'সুর নয়, দিন বদলান' আবু হাসান শাহরিয়ার

'সুর নয়, দিন বদলান' আবু হাসান শাহরিয়ার

দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ককালকে ‘ত্বরিৎ’ বৈধতা দেয়ার কথা বলেছেন নয়া আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। আভাস দিয়েছেন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীরও। এই সেদিনও, শেখ হাসিনার মামলা পরিচালনাকালে, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সৃষ্ট হয়রানি-নিপীড়নের সমালোচনায় ব্যারিস্টার শফিক ছিলেন সোচ্চার। এত তাড়াতাড়ি সুর বদলালে মানুষ কী বলবে? কথা তো ছিল দিন বদলানোর; সুর বদলানোর নয়। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে বর্তমান সরকার সংবিধানে যে-কোনও সংশোধনই আনতে পারে। জনগণই সেই ম্যান্ডেট দিয়েছে। দিয়েছে বলেই, অতি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে, সরকারেরও উচিত, জনগণের সঙ্গে ভাবনাবিনিময় করা। সংশোধনী বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব মধুর নয়। সংশোধনীকে আমরা সংবিধানলঙ্ঘনের রক্ষাকবচ হতেও দেখেছি। তাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তাবৎ কর্মকাণ্ডকে হরেদরে স্বীকৃতি দেয়ার আগে, বিরোধী দলের তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও মতামত নেয়া উচিত। এমন কিছু করা ঠিক হবে না, ভবিষ্যতে যা অনির্বাচিত সরকারের ক্ষমতাদখলের পথ প্রশস্ত করে।

চার নেতাসহ বঙ্গবন্ধুহত্যার বিচার দ্রুত কার্যকর করার কথাও বলেছেন ব্যারিস্টার শফিক। শুনে আস্বস্ত হয়েছি। বিচারের দায়িত্ব বিজ্ঞ আদালতের। বিচারাদেশ কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। প্রত্যাশা এই যেÑ পরাধীন একটি জাতিকে যিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং সেই স্বপ্নকে ধাপে-ধাপে বাস্তবায়নের পথও বাৎলে দিয়েছিলেন, তার বিচারে অতীতের মতো কেউ ‘বিব্রত’ হবেন না। প্রাসঙ্গিক একটি স্মৃতির কথা বলি। ‘৩২ নম্বর : চোখের আলোয় দেখেছিলাম’ নামে একটি বই সম্পাদনা করেছিলাম এক যুগ আগে। কবি শামসুর রাহমান ছিলেন উপদেষ্টা সম্পাদক। তার আগে সারা দেশের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে গিয়ে বাঙালির মহত্তম নেতাকে বুকে ধারণ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তারপর নির্দিষ্ট শব্দে লিখতে বলা হয়েছিল একটি রচনা। বাছাই রচনাবলিতে ঐ বই। সহস্রাধিক অংশগ্রহণকারীর অর্ধেকেরও বেশি জনের কাছে বইটি বিনামূল্যে ডাকযোগে পৌঁছেও দেয়া হয়েছিল। পুরো ব্যয় বহন করেছিল আমার শৈশবের বন্ধু মুজিবপ্রেমী বজলুল হক বেগ। কুর্নিশ জানাই ওকে। শ্রেষ্ঠ ২০ রচনাকারকে পুরস্কৃতও করা হয়েছিল। ১০ জনের হাতে পুরস্কারের সনদ ও ক্রেস্ট তুলে দিয়েছিলেন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। বাকি ১০ জনকে কবি শামসুর রাহমান।

