পাকিস্তানের জন্য হোক দুঃখ প্রকাশ দিবস – হামিদ মির
পাকিস্তানে অনেকেই আমাকে তীব্র ঘৃণা করেন। কারণ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের জন্য দুই বছর আগে আমি ইসলামাবাদ প্রেসক্লাবে বাঙালিদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছি। তাঁরা আমাকে ঘৃণা করেন। কারণ, ১৯৭১ সালের গণহত্যার ঘটনায় বাংলাদেশের জনগণের কাছে পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক দুঃখ প্রকাশের দাবিও জানিয়েছি আমি। তাঁরা বলেন, ওই ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমি ভালো পাকিস্তানি নই।
তাঁদের বক্তব্য, ১৯৭১ সালে আমি অনেক ছোট ছিলাম এবং কোনো কিছুর সত্য-মিথ্যা বোঝার বয়স আমার ছিল না। হ্যাঁ, এটা ঠিক ওই সময় আমি স্কুলপড়ুয়া একটি শিশু ছিলাম। কিন্তু ওই সময়ের গণহত্যার বিষয়ে অনেক শুনেছি ও পড়েছি।
কীভাবে অবিশ্বাস করি আমার বাবা প্রয়াত ওয়ারিস মিরের কথা। বাবা লাহোরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেখানকার ছাত্র সংসদের জন্য তুরস্কে একটি শিক্ষা সফর আয়োজনের দায়িত্ব দেয় তাঁকে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সম্মতিতে সত্যিকারের অবস্থা জানার জন্য একাত্তরের অক্টোবরে তাঁদের নিয়ে ঢাকা সফর করেন বাবা। মনে পড়ে, ওই সফর থেকে ফিরে বাবা অনেক দিন কেঁদেছেন। তাঁর কাছ থেকে শুনেছি সেখানে ওই সময়ের হত্যাযজ্ঞের ঘটনাগুলো।
বাবার দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে আমার মায়ের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার অনেক মিল খুঁজে পাই আমি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় জম্মু থেকে পাকিস্তানে আসার পথে পরিবারের সদস্যদের হারান মা। মায়ের চোখের সামনেই তাঁর ভাইদের হত্যা করে হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন। দুর্বৃত্তরা আমার নানিকেও অপহরণ করে। স্বজনদের লাশের নিচে লুকিয়ে কোনো রকমে বেঁচে যান মা। আমার মনে আছে, বাবা যখন মাকে শোনাতেন পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা কীভাবে বাঙালি নারীদের সম্ভ্রম হানি করেছে, মা কেঁদে ফেলতেন। মা প্রশ্ন করতেন, ‘নিজেদের ইজ্জত রক্ষার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছি আমরা। তাহলে আজ কেন নিজেরাই নিজেদের ইজ্জত কেড়ে নিচ্ছি?’
বাবা সব সময় বলতেন, ‘বাঙালিরা পাকিস্তান গড়েছে, আর আমরা পাঞ্জাবিরা তা ভেঙেছি।’ একসময় তিনি বলেছিলেন, ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস হলে ২৬ মার্চ দুঃখ প্রকাশ দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর জবাবদিহি দিবস হওয়া উচিত।
১৯৮৭ সালে সাংবাদিকতা পেশায় আসার পর আমি বাবার ভাবনাগুলো উপলব্ধি করতে শুরু করি। প্রথমবার হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদন পড়ার পর আমার ভীষণ লজ্জা লাগে। পাকিস্তান সরকারের গঠন করা এই কমিশনের প্রতিবেদনে হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, প্রামাণ্য এই দলিল থাকার পরও অনেকে ওই সময়ের হত্যাযজ্ঞের কথা অস্বীকার করেন। তাঁরা দাবি করেন, শেখ মুজিব ছিলেন একজন বিশ্বাসঘাতক। তিনি ভারতের সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনী গঠন করেন, যারা অনেক নিরীহ বিহারি ও পাঞ্জাবিকে হত্যা করেছে।
অথচ বাস্তবতা হলো, পাকিস্তান গঠনের আন্দোলনের একজন কর্মী ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ফাতেমা জিন্নাহর (মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন) সমর্থক। তিনি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। এ কারণে ওই সময়কার পাকিস্তানের সামরিক সরকার তাঁকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দেয়। প্রকৃত অর্থে ওই সামরিক শাসকেরাই ছিলেন বিশ্বাসঘাতক। কারণ, তাঁদের সেনাসদস্যরা নিজেদের মা-বোনদের সম্ভ্রম হানি করেছেন—আমার এমন বক্তব্যের কারণে তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে। বলে, আমি নাকি পাকিস্তানের শত্রু।
আমার মা পাকিস্তানের জন্য তাঁর পুরো পরিবারকে হারিয়েছেন। সেই মায়ের সন্তান হয়ে আমি কীভাবে পাকিস্তানের শত্রু হতে পারি? আমার সমস্যা হলো, আমি সত্যকে অস্বীকার করতে পারি না। আমার একজন প্রবীণ সহকর্মী আফজাল খান এখনো বেঁচে আছেন। ৭৩ বছর বয়সী আফজাল খান বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তানে (এপিপি) কাজ করতেন। তিনি ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের ফেডারেল জার্নালিস্ট ইউনিয়নের (পিএফইউজে) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সেনা অভিযানের খবর সংগ্রহের জন্য ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়। তিনি আমাকে অনেকবার বলেছেন, ওই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা করেছিল, তা কোনো জাতীয় সেনাবাহিনীর কাজ নয়। ১৯৭১ সালে খুলনায় ইস্পাহানি হাউসে থাকার সময় একজন সেনা কর্মকর্তা তাঁকে একটি মেয়ের সঙ্গে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আফজাল খান ওই কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন মেয়েটি কার? সেনাবাহিনীর ওই মেজর জবাব দিয়েছিলেন, মেয়েটি স্থানীয় একজন পুলিশ কর্মকর্তার এবং তাঁকে বন্দুকের মুখে ধরে আনা হবে। ওই ঘটনার পর মে মাসে লাহোরে ফিরে আসেন আফজাল খান।
আফজাল খান আমাকে আরও বলেছিলেন, বাঙালিদের গণহত্যা ও ধর্ষণের জন্য দায়ী ব্যক্তিরা কখনোই পাকিস্তানে সম্মান পাননি। জেনারেল ইয়াহিয়ার নাম পাকিস্তানে অনেকটা গালির মতো। তাঁর ছেলে আলী ইয়াহিয়া সব সময় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার চেষ্টা করেন। জেনারেল ইয়াহিয়াকে এখনো ‘বাংলার কসাই’ বলা হয়। জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ‘বাংলার বাঘ’ হিসেবে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরিচিতি পেয়েছেন ‘বাংলার শেয়াল’ হিসেবে।
বাঙালি ভাইদের গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ঘৃণা করে বেশির ভাগ পাকিস্তানি। এ কারণেই পাকিস্তানি ওই সব সেনা কর্মকর্তার পরিবারের সন্তানেরা প্রকাশ্যে তাঁদের বাবার পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন। তবে এখনো একটি অংশ রয়েছেন, যাঁরা এই জঘন্য ভুলকে স্বীকার করতে চান না। তাঁরা সংখ্যায় কম, কিন্তু ক্ষমতাশালী। আমি মনে করি, তাঁরাই পাকিস্তানের শত্রু। কেন আমরা এই শত্রুদের রক্ষা করব? কেন আমাদের গণতান্ত্রিক সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালিদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে না? এই দুঃখ প্রকাশ পাকিস্তানকে দুর্বল করবে না, বরং শক্তিশালী করে তুলবে।
পাকিস্তান খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। আমি নিশ্চিত, এমন দিন শিগগিরই আসবে, যেদিন পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালিদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করবে এবং ২৬ মার্চকে দেশপ্রেমিক পাকিস্তানিরা দুঃখ প্রকাশ দিবস হিসেবে পালন করবে।
আমি দুঃখ প্রকাশ করতে বলি। কারণ, বাঙালিরা পাকিস্তান গড়েছে। জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বাঙালিরা ফাতেমা জিন্নাহর পাশে ছিল। আমি দুঃখ প্রকাশ করতে বলি। কারণ, আমি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে একটি নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। আমি কলঙ্কিত অতীত নিয়ে বাঁচতে চাই না, বরং একটি কলঙ্কমুক্ত ভবিষ্যতের আশা নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। শুধু পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশের জন্যও একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ কামনা করি আমি। আমি দুঃখ প্রকাশ করতে বলি। কারণ, আমি পাকিস্তানকে ভালোবাসি এবং বাংলাদেশকেও ভালোবাসি। বাংলাদেশের ভাইবোনদের জন্য স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।
হামিদ মির: ইসলামাবাদে জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
ই-মেইল: hamid.mir@geo.tv