দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় এবং রাষ্ট্রীয় দায়
দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় এবং রাষ্ট্রীয় দায়
সূচনাঃ
বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রই অন্য কোন রাষ্ট্রের চির বন্ধু কিংবা চির শত্রু নয়। স্বার্থ ছাড়া একটি রাষ্ট্র, আরেকটি রাষ্ট্রকে সাহায্য খুব কমই করে – কখনো করেছে বলেও উদাহরণ হিসেবে কেউই দিতে পারবেনা। অনেকে বলতে পারেন – কোরিয়ান যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার পক্ষে চীনের অংশগ্রহণ। মাওয়ের সেই অফিসিয়াল উক্তি “উত্তর কোরিয়াকে সাহায্য না করা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক হবে” বেশি প্রচার হলেও , মূল ব্যাপার হচ্ছে কোরিয়ার যুদ্ধ ছিল চীনের কম্যুনিস্টদের অস্তিত্বের লড়াই।
১৭৭৬ – ১৯৮৩ সালে আমেরিকা ছিল, ব্রিটিশ-ফ্রান্সের গ্লোবাল লড়াইয়ের একটি থিয়েটার। ১৯৭১ সালের বাংলাদেংলশও তেমনি, আমেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়ার জন্য তাদের নিজেদের মধ্যর গ্লোবাল কনফ্লিক্টের একটি থিয়েটার। আমেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়ার স্থানীয় প্রতিনিধি ছিল পাকিস্তান এবং ভারত। তবে ভারত, পাকিস্তান এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য নিশ্চিত ভাবে এটা একটা নিয়ামক ছিল – এসবই পশ্চিমা পয়েন্ট অফভিউ। সবাই ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে কম বেশি জানেন – প্রথমবার ফ্রান্সের বিরুদ্ধে, এর পর আমেরিকার বিরুদ্ধে; তবে এরপর আরও দুটো বৃহৎ যুদ্ধ/সামরিক অপারেশন করতে হয়েছিল – একটি কম্বোডিয়ার সাথে অপরটি চীনের সাথে। চীনের সাথে ??? যারা কিনা আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভিয়েতনামকে সহায়তা করে গিয়েছে!! – – এটা শুধু আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতার একটি উদাহরণ – যা এই লেখার স্কোপের বাহিরে।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত এবং সোভিয়েত রাশিয়া যা করেছিল, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ফ্রান্স একাই সেই কাজটি করেছিল – অর্থাৎ টেক্টিক্যাল এবং স্ট্রাটিজিক দুটি সহায়তাই একসাথে করা। স্বাধীনতা সবসময় মুদ্রার এপিঠ এবং ওপিঠ। যতক্ষণ স্বাধীনতা পাওয়া যাবেনা ততক্ষণ বিচ্ছিন্নতাবাদী – একবার স্বাধীনতা অর্জন করে ফেললে আস্তে আস্তে সবাই স্বীকৃতি দেবে কিংবা নীরবতার মাধ্যমে স্বীকার করে নেবে। বাংলাদেশও কৌশলগত কারণে বেশ কয়েকটি দেশকে স্বীকৃতি দেয়নি (আরও সরাসরি বললে ২০১৪ পর্যন্ত ১৪ টি ডি ফ্যাক্টো স্বাধীন দেশকে বাংলাদেশ স্বীকার করেনা), এরমধ্য মুসলিম দেশও আছে। মৌলানা ভাসানি যখন স্বাধীনতার আহবান জানান তাঁর বিখ্যাত “সালাম” এর মাধ্যমে তখন আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব আরও কিছুদিন সময় নিতে চেয়েছিলেন।