পাশ্চাত্যে অনেক ক্রিয়েটিভ রাইটিং স্কুল আছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে আন্তর্দেশীয় কবি-লেখক-ভাবনাবিনিময় প্রকল্প। আইওয়া নিয়ে শঙ্খ ঘোষ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দুটি বই লিখেছেনÑ ‘ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম’ ও ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’। তার চেয়ে কোনও অংশে কম নয় ‘৩২ নম্বর : চোখের আলোয় দেখেছিলাম’। কথাটি আমার নয়; বলেছিলেন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবাদ বিভাগের সাবেক প্রধান ক্যারোলিন ব্রাউন। শামসুর রাহমান, ক্যারোলিন ব্রাউন ও আমি একটি ত্রিভূজ সংলাপ করেছিলাম দশ বছর আগে। ছাপা হয়েছিল অধুনালুপ্ত দৈনিক ‘মুক্তকণ্ঠ’এ। ক্যারোলিনের মুগ্ধতা ঐ সংলাপের সমসাময়িক। ‘৩২ নম্বর : চোখের আলোয় দেখেছিলাম’-এ যাদের লেখা ছাপা হয়েছিল কিংবা লেখা ছাপা না-হলেও যারা অংশ নিয়েছিল ঐ প্রতিযোগিতায়, তাদের প্রায় সবাই এবার প্রথম ভোটার হয়েছে। মানে, তারুণ্য অধ্যুষিত যে-৩১ শতাংশ ভোটার এবারের নির্বাচনি ফলাফলে ফ্যাক্টর ছিল, ওরা তাদেরই প্রতিনিধি।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট শিশু রাসেলকেও হত্যা করেছিল ঘাতকরা। ওরই কাছাকাছি বয়সের কয়েকজন সাবেক শিশুর কিছু অনুভূতি আইনমন্ত্রী ও বিজ্ঞ বিচারকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। ঢাকার এসওএস হারম্যান মেইনার স্কুল ও কলেজের ৫ম শ্রেণীর ছাত্র খোন্দকার সউদ আজিজ গালিব লিখেছিলÑ “এতদিন ভেবেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর পোশাক-পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র হবে রাজা-বাদশাহদের মতো দামী, হবে কারুকার্যখচিত। কিন্তু না, আমার ধারণা পাল্টে গেছে।” সুদূর মহালছড়ির এপিবিএন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীতে পড়া আদিবাসী শিশু প্রিয়াঙ্কা পুতুল তার লেখা শেষ করেছিল এই বলেÑ “মা আমাকে একটা বঙ্গবন্ধুর ছবি কিনে দিয়েছেন। পড়ার টেবিলে জানালার কাছে সেই ছবি আমাকে দেশকে ভালবাসার প্রেরণা জোগায়।” কামরুন্নেসা সরকারি উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীতে পড়া জেরিন মারজান খান ঝুমুর লিখেছিলÑ “শুধু একটা কথাই আমার চিšতায় আসে নাÑ যে মানুষ বাংলাদেশের জন্য এত করলেন, তাকেই কিনা এভাবে হত্যা করা হল!” মাদারীপুরের সৈয়দ আতাহার আলী একাডেমির দশম শ্রেণীর ছাত্রী কাজী তানিয়া সারমীন ওদের চেয়ে বয়সে একটু বড়। কণ্ঠস্বরও ছিল জোরালো। ওর অনুভূতিÑ “ধিক্কার জানাচ্ছিলাম সেইসব ক্ষমতালোভী পৃষ্ঠপোষকদের, যারা হত্যাকারীদের শাস্তি তো দেয়ইনি বরং বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করেছে।”

সারমীনের ধিক্কার ১৫ আগস্ট ঘটা-করে নকল জন্মদিন পালনকারী বিএনপি-জামায়াতকে তো বটেই, পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের দণ্ডবিহীন আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ শাসনকালকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। সুযোগ এসেছে প্রায়শ্চিত্ত করার। নতুন ধিক্কারের দায় না-নেয়ারও। ভুল করলে নতুন প্রজন্ম কোনও ছাড় দেবে না। আমার কলম ওদের পাশেই থাকবে।

ই-মেইল : ahshahriar@dhaka.net | original source


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment