষ প্রীতিভাজন। বন্ধু। দীপন চলে গেছে। বাকি তিনজন লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে।
আমরা শোকার্ত। বেদনার্ত। দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন তিনি পুত্র হত্যার বিচার চান না। একজন পিতা কখন এইরকম একটা কথা বলতে পারেন? এটা বুঝবার ক্ষমতাও আমাদের নেই। আওয়ামী লীগের সাবেক ভাঁড়প্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বাকোয়াজ হানিফ বলে উঠলেন–”হত্যাকারীদের আদর্শে বিশ্বাসী বলেই পুত্র দীপন হত্যার বিচার চাননি বাবা আবুল কাসেম ফজলুল হক।…একজন পুত্রহারা পিতা সন্তানের হত্যার বিচার চায় না, এটা বাংলাদেশে প্রথম। পৃথিবীতেও এমনটা আমি দেখিনি।… যে পুত্র হত্যা হয়েছে তার বাবা অধ্যাপক সাহেব হয়ত ওই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী।…..এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত উনার দলের লোকজনকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান না বলেই তিনি এ ধরনের কথা বলেছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জাজনক।”
ভেবে অবাক হই হানিফের মতো একটা কাঠবলদ আওয়ামী লীগ নামের এতো বড় একটা ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের ভাঁড়প্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন! তার অবয়ব কথাবার্তা আর আচরণে তাকে মফস্বলের টং-এর চায়ের দোকানে দৈনিক পত্রিকা হাতে বয়ানরত একজন অশিক্ষিত গ্রাম্য মাতব্বররের অধিক কখনোই মনে হয় নি।
ঘাতকের চাপাতির আঘাতে নিহত হয়েছিলেন অভিজিত। অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অজয় রায় তাঁর পুত্র হত্যার বিচার চেয়েছিলেন। পেয়েছেন? পাননি। রাজিব-ওয়াশিকুর-অনন্ত-নীলাদ্রির স্বজনরা বিচার পেয়েছেন? পাননি। তাহলে? এই ধারাবাহিকতায় সদ্য পুত্রহারা একজন পিতা রাষ্ট্র-সমাজ-সরকার কিংবা আদালতের প্রতি ক্ষোভ থেকে পুত্রহত্যার বিচার চাই না বলতেই পারেন। পুত্রহারা পিতাকে সান্তনা বা সহমর্মিতা বা সমবেদনা জ্ঞাপন না করে চোখে শোকের অশ্রু শুকানোর আগেই বিচার না চাওয়ায় নিহতের পিতাকে ঘাতকদের সমর্থক বলাটা কোন শিষ্টাচারের আওতায় পড়ে? ছিঃ।
জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমার চরম দুর্ভাগ্যপীড়িত বলেই মনে হয়। তা না হলে এরকম একজন অমার্জিত অসংস্কৃত নিম্নরুচির অর্বাচীনকেও তাঁর পাশে ঠাঁই দিতে হয়!
আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন ”খুনিদের খুঁজে বের করতেই হবে। স্বাধীনতার পক্ষের সবাইকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে।” বাচাল হানিফের উচিৎ তারূণ্যের প্রতিনিধি শাহরিয়ার আলমদের কাছ থেকে সভ্য মানুষের কথা আচরণ আর দায়িত্বশীলতার ট্রেনিং নেয়া।
দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছিলেন–”এই হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক।…হত্যাকারীদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই…আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই না…যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে ‘রাজনীতি’ করছেন তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।”
বাকোয়াজ হানিফের অর্বাচীন উক্তির পর দীপনের বাবা আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, ”আমি বিচার চাই না, গতকাল আমি এই কথাটি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলিনি। আমার একটি বিবেচনা আছে। সেই অনুযায়ী বলেছি। যদি দেশের ভেতর শুভবুদ্ধির উদয় হয় তাহলেই সমস্যার সমাধান হতে পারে। বিচার দিয়ে, আইন দিয়ে আমরা একজনকে শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু জাতির উন্নয়ন দরকার। এজন্যই আমি গতকালকে এই কথাটি বলেছি। রোববার (১ নভেম্বর) দুপুর সোয়া ১২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলের মরদেহ নিতে এসে সাংবাদিকদের সামনে এসব কথা বলেন। তিনি বলেছেন–আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নিয়ম অনুযায়ী একটা মামলা করবো। ঢাবি কর্তৃপক্ষ আমাকে একটা আবেদন লিখে দিতে বলেছে, সেটা আজ না হয় কাল দেবো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি এইটার উপর নির্ভর করি।…আমি শুভ বুদ্ধির জাগরণ চাই। সমাজে, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে।”
দীপন শুধু অভিজিতের বইয়ের প্রকাশকই ছিলো না। দীপন আর অভিজিত ছিলো বাল্যবন্ধু। দু’জনার বাবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সেই সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আবাসে পাশাপাশি বাড়িতে বড় হয়েছে ওরা দু’জন। । দীপন আর অভিজিৎ দুজনেই উদয়ন স্কুলে পড়েছে, একই ক্লাশে। অভিজিতের নির্মম মৃত্যুর মাসখানেক পর দীপনের হৃদয় মোচড় দেয়া একটা স্ট্যাটাস পড়েছিলাম। ২৭ মার্চ ২০১৫ ফেসবুকে দীপন লিখেছিলো–”একটা মাস আগে কাছাকাছি একটা সময়ে গিয়ে দাড়িয়েছিলাম ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে। গ্রিলের সামনে দাড়িয়ে দেখছিলাম প্রিয় বন্ধুর সাদা চাদরে ঢাকা নিথর দেহটা। চাবি হাতে দ্বাররক্ষক প্রশ্ন করেছিল, স্যার ভেতরে গিয়ে দেখবেন? বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে ওঠা আবেগ চাপা দিয়ে বলেছিলাম, দেখবো। তালা খুলে ভেতরে ঢুকতে দেয় আমাকে। মাথার পেছন পাশটা অনেকটা উচু হয়ে আছে ব্যান্ডেজের নিচে। একটা চোখ আধখোলা। ট্রলির নিচে জমা রক্ত।
যে মানুষটা গল্প আড্ডায় মেতে ছিল আগের দিন আমার অফিসে, একেবারে ছোটবেলা থেকে একসাথে এক এলাকায় বেড়ে উঠেছি যার সাথে, খেলাধুলা করেছি, পড়ালেখা করেছি একই স্কুলে, যার বই প্রকাশ করেছি সানন্দে- মুক্তমতের প্রতিষ্ঠায়, সেই অভিজিৎ রায় আমাদের প্রিয় গুল্লুর চলে যাওয়ার এক মাস পূর্ণ হলো। আমার কানে শুধু বাজে আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ‘সাবধানে থাকিস’ বলার পর ওর উত্তরটা। ‘তুই ভয় পাস না, আমাদের কিচ্ছু করতে পারবে না’…।”
আহারে নিয়তি! শেষমেশ ওদের দুজনেরই ঠাঁই হলো কী না সেই একই মেডিকেলের একই মর্গে!
দীপনের বাবা বলতেই পারেন তিনি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চান না। কিন্তু আমরা চাই। মুক্তবুদ্ধি-মুক্তচিন্তার আলোর পথের যাত্রীদের নৃশংস হত্যা ও হত্যা প্রচেষ্টার বিচার চাই। অন্ধকারের বিনাশ চাই। চাই শুভবুদ্ধির জাগরণ।
লুৎফর রহমান রিটন
০১ নভেম্বর ২০১৫
Related Articles
Bangladeshi Musa conquers Everest
Anxious wait for official confirmation on first-ever feat of a Bangladeshi Musa Ibrahim has scaled Mount Everest as the first
The pardoning president
Mohammad Badrul AhsanThe president has pardoned again. A forgiving man has forgiven now because he has also forgiven before. A
Let us rethink and try different paths
A recent news item published in The Prothom Alo in Dhaka caught my attention. In a joint statement forty one