রাষ্ট্রকে সহসা একটি বৃহৎ পরিবারের সাথে তুলনা করা হয়। কেননা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজ একটি পরিবারের সাথে সম্পর্কিত – বাজেট, কাজের বণ্টন, অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ। তেমনি – রাষ্ট্রের গোপন কাজগুলো মানুষের যৌন জীবনের ন্যায়। পর্ণ ছবির তারকারা ছাড়া অন্য কারও যৌন জীবন প্রকাশ্য আসলেই ছি ছি পরে যায় – কতভাবে – কত বৈচিত্রে যৌন চাহিদা মানুষ মেটায় এটা ভেবে – অথচ কেউই এটা থেকে মুক্ত নয়। অনেকে বাহির থেকে আরেকজনের যৌন জীবন নিয়ে হাসি তামাশা করলেও নিজে সে ভাল করেই জানে তারটা কম নয়- বরং ক্ষেত্র বিশেষে আরও বেশি। এটা অন্যদের জন্য ডার্টি কিন্তু সবার নিজের জন্য প্রয়োজনীয়। স্নোডেন কর্তৃক ফাঁসকৃত আমেরিকার “প্রিজম” প্রোগ্রাম নিয়ে অনেকের চোখ কপালে উঠলেও – সত্য হচ্ছে এটা মূল কাজের খুবই ক্ষুদ্র অংশ।
রাষ্ট্রের এসব “ডার্টি” কাজ করার দায়িত্ব গোয়েন্দা বিভাগের – অনেকে তাদের বলতে পারেন গুপ্তচর কিংবা টিকটিকি – তবে রাষ্ট্রের টিকে থাকার জন্য তাদের অবদান অনস্বীকার্য। এর প্রয়োজনীয়তা দুই হাজার বছর আগে ভারতের কোটিল্য এবং চীনের সান জু লিখে গিয়েছিলেন।
শত্রুর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির সাথে সাথে – সহযোগীর উপর গোয়েন্দাগিরি, প্রতিযোগীর বিরোধীদের দমনে সহায়তা আবার প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরোধীদের সহায়তা প্রদান খুবই স্বাভাবিক এবং তা সবই হয় রাষ্ট্রের স্বার্থে। হয়ত প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য হয়ত সরাসরি কিংবা হয়ত সরাসরি ভাবে নয়। হয়ত ফার্স্ট হ্যান্ড হয়ত ফোর্থ কিংবা ফিফথ হ্যান্ড।
এই দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা ব্যাপারটাও সে রকম।
ধারনাঃ
একটা উক্তি মনে পরছে – আমেরিকার এনএসএ এর সাবেক প্রধান – এডওয়ার্ড স্লোডেন ধরা পরার পর বলেছিলেন যে “চাইনিজরা স্লোডেন থেকে যদি বিভিন্ন প্রকার গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে না পারে তাহলে আমি তাদের (চাইনিজ গোয়েন্দা) দের প্রতি সম্মান হারাবো”। সম্মান হারাবার কোনই প্রয়োজন নেই – চাইনিজরা স্নোডেন হতে এক বিট তথ্যও না নিয়ে থেকে তাকে রাশিয়ায় পাচারে সহায়তা করেনি – আমেরিকা এটা ভালো ভাবেই জানে।
যদি আসলেই এমন হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের কিংবা তিব্বতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে ভারতের কোন যোগাযোগ নেই কিংবা কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে পাকিস্তানের যোগাযোগ নেই তাহলে আমিও “আইএসআই” এবং “র” এর প্রতি সম্মান হারাবো (কার্যকর গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান হিসেবে)। একই ভাবে সত্য – আমেরিকার সিআইএ, জার্মানির বিএনডি, যুক্তরাজ্যর এসআইএস, ফ্রান্সের ডিজিএস, রাশিয়ার এসভিআর কিংবা চীনের এমএসএস কিংবা ইসরায়েলের মোসাদ সহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের প্রধান প্রাথমিক এবং বিশেষায়িত গোয়েন্দা বাহিনীর।
