শোষণ করতে গিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটই না শোষিত হয়ে পড়ে
ধোনির ভারত হ্যামিল্টনে মঙ্গলবার সিরিজে ফিরে আসতে পারবে? দু’দেশের ক্রিকেট সমর্থক বাদে বিশ্ব ক্রিকেটজগতে কারও কোনও উৎসাহ নেই। ব্যাট-বল-গ্লাভস ছাড়াই সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ক্রিকেট-যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে সোমবার অন্য গোলার্ধে। মরু-শহর দুবাইয়ে।
যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হওয়ার কথা ছিল মঙ্গলবার আইসিসি এগজিকিউটিভ বোর্ডের বৈঠকে। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা আগেই মূলত ভারতীয় বোর্ড কর্তারা তীব্র ‘পাওয়ার-বোলিং’ শুরু করেন আইসিসি-র কোনও কোনও পূর্ণসদস্য দেশের উপর। সবচেয়ে চাপের মুখে ফেলা হয় বাংলাদেশকে।
আইসিসি-র ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী বৈঠক মঙ্গলবার দুবাইয়ে শুরু হচ্ছে। শ্রীনিবাসনের ভারত যা চাইছে তা যদি সত্যি করে ফেলতে পারে বিশ্ব ক্রিকেটের রূপরেখা বদলে যাবে। একই সঙ্গে ক্রিকেটমহলের গরিষ্ঠ অংশের মতে, ‘‘খুন হয়ে যাবে ক্রিকেটের বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া।”
ভারত যা চাইছে তার জন্য সাত পূর্ণসদস্য দেশের সম্মতি দরকার। এমনিতে আইসিসি-র সংবিধান বদলের জন্য আট দেশের সম্মতি প্রয়োজন। কিন্তু এক্ষেত্রে ম্যাজিক ফিগার হল সাত। সোমবার রাত পর্যন্ত ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ছয়-তে আটকে রয়েছে। চাই আরও এক। সে জন্যই বাংলাদেশ বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসানের উপর বারবার চাপ সৃষ্টি করা হল যে তাঁরা যেন তিন দেশের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান।
গোটা পরিকল্পনা যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, সেই নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন মা মারা যাওয়ায় দুবাই আসতে পারেননি। তাঁর হয়ে বাংলাদেশ কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন আইপিএল কর্তা সুন্দর রামন এবং সচিব সঞ্জয় পটেল। বাংলাদেশ রাজি হচ্ছে না দেখে এ বার চাপ দেওয়ার জন্য স্কাইপে শ্রীনিবাসনকে ডেকে আনা হয়। শ্রীনি একটা সময় উত্তেজিত হয়ে বলেন, আপনারা রাজি না হলে আমরা এ বছর বাংলাদেশে টি টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ খেলব না। এশিয়া কাপ থেকেও নাম তুলে নেব। দেখি আপনারা কী করেন।
এ রকমই চাপের মধ্যে পড়ে এ দিন জিম্বাবোয়ে, নিউজিল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ শ্রীনিবাসনদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। জিম্বাবোয়ে কর্তা পিটার চিঙ্গোকা বিশ্ব ক্রিকেটে তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের অকপটে বলেন, “জানি, নোংরা ব্ল্যাকমেলিংয়ের শিকার হতে যাচ্ছি। কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদের বোর্ডের টাকা দরকার। ভারত অনেক টাকা দেবে বলেছে।”
শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানকে অবশ্য ভারত বহু চেষ্টাতেও টিমে টানতে পারেনি। পাকিস্তানের প্রাক্তন অধিনায়ক রামিজ রাজা এ দিন সংবাদসংস্থাকে বলেছেন, “দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে ভারতের প্রস্তাবে আমাদের রাজি হয়ে যাওয়া উচিত।”
ক্রিকেটমহল যা শুনে রামিজের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। এশীয় ক্রিকেট সংস্থার শীর্ষস্থানীয় কর্তা বললেন, “রামিজ চিরকাল সাহেবদের পা চেটে এসেছে। এই বিবৃতি ও দেবে তাতে আর আশ্চর্য কী?” প্রাক্তন ক্রিকেটারদের মধ্যে ক্লাইভ লয়েড অবশ্য ভারতের আনা প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, “এটা অবিলম্বে প্রত্যাহার হওয়া উচিত।”
নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী বিশ্ব ক্রিকেটে ক্ষমতার দু’টো স্তর হয়ে যাবে। একটা দিকে থাকবে বাকি সাতটা দেশ। তাদের মধ্যে অবনমন থাকবে। বাকি তিন দেশ হবে তিন প্রধান। কলকাতা ফুটবলে এক সময় যে রকম ছিল মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান স্পোর্টিং। কিন্তু কলকাতা মাঠে বড় তিন প্রধানের কখনওই এই ক্ষমতা ছিল না, নতুন প্রস্তাবে ভারত-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার জন্য যা থাকছে। এরা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি টাকা পাবে। সব সিদ্ধান্ত নিজেরা নেবে। সব বড় টুর্নামেন্ট নিজের দেশে করবে। এমনকী এরা পয়েন্ট তালিকায় সবার শেষ হলেও এদের জন্য অবনমনের ব্যবস্থা থাকবে না। রাষ্ট্রপুঞ্জে যেমন আলাদা নিরাপত্তা-পরিষদ রয়েছে এটা তেমন বিশেষ সুবিধাভোগ করা তিন সদস্য। সোমবার রাতের কলকাতায় ক্রিকেট- ইতিহাসবিদ এবং বিশিষ্ট ক্রিকেটলিখিয়ে রামচন্দ্র গুহ উত্তেজিত ভাবে বললেন, “এ রকম জঘন্য আইন কেউ কখনও শুনেছে যে লাস্ট হলেও তোমার জন্য অবনমন নেই?”
