বাংলা কবিতা, শূন্যের কবিতা – ফারুক আহমেদ
কবিতা অনেক রকম এবং ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’, জীবনানন্দ দাশের এ–দুটি কথাকে আপ্তবাক্য হিসেবে মাথায় রেখে যদি লেখা শুরু করা হয়, তাহলে একটা সময়ের কবিতার ধর এবং একজন কবির স্বাতন্ত্রবোধ উভয়কেই অনুভব করা সম্ভব। এ-সময়ে দশকের হিসেবে কবিতার যে-ধারা নির্ধারণ করা হয়, সেখানে সে-একটি দশকে ভিন্ন আমেজের ভিন্ন-ভিন্ন ঘরানার কবিতা লেখা হয়। অর্থাৎ কবিতা অনেক রকম, এ-রূপটি অনুভব করা যায়। আবার একটি সময়ে নানা প্রজাতির কবিতা লেখার আয়োজনের মধ্য দিয়ে একটি স্তম্ভ নির্মিত হওয়ার পরও দেখা যায় একটা সময়ের অনেক কবি থেকে কয়েকজন মাত্র কবিই প্রকৃত কবি হিসেবে টিকে থাকেন। তবে অনেক কবির দ্বারা বিচিত্র ধরণের কবিতা রচিত না হলে কবিতার স্তম্ভটি তৈরী হতো না এবং স্বতন্ত্র কয়েকজন কবিকে আমরা নির্ধারণ করতে পারতাম বলে মনে হয় না। ফলে সকলে কবি না হোক, তারা কাব্য-চর্চার মাধ্যমে স্তম্ভের আয়োজকদের একজন তো বটেই। কবিতার নদীতে একটা ঢেউ হিসেবে স্রোতকে গতিময়তা দিতেও একজন গৌণ কবি সহায়ক শক্তি তা কিন্তু বলতেই হবে।
দেখা যায় যে, কয়েকশো বছরের মধ্য-যুগে অনেক ধরণের, অনেক ধারার কাব্য রচিত হয়েছে। মঙ্গল-কাব্য, পুঁথি-কাব্য, লোককাহিনী-নির্ভর-কাব্য, রোমাঞ্চ-কাব্য ইত্যাদি নানা ধারার কাব্যের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিমান হিসেবে টিকে আছে বৈষ্ণব পদাবলি। পরিমাণে খুব বেশি না হয়েও বৈষ্ণব পদাবলিই অন্য সব কাব্যধারাকে হটিয়ে নিজের ঔজ্জ্বল্য বিস্তার করে যাচ্ছে। সুতবাং আমাদের এ-সময়ে, খুব ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সময়ের বিভাজনের মাধ্যমে নির্ধারিত কবিতার ধারার মধ্য থেকে কোন ধারা এবং কোন দশকের কবি অমরত্বের পথে যাবে, তা বলা মুশকিল। এখনকার সামপ্রতিকতম কবিতার ধারার নাম-শূন্য দশকের কবিতা। অবশ্য কোনো-মতেই একটা দশককে একটা ধারা হিসেবে বিবেচনায় এনে আলোচনা করাটা সমুচিত হবে বলে মনে হয় না। তবে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সময়ের বিভাজনের হিসেবে একটা কাল্পনিক ধারা ধরে নেওয়া হলো।
চর্যাপদকে বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন ধরা হলে আমাদের কবিতার বয়স এক হাজারের কিছু ওপরে। কিন্তু দেখা যায়, চর্যাপদের পর কিছু কাহিনী-কাব্যের অনুবাদ, মধ্য-যুগের কয়েকটি ধারা এবং তার পর ঊনিশ-বিশ শতকের কবিতা নিয়েই অধিক আলোচনা ও ভাবনা। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এর মাধ্যমে আরেকটা প্রশ্নেরও জন্ম হয়। তাহলো, সব সময় কবিরা কি তাদের ঠিক আগে লেখা অর্থাৎ সামপ্রতিক কবিতার দ্বারা অধিক প্রভাবিত হন?
আমাদের কবিতায় সাম্প্রতিক আধুনিক কবিদের মধ্য জীবনানন্দ দাশ এখনও পর্যন্ত সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী কবি। কিন্তু বাংলা কবিতার ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসলেও সাম্প্রতিকতার কারণেই কি জীবনানন্দ দাশের প্রভাব তরুণ কবিদের ভেতর সর্বাধিক? জীবনানন্দ দাশের পরও বেশ কজন কবি বাংলা সাহিত্যে তাদের উজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন। তিরিশের অন্য চারজন ছাড়া পরবর্তী দশকগুলোতে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার প্রমুখ কবিরা রয়েছেন বা সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন- এমন সব নামের সঙ্গে পশ্চিমের অনেক কবির প্রভাব তো আছেই। এলিয়ট, বোদলেয়ার, পাস্তেরনাক প্রমুখ নামের সমারোহ আমাদের এ-সময়ের কবিদের নানাভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে।
সুতরাং এ-সময়ে কবিরা আধুনিক বা উত্তরাধুনিক কবিতা বলে যে-কাব্য-চর্চায় নিয়োজিত আছেন, তাও এক সময় পুরোনো কবিতা বলে বাতিল হয়ে যেতে পারে। অথবা এগুলো থেকে কোনো একটি বা দুটি ধারা টিকে থাকলে থাকতেও পারে। তখন দশক নয় কয়েকশো বছরের বিস্তৃত সময়কে ঘিরে হয়তো তৈরী হবে একটি যুগ। সে-যুগের নাম নির্ধারণের দায়িত্বও পরবর্তী সময়ের সাহিত্য-চর্চা-কারীদের হাতেই থাকবে। কিন্তু এও সত্যি, কোনো প্রধান কবির উপস্থিতি ব্যতিরেকেই অনেক দশক পার হয়ে গেছে, আবার গত শতাব্দীর স্রেফ তিরিশের দশকে জন্ম হয়েছে বাংলা কবিতার পাঁচজন প্রধান কবির।
বাংলা কবিতার বড়ো বৈশিষ্ট্য গীতিময়তা এবং রোমান্টিকতা। দু-তিনটা মহা-কাব্যের কথা বাদ দিলে বাংলা কবিতার বিস্তীর্ণ চরাচর ঘিরে আছে গীতিময়তা। কাহিনী-কাব্য-সমূহের ভিতর গীতিময়তার বিস্তার দেখা যায়, বৈষ্ণব পদাবলিতে রোমান্টিকতার বিস্তার দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের মানসদেবীর অবয়বে রোমান্টিকতার দ্যুতি লেগে থাকতেও দেখা যায়। ফলে রোমান্টিসিজম অন্য সব ইজমকে হটিয়ে বাংলা কবিতায় প্রধান জায়গা দখল করে রেখেছে। এমনকি বীররস যে-কাব্যের প্রাণ, সে-মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধে’ও রোমান্টিকতার প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার ছন্দে নতুন প্রাণ দিয়েছেন আবার রোমান্টিকতাও ছড়িয়েছেন প্রবল-ভাবে। বাংলা সাহিত্যের সেরা গীতি কবিতাগুলো রচিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়ে। শেষ দিকে তিনি বেশ কিছু গদ্য কবিতা রচনা করেছেন। সে-সব কবিতায়ও গীতিময়তার রোমান্টিক স্পন্দন মনে লাগে। রবীন্দ্রনাথের পর পরই বাংলা কবিতায় প্রভাব বিস্তারকারী কবি কাজী নজরুল ইসলাম উচ্চস্বরের অসামপ্রদায়িক সাম্যবাদের কবিতা লিখেছেন। লিখেছেন গণমানুষের কবিতা। তবু শেষ পর্যন্ত তিনিও রোমান্টিক। আপাদমস্তক। আর জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সে-রোমান্টিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশজতা, প্রকৃতি, পাশে বিচরণশীল প্রাত্যহিক পরিবেশ এবং বাঙালীর জীবনের আরেক রোমান্টিতা- বিষন্নতা। এ-বিষন্নতার আবহ ছড়িয়ে জীবনানন্দ দাশ বাঙালী মানসে এদেশের কবিদের মগজে প্রেমের অবিস্মরণীয় প্রভাব বিস্তার করে গেছেন। তার ধারাবাহিকতা এখনও জাজ্জ্বল্যমান।
তো জীবনানন্দের চিত্রকল্প এবং উপমা সৃষ্টির প্রয়াস এখনকার কবিদের সবচেয়ে বেশি মনঃপুত। কেনো-না, একটা সময়ে কবিতা-চর্চার সঙ্গে ছন্দ-চর্চার বিষয়টি ওতপ্রোত-ভাবে জড়িয়ে থাকলেও এখন ছন্দের ব্যাপারে অনেকে উদাসীন। কেনো-না, এ-সময়ের কবিতায় যেটুকু অলঙ্কার আছে, তা অর্থালঙ্কারের। শব্দালঙ্কার কী এবং শব্দালঙ্কার কেনো, এ-দুটি ব্যাপারই এখন কবিদের মনে আছে। যারা ছন্দ জানেন না, তারা ভাবেন শব্দালঙ্কার ‘কী?’ আর যারা জানেন,। তাদের কাছে শব্দালঙ্কার ‘কেনো?’ এভাবে দুটি প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক ছন্দ আমাদের এ-সময়ের কবিতা থেকে খানিকটা দূরে চলে গেছে। যেটুকু আছে, তাকে কবিতার স্বতঃস্ফূর্ত ছন্দ বলা যায়। তবে স্বতঃস্ফূর্ততাই তো সেরা সৃষ্টি, নাকি? কিন্তু এ-ও জেনে রাখা ভালো, আমরা যে-কবির দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত, সে-জীবনানন্দ দাশ কিন্তু কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ছন্দেই বেশি তৎপর ছিলেন। ওটা যেহেতু শ্রমসাধ্য এবং একই সঙ্গে কবিতার স্বাভাবিক গতিকে অনেক সময় ব্যাহত করে, তাই তাঁর ছন্দ প্রাচুর্য তরুণ কবিদের ভিতর তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
প্রতীকবাদী কবি হিসেবে পরিচিত আলেকজান্ডার ব্লেক রাশিয়ার বিপ্লবের পর বলেছিলেন, ‘বিপ্লবকে শোনো, সর্বাঙ্গ দিয়ে, সারা হৃদয় দিয়ে, তোমার সব মন দিয়ে।’ বলশেভিক বিপ্লবের সে-হাওয়া তখন রাশিয়ার সকল কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এ-ছড়িয়ে-পড়াটাই আসলে একজন কবির সময় ও পারিপার্শ্বিকতা। উদাহরণ হিসেবে এলিয়টের কথাও বলা যায়। তো আমাদের এ-সময়ের কবিরা তাদের কবিতায় পারিপার্শ্বকে উঠিয়ে আনবেন, এই স্বাভাবিক। তবে কবি-ভেদে, কবির আয়োজন-ভেদে তার প্রকাশ হবে ভিন্ন-ভিন্ন, আর এ-ই স্বাভাবিক। যখন একজন কবি তা অনুভব করেন, তখন প্রেমের ভিতরে থেকেই করেন বোধ হয়। সে-প্রেম কি শুধু বায়বীয় কোনো ব্যাপার? বায়বীয়তা আস্তে-আস্তে একটা শরীর হয়ে যায়। একটা শরীর ধীরে-ধীরে পূর্ণ একটি সত্তার জন্ম দেয় বোধ হয়। আর চারপাশের ব্যস্ত মানুষের বিচিত্র মুখ হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া একটা বিস্ময়-জাগানিয়া মুখ একজন তরুণ কবির হৃদয়কে আলোড়িত করবে না, তো আলোড়িত করবে তেমন হৃদয় পৃথিবী পাবে কোথায়? তারপর লোভ, অস্থিরতা, রাজনীতি, ক্ষমতা-প্রহসন, ভণ্ডামি, সামরিক শাসনের মূর্খতা, বর্বরতা, বিকাল-হতাশার, সন্ধ্যা-ধূর্ত, অন্ধকার-নিঃসঙ্গ ইত্যাদির সঙ্গে জীবিকার প্রত্যাশা ও ব্যর্থতা অভ্যন্তরে নানাভাবে আয়োজন করে প্রকাশের। এসবই কম-বেশি আমাদের কবিতায় আসছে গত কয়েক দশক ধরে। আর কতো-কতো বিষয়, কতো-কতো ভাবনা প্রতিদিন কবি তার মগজ থেকে উগড়ে দিচ্ছে, তার কী ইয়ত্তা আছে? কবিতা তো সর্বগ্রাসী এক চিজ। সে সব কিছুই গলধঃকরণ করে। তাই কয়টা দৃশ্যের, কয়টা বিষয়ের কথা বলা যাবে। যা আসছে, গত কয়েক দশক ধরে একই প্রায়। তবে একটু-একটু করে বিষয় বদলাচ্ছে। একটু-একটু করে বলার ক্ষেত্রে, ভিন্ন ভিন্ন উপমা, চিত্রকল্প সৃষ্টি করার প্রয়াসটুকুও তৎপর রয়েছে।
শূণ্য দশকের কবিতার বয়স খুব বেশি নয়। আট-নয়। সুতরাং আঙ্গিক তৈরীর ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছার উপায় নেই। শুধু অনুভব করা এবং অনুভূতি থেকে কিছু আনন্দ বা ব্যর্থতার স্মৃতি আহরণ করার চেষ্টাটুকু থাকবে পাঠক হিসেবে। আর কবির চরিত্র আবিষ্কারের কথা এলে চল্লিশ দশকের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলা কথাটিই উল্লেখ করতে হয়, ‘কর্মীর দৃষ্টি অনেকটা অর্জুনের মতো, তিনি শুধু একটি পাখীর চোখেই দেখতে পান। কবির দৃষ্টি যুধিষ্ঠিরের, তিনি শুধু পাখির চোখেই দেখেন না, তার চারপাশের মানুষ, গাছপালা, মাঠ, সবকিছুই দেখেন। সুতরাং তিনি কী দেখেন অথবা কী বলতে চান, তা একটিমাত্র কবিতার উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যায় না।
তাই আমাদেরও অপেক্ষা করতে হবে এ-সময়ের কবিরা যারা সবে লিখতে শুরু করেছেন, তারা কী লিখছেন বা কী লিখতে চাচ্ছেন তা দেখার জন্য।
ফারুক আহমেদঃ লেখক | original source