মজার ব্যাপার হচ্ছে – এসব সংস্থার সাথে তুলনীয় (প্রাথমিক) হল এনএসআই তবে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে – সবচাইতে ক্ষমতাবান সামরিক বাহিনীর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই। আসলে, পুলিশি অপরাধ দমন এবং ভিআইপি সিকুরিটি গোয়েন্দা ছাড়া, রাষ্ট্রীয় কৌশলগত সিভিলিয়ান গোয়েন্দা বাহিনী সেভাবে গড়েই উঠেনি – এটা সম্ভবত সামরিক শাসনের একটি কুফল। আশ্চর্যের কিছু নেই – পাকিস্তানের মতই। এমনকি এসএসআই এর শীর্ষ কর্মকর্তারাও বেশিরভাগ সামরিক বাহিনীর সদস্য।
এখনও – গোয়েন্দাগিরি বলতে আমাদের দেশে মূলত “হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স” কেই বোঝানো হয় যা মূলত শুধু একটি অংশ; এটাও আমাদের দেশের একটি বড় দুর্বলতা।
আমার প্রস্তাব, শীর্ষ নেতৃত্ব দেবার মত যোগ্যতা সম্পন্ন একটি শক্তিশালী সিভিলিয়ান গোয়েন্দা অফিসার কোর অতিসত্বর গঠন করা উচিত – এর মূল কারন – গোয়েন্দা জগতের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজই অ্যানালিটিক্যাল – সেই রকম অ্যানালিটিক্যাল দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ সব সময় সামরিক বাহিনীতে থাকেননা কিংবা বিভিন্ন কারণে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে পারেননা কিংবা দেননা। “হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স” এ হয়ত সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ভালো করতে পারেন – বাকি কাজ গুলোর জন্য অ্যানালিটিক্যাল দক্ষতা সম্পন্ন মেধাবী সিভিলিয়ান নিয়োগ দেওয়া যায় – হতে পারে সরাসরি কিংবা বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে। তাছাড়া দেশের শীর্ষ/ মূল গোয়েন্দা বাহিনীকে অবশ্যই সিভিলিয়ান কিংবা মূল সামরিক বাহিনী হতে আলাদা থাকতে হবে।
বিভিন্ন কারণে অস্ত্র গোলাবারুদ পাচার গোয়েন্দা জগতের একটি সুপ্রাচীন কর্মকাণ্ড – একজন সিনিয়র ইন্টেলিজেন্স অফিসার মাত্রই তা জানেন। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা কিংবা সেইরকম যুদ্ধাবস্থা ব্যতীত আসলে সামরিক বাহিনী সরাসরি কিছুই করতে পারেনা। এসময় কাজ করে গোয়েন্দারা।
খুব আগে যাওয়ার প্রয়োজন নেই – গত শতাব্দীর বিভিন্ন যায়গার অস্ত্র পাচারের বিষয়টি স্টাডি করলেই পাওয়া যাবে।
চেতনাঃ
আমার কথার আর্গুমেন্ট হল – এই অস্ত্র পাচারে আমি কোন অদ্ভুত কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনা বিশেষত গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপারে। যদি ধরতেই হয় তাহলে পলিসি মেকারদের ধরা উচিত – সোজা কথায় বললে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। তবে মতিউর রহমান নিজামিকে ধরে ফাঁসিতে লটকানো রাজনৈতিক ভাবে লাভজনক কিন্তু খালেদা জিয়াকে ফাঁসি দেওয়া রাজনৈতিক ভাবে সুবিধাজনক নয়। এখন অনেকে আমাকে মতি রাজাকারের পক্ষ নিয়েছি বলে টিটকারি করতে পারে – যারা পরিস্থিতি না বুঝে এসব করবে সেইসব গর্দভ রাগিণীদের জন্য আরও কতগুলো বাক্য ক্ষয় করে সময় নষ্ট করতে আর চাচ্ছিনা।
আমেরিকার কোন গোয়েন্দার (বিশেষত সিআইএ এর) পরিচয় প্রকাশ করা একটি ফৌজদারি অপরাধ। আর আমাদের দেশের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রের পলিসি মেকিং পরিপূর্ণ করতে যেয়ে প্রকাশ্য বিচারের মুখোমুখি হতে হয় – যেখানে প্রধান পলিসিমেকারের কিছুই হয়না!!!!
বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র – যা আসলে চীন-ভারতের সানজু-চাণক্য খেলার অংশ মাত্র। চীন থেকে অস্ত্র গুলো ভারতের উত্তর পুর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নদাবাদী / স্বাধীনতাকামী দের কাছে যাচ্ছিল।
অস্ত্র সরবরাহের কারণ হতে পারে –
১. রাষ্ট্রীয় গোপন কৌশলের অংশ হিসেবে
২. কেবল ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য
এর উৎপাদন হতে পারে –
১. সরবরাহকারী দেশে উৎপাদিত
২. ভিন্ন দেশে উৎপাদিত
সরবরাহের মাধ্যম হতে পারে-
১. সরবরাহকারী দেশ কর্তৃক সরবরাহ
২. ভিন্ন দেশের মাধ্যমে সরবরাহ
অস্ত্র সরবরাহ সড়ক পথ এবং নৌ পথে বেশি হয় এমনকি কার্গো বিমানে আকাশ পথেও হয়!!
দশ ট্রাক অস্ত্র গুলোর মুল উৎপাদক চাইনিজ কোম্পানি নোরিঙ্কো – বিভিন্ন প্রকার সমরাস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স প্রাপ্ত ১১ টি রাষ্ট্রয়াত্ত চাইনিজ কোম্পানির একটি। গোপন হালকা অস্ত্র সরবরাহে সবচাইতে এগিয়ে আছে এখন চীন – এর পর পরই পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সহ অন্যান্য দেশ। সামগ্রিকভাবে সকল প্রকার অস্ত্র রপ্তানিতে যদিও চীনের অবস্থান পঞ্চম । চীনের এসব কোম্পানীর একটি কার্তুজ রপ্তানির হিসেবও রাখা হয় – সুতরাং এটা ভাবা হাস্যকর হবে যে চাইনিজ উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিগণ এই দশ ট্রাক অস্ত্রের ব্যাপারে অবহিত নন।
উল্লেখ্য, সংবাদ মাধ্যমে যত রংচং দিয়ে অস্ত্রের ধ্বংস ক্ষমতার ব্যাপারে বলা হউক না কেন – সামরিক দিক থেকে সবই হালকা অস্ত্র যা মূলত হালকা পদাতিক ইউনিট, নন কমব্যাট কিংবা সার্ভিস ইউনিট এবং প্যরামিলিটারি ব্যবহার করে যেমন বিজিবি, বিএসএফ, পিরেঞ্জার, আইটিবিপি ইত্যাদি। সেই সঙ্গে অবশ্যই “গেরিলা এবং সন্ত্রাসী বাহিনী” ( যার কাছে যেটা যেমন!!)
অবৈধ অস্ত্র রপ্তানি পৃথিবীতে অরগানাইজড ক্রাইম থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দাঙ্গা কিংবা গৃহযুদ্ধের ব্যাপ্তির অন্যতম নিয়ামক। আফ্রিকাতে এখন পাঁচটির বেশি দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে – যা এই অস্ত্র ব্যবসার অন্যতম।
গোপন অস্ত্র রপ্তানি / সরবরাহ সবসময় খারাপ??? নিশ্চয়ই নয়… শত শত উদাহরণের মধ্য সর্বশেষটিই বলা – পশ্চিমারা সিরিয়ার যোদ্ধাদের সরাসরি সাহায্য না করতে পারলেও গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করছে যা চীন কিংবা পূর্ব ইউরোপে উৎপাদিত – যদিও তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন তবে নৈতিক দিক হতে রিলেটিভ।
আমি নিশ্চিত – দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ের ব্যাপারে ভারতের কর্তাব্যক্তিরাও এতটা আশা করেনি – হয়ত মনে মনে হেসেছে – আশে-পাশের দেশে তাঁবেদার কেউ থাকলে অনেক সুবিধা হয়!!!!
ঘটনাঃ
বিচারক বলেছেন-
“বিশ্বের ইতিহাসে এত বড় অস্ত্র চোরাচালান মামলা হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। এটা অনেক বড় একটি মামলা।”
বিচারকের কথা একদিক থেকে সত্য – এরেকদিক হতে পুরো “________” যেহেতু এটা বিচারকের অন দ্যা রেকর্ড বক্ত্যব্য, এজন্য শূন্যস্থান আর পূরণ করলামনা। কেননা আমাদের দেশে যেখানে বিচারকগণ যমুনা ব্রিজে টোল ছাড়া উঠার পর দায়িত্বরত কর্মকর্তা টোল চাইলে তাকে গ্রেপ্তার করান এবং কয়েক সপ্তাহ হয়রানি করা হয় বিনা বিচারে – যদিও তাতে কিছুই হয়না বিচারকের, সেখানে……!!!
বিচারকের কথার সুর ধরে আমার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে –
বিশ্বের ইতিহাসে কোন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের শান্তিকালীন সময়ে প্রকাশ্য এত বড় মামলায় হাজির হতে হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। এটা অনেক অদ্ভুত একটি মামলা।”
কোন রাষ্ট্র যদি নিশ্চিত হতে পারে যে, অপর রাষ্ট্র থেকে তার নিজ রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দেওয়া হচ্ছে, তাহলে তার অধিকার আছে যেকোনো উপায়ে তা দমন করা – এর জন্য যদি সামরিক আক্রমণ করতেও হয়, তাহলেও। তবে এখানেও অনেক ফ্যাক্টর কাজ করবে – যেটাকে বলা যায়, কৌশলগত কস্ট বেনেফিট এনালাইসিস। তিব্বতে মদদ দেবার জন্য চীন- ভারতকে, কিংবা সেভেন সিস্টার্সে মদদ দেবার জন্য ভারত- চীনকে কিংবা কাশ্মীরে মদদ দেবার জন্য ভারত- পাকিস্তানকে আক্রমণ করে বসতে পারেনা – কেননা কষ্ট-বেনেফিট অ্যানালাইসিসে সেই আক্রমণ বেনেফিট সীমা অতিক্রম হতে পারেনা। দশ ট্রাকের ব্যাপারটাও তা। এর জন্য আর যাই হোক ভারত বাংলাদেশকে আক্রমণ করতে পারতোনা।
আমি মনে করি এই দশ ট্রাক মামলা ব্যাপারটা রাজনৈতিক। কেউ যদি এক ডজন ডিম চুরির অপরাধে ধরা পরা চোরকে গুলি করে মেরে ফেলে – তাহলে দোষী কে??? মামলাটা যেভাবে এগিয়েছে – বিএনপি প্রথমে এর থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নেবার চেষ্টা করে বিরোধীদলকে ফাঁসাতে চেয়েছিল – এখন আওয়ামীলীগও একই কাজ করছে তবে যা করতে যেয়ে রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে ফেলছে। এই অবস্থা পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপদ ভাবেই বলা যায় – বহিঃশত্রুর আক্রমণে এই দুটি রাজনৈতিক দলও অত্যন্ত নীচ আচরণ করবে – হয়ত দেখা যাবে আক্রমণের সময়কার বিরোধীদল “নিরপেক্ষ” থেকে সরকার দলকে দোষারোপ করবে আর সরকারী দল উক্ত বহিঃ আক্রমণের জন্য বিরোধীদলকে দোষারোপ করবে।
এই মামলায় যদি আসলেই কাউকে বিচারের আওতায় আনতে হয় তাহলে আনতে হবে একেবারে শীর্ষ নীতি নির্ধারককে – তাকে না ধরে তৃতীয় এবং এর পরের গুলোকে ধরা মানে হল এখানে আইনের শাসনের অভাব। কিন্তু তা করা হয়নি কারণ তা রাজনৈতিক ভাবে লাভজনক হবেনা। তবে সবচাইতে বড় ব্যাপার হল – এই মামলার বিচার এভাবে প্রকাশ্য করা কিংবা করার ফলে রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কি একটা স্যাটেলাইট, বানানা, ক্লায়েন্ট, ট্রিবিউটারি – যেভাবেই বর্ণনা করা হোক না কেন – তেমন পরিচয়ের ধারক হবনা ???