জগমোহন ডালমিয়া আইসিসি-তে থাকার সময় কৃষ্ণাঙ্গ দেশগুলোকে এক করে যে সফল মডেল তৈরি করেছিলেন, এর ফলে তা ভেঙে খানখান। এ দিন এশীয় ক্রিকেট কর্তা বলছিলেন, “এশিয়াতেই তো সব ক’টা দেশ ভারতের বিপক্ষে চলে গেল। কাদের সঙ্গে ওরা খেলবে?” ঢাকা থেকে এক ক্রিকেটকর্তা এ দিন বললেন, “ভারত যত হুমকিই দিক না কেন, আমাদের প্রেসিডেন্ট মাথা নত করবেন না। করলে আমাদের দেশের কাছে উনি মুখ দেখাতে পারবেন না।” শোনা যাচ্ছে ব্যাপারটা বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবধি গড়িয়েছে।
এ দিকে অভূতপূর্ব ভাবে পাঁচ প্রাক্তন আইসিসি প্রেসিডেন্ট এ দিন বিভিন্ন সদস্যদের কাছে মেল করে আবেদন করেছেন, তিন প্রধানের চাপের কাছে মাথা না নোয়ানোর। ম্যালকম গ্রে, ম্যালকম স্পিড, এহসান মানি, শাহরিয়র খান এবং তৌকিব জিয়া। এঁরা ডালমিয়াকেও ফোন করেছিলেন। যদি তিনিও আবেদনে সই করেন। এখানে সই করা মানে শ্রীনির বিরুদ্ধে যাওয়া। ডালমিয়া স্বভাবতই রাজি হননি। কিন্তু তাঁর নৈতিক সমর্থন কি অন্য দেশের দিকে? শ্রীনির প্রস্তাবে তো তাঁর মডেল-টাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। ডালমিয়া বললেন, “দু’দিন দেখুন না প্রস্তাবটা আদৌ পাস হয় কি না। পাস হলে না হয় কথা বলা যাবে।”
ক্রিকেটমহলে এমনও ধারণা জন্মাচ্ছে যে নিজের স্বল্পকালীন লাভের কথা ভাবতে গিয়ে দীর্ঘকালীন ভাবে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বনাশ করে ছাড়ছেন শ্রীনিবাসন। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো একত্রিত হয়ে যে জোট তৈরি হয়েছিল সেটা এতদ্বারা তিনি শুধু ভেঙেই দেননি, প্রচণ্ড হানহানির সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছেন। এরা কেউ আর ভারতকে বিশ্বাস করতে রাজি নয়। সবচেয়ে বড় কথা যাদের সঙ্গে ভারত নতুন জোট বাঁধল, সেই শ্বেতাঙ্গ দুই দেশ কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?
ডালমিয়া এমন আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু অনেকেরই মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে কোনও ক্রিকেটীয় ইস্যুতে ভোটাভুটি হলে তিন প্রধানের মধ্যে ভারতই তো সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে পড়তে পারে। হেরে যেতে পারে ১-২।
তা হলে ভারত কি আরও চূড়ান্ত ক্ষমতার দিকে এগোচ্ছে? নাকি ফাঁদে পা দিচ্ছে? ধোনির টিমের স্কোর নয়, বিশ্ব ক্রিকেটজগতের এটাই জিজ্ঞাসা।