যাতনাঃ
আমার মনে হচ্ছে, পুরো বিষয়টি আসলে হ্যান্ডল করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় এবং প্রশাসনিক অনভিজ্ঞতায় । এমন অনভিজ্ঞতা বিভিন্ন ব্যাপারে দেখা যায় – যেমন কোন বড় দাগী সন্ত্রাসী ধরা পরার পর ঐ মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা কিংবা সহকারীরা গর্ব সহকারে পরিচয়ের সাথে ছবি তুলেন – ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য বিপদের (নিজের, পরিবারের কিংবা রাষ্ট্রের উপর) কথা না ভেবেই। কিংবা রাজনীতিবিদেরা যেখানে সেখানে অপ্রয়োজনীয় কথা বলা ইত্যাদি। আসলে স্বাধীন ভাবে নেতৃত্ব সৃষ্টি না হওয়াটাও এটার একটা কারণ হতে পারে।
আরেকটি ব্যাপার, যদিও, অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন – আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, দ্রুত দেশ স্বাধীন হওয়াতে ( মূলত, সাত মাসেরও কম সময়ে), সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীন হবার যেমন ফলাফল- তা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীন হলে যেমন হয়, তেমন হয়েছে অর্থাৎ – পূর্ববর্তী শাসন ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা থাকা – যেমনটি হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীতে – যেখানে দীর্ঘ মেয়াদী সামরিক শাসন দ্বারা কলুষিত পাকিস্তানী রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কালচারের অনেক কিছুর ধারাবাহিকতা ছিল।
বিএনপি-আওয়ামীলীগ দুটি দলই রাষ্ট্র চালানোয় চরম অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। দ্বিতীয়ত এই মামলায় বেশ কিছু নিরীহ মানুষ (প্রাইভেট সিটিজেন এবং পাবলিক সার্ভিস হোল্ডার) অযথা হয়রানির স্বীকার হতে হয়েছে। তদন্তকারী দুই সার্জেন্ট এর উপর যে অত্যাচার হয়েছে তা বারবার লিমন নামক অসহায় নিরপরাধ ব্যক্তিটির কথা মনে করিয়ে দেয় – দুই জনই র্যাব নামক একটি এডহক বাহিনীর কতগুলো সদস্যর অত্যাচারের স্বীকার। তবে সবচাইতে ইন্টারেস্টিং এবং আইরনি বটে – এই দশ ট্রাক মামলার অন্যতম প্রধান আসামী হলেন “ফাদার অফ দ্যা র্যাব” সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুতফর রহমান বাবর। র্যাব কে অতি তাড়াতাড়ি সংস্কার করা দরকার।
আমার আরেকটি প্রস্তাব হল – সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন অফিসার যারা সেচ্ছায় চান একটি নির্দিস্ট কাল সামরিক বাহিনীতে ডিউটি করার সিভিলিয়ান চাকুরী করতে – তাদের মধ্য নির্দিস্ট সংখ্যক অফিসারদের স্থায়ীভাবে, সিভিল সার্ভিসে যোগ্যতা এবং প্রতিযোগীতার ভেতর দিয়ে, বিশেষ বিসিএস এর মাধ্যমে, নির্দিস্ট কয়েকটি ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।
কিছুদিন আগে ভারতের কূটনীতিক গ্রেপ্তারের ঘটনার পর- কতগুলো হাস্যকর আচরণের হেতু একজন বলেছিলেন – “ভারত পরাশক্তি হতে চায়, কিন্তু সে রকম আচরণ করেছেন” (অনেকগুলো আচরণের একটি ছিল, আমেরিকার দূতাবাসের নিরাপত্তা শিথিল করা যা রাশিয়া কিংবা চীন করত কিনা সন্দেহ – একি ঘটনার প্রেক্ষিতে!!) । আসলেই ভারতের বর্তমান নেতৃত্ব তেমন আচরণ করছেনা বিভিন্ন ক্ষেত্রে – হয়ত তারা একটা পরাশক্তি রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় তেমন দক্ষ হয়ে উঠেনি। আমাদের দেশের রাজনৈতিকবৃন্দ একটি পরাশক্তি না হোক, একটি উদীয়মান রাষ্ট্র সুস্থ ভাবে চালানোয় দক্ষ হইয়ে উঠেছেন কিন তাতে যথেষ্ট স্বন্দেহের অবকাশ আছে।
Source: http://www.mukto-mona.com/home/