প্রধানমন্ত্রীর যত ভুল – সৈয়দ বোরহান কবীর

প্রধানমন্ত্রীর যত ভুল – সৈয়দ বোরহান কবীর

ড. আহমেদ শরীফ বলেছিলেন, ‘আমরা এমনই দুর্ভাগা জাতি, জীবিতকালে কাউকে সম্মান জানাতে পারি না, কেবল তিরস্কার করতে পারি, মৃত্যুর পর আমরা কেবল প্রশংসার ফুলঝুড়ি ছড়াই।’ বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রয়াত এই শিক্ষকের বাণীটি সত্য, বিডিআরের ঘটনায় আরেকবার প্রমাণিত হলো। দুইমাস বয়সী একটা সরকার বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এরকম একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করলো, দেশকে গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচালো, অথচ সরকারের প্রশংসা না করে আমরা অনেকেই শুধু ভুল খুঁজছি। কাঠগড়ায় প্রধানমন্ত্রী এবং দুইমাস বয়সী মহাজোট সরকার।

‘কী করিলে কী হইতো।’ গ্রন্থ খুলে সমালোচনার বাকবাকুম করছেন অনেকে। প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন, এই ঘটনায় যে সেনা কর্মকর্তাদের মৃত্যু হয়েছে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এটা হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী। এই মৃত্যু অনাকাক্সিক্ষত। কিন্তু এর জন্য যে, সরকার কোনোভাবেই দায়ী নয়। এটা বুঝেও অনেকে না বোঝার অভিনয় করছেন। সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীকে সমালোচনা করাই যেন তাদের একমাত্র লক্ষ। যারা আজ সমালোচনা করছেন, তাদের কাছে আমি বিনীতভাবে জানতে চাই, এতবড় ঘটনার গোয়েন্দা ব্যর্থতা আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি কেন? কেন গোয়েন্দারা এই ঘটনার এতটুকু আগাম খবর জানাতে পারল না? এই ব্যর্থতা কি সরকারের? আমাদের সেনাবাহিনী একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। সেনাবাহিনীর কতজন অফিসার, কার কোথায় কর্মস্থল তা এক নিঃশ্বাসে বলা যায়। ঘটনার দিন থেকে ৭ দিন পর্যন্ত কেন বলা হল ৭২ জন অফিসার নিখোঁজ? হঠাৎ করে নিখোঁজ অফিসারের সংখ্যা ৫ জনে নামিয়ে আনা হলো কেন? তাহলে বাকি ৬৭ জন অফিসার কোথায় ছিলেন? তারা কি পালিয়েছিল? তাহলে তো তারা ঘটনার আসল সত্য বলতে পারবেন। তাদের অবিলম্বে সামনে আনা হোক। নাকি এই ৬৭ জন আসলে কাল্পনিক, তরুণ সেনা অফিসারদের উত্তেজিত করতেই এই ‘সংখ্যা সন্ত্রাস’ ছড়ানো হয়েছিল?

এই ঘটনায় সেনাকর্মকর্তারা আবেগতাড়িত হয়েছেন, উত্তেজিতও হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সামনে এই উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশও ঘটিয়েছেন, সেনাকুঞ্জের দরবারে। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু ঐ কথোপকথনের টেপ বাজারে ছাড়লো কারা? কারা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিল সারা বিশ্বে? সেখানে তো প্রধানমন্ত্রী এবং কৃষিমন্ত্রী ছাড়া সরকারের আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। আমাদের সেনাপ্রধান তার সর্বশেষ প্রকাশিত বিতর্কিত গ্রন্থে গর্ব করে বলেছেন, সেনাবাহিনীর প্রতিটি অফিসার এখন কম্পিউটারে দক্ষ। তারাই কি এটা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে? এটা কি গর্হিত, জঘন্য এবং নিুমানের সরকারবিরোধী তৎপরতা নয়? এটা কি তথ্যসন্ত্রাস নয়? এজন্য কি সেনাবাহিনীতে কোনো তদন্ত কমিটি হয়েছে? কোনো শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?

যারা এটা ইন্টারনেটে ছেড়েছিল তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানমন্ত্রীকে জাতির সামনে বিব্রত করা। কিন্তু হায়, নাবালক বালকেরা জানত না, তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, ‘জাতির জনকের কন্যা’। অসীম সাহস নিয়ে তিনি সেদিন সব বক্তব্য শুনেছেন, সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ধীরস্থির শান্তভাবে তিনি যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন, তা আর কেউ পারত কিনা আমার জানা নেই।

২৫ ফেব্র“য়ারি নিয়ে ঘটনাবলিতে, আমার কাছে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো এই ঘটনা ছিল সরকারের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাদের পরিকল্পনায় কয়েকটা ধাপ ছিল। ২৫ ফেব্র“য়ারির ঘটনার পর তারা আশা করেছিল, প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে সেনা অভিযানের নির্দেশ দেবেন। সেনা অভিযানে মারা যাবে শত শত মানুষ। এই অভিযানের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে, শুরু হবে গৃহযুদ্ধ। একপর্যায়ে একটি বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে আসা সরকার সেনাবাহিনীকে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় দায়িত্ব দেবে। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে গণতন্ত্রের নবযাত্রা। প্রধানমন্ত্রী তাদের জন্য, এটা তো আপনার ভুল। আপনি তাদের নিখুঁত পরিকল্পনা এভাবে ভেস্তে দিলেন?

ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীকে সেনাকুঞ্জের দরবারে যেতে বারণ করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী যদি দরবারে না যেতেন, সেনা অফিসাররা, বিশেষ করে তরুণরা হয়তো উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠত। সেনাবাহিনীতে শুরু হতো বিশৃঙ্খলা। নিয়ন্ত্রণ হারাতো রাজনৈতিক সরকার। বিপন্ন হতো গণতন্ত্র। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেখানে গেছেন। ভাষণের পর এসএসএফ প্রধানমন্ত্রীকে সেনাকুঞ্জ থেকে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেই পরামর্শ উপেক্ষা করে সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুনেছেন। এতে সাধারণ সেনা অফিসাররা প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার প্রমাণ পেয়েছেন। যারা ষড়যন্ত্র চেয়েছিল, তাদের চোখে তো এটা ভুলই। মোবাইলে যারা ঐ দরবারের কথাবার্তা রেকর্ড করেছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী এবং সরকরের ইমেজ নষ্ট করা। কিন্তু সাধারণ মানুষ এসব শুনে প্রধানমন্ত্রীর ধৈর্য এবং সহনশীলতায় মুগ্ধ হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ বেড়েছে। পরিকল্পনার এই অংশও ভেস্তে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এটাও তো আপনার আরেক ভুল।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন সময় নানা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন মহল উসকানি দিয়ে সেনাবাহিনীতে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে, রক্তাক্ত হয়েছে সেনাবাহিনী। হত্যা হত্যাই। মর্মান্তিক, বেদনাদায়ক, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আমি জানতে চাই, কর্নেল জামিলকে যখন হত্যা করা হয়, তখন কি সেনা অফিসাররা এতটুক বেদনাহত হননি? তারা কি চেয়ার উঁচিয়ে তৎকালীন সরকারপ্রধানকে বলেছিলেন বিচার চাই? কর্নেল তাহেরের প্রহসনের বিচারের সময় কি তারা বলেছিলেন, কেন এই প্রহসন? জেনারেল মঞ্জুরকে যখন পশুর মতো গুলি করা হলো, মারা হলো আরো ১৭ জনকে তখন কি কেউ বলছিল ‘বন্ধ করুন এসব?’ এরা আমাদের ভাই। এতে সেনাবাহিনীর অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে? অতীতের ঘটনার চেয়ে এবারের ঘটনার মূল পার্থক্য হলো, এই ঘটনায় সামরিক আধিপত্যের বদলে রাজনীতির প্রজ্ঞার জয় হয়েছে। অস্ত্রের বদলে গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এজন্য অনেকেই সমালোচনা করছেন, অনেকেই ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। অনেকেই খুঁজছেন প্রধানমন্ত্রীর যত ভুল। আসল সত্য হলো, এই যুদ্ধ ছিল গণতন্ত্রকে হত্যা করার, এই যুদ্ধ ছিল, রাজনীতিকে আবার নির্বাসনে পাঠানোর। যারা এবার পরাজিত হলো, তাদের চেহারা উš§াচিত না হলে, কাল আবার তারা নতুন নাটক সাজাবে। কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, প্রধানমন্ত্রী ঘুমান কীভাবে? আমি বিনীতভাবে বলতে চাই তাদের জানা উচিত, ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি রাত কাটে বুক ভারি করা কান্না আর হাহাকার নিয়ে। প্রিয় পিতার মুখ, মায়ের উৎকণ্ঠিত চেহারা, ছোট ভাই রাসেলের নিষ্পাপ আকুতি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। শুধু এদেশের মানুষের জন্য এত শোকের ভার তিনি আজো বয়ে বেড়াচ্ছেন। যারা এসব লিখছেন, তারা কি কখনো কল্পনা করতে পারেন, সব হারিয়ে একজন মানুষ আজো কীভাবে বেঁচে আছেন? প্রধানমন্ত্রী আসলে ঘুমান না, তিনি এমন একটা সকালের অপেক্ষায় থাকেন যে সকালে এসব হত্যা, ষড়যন্ত্র আর রক্তের হোলি খেলা বন্ধ হবে। ক্ষমতার জন্য এভাবে নিরীহ সামরিক-বেসামরিক মানুষকে অকাতরে জীবন দিতে হবে না। তেমন একটা সকালের অপেক্ষায় আমরাও।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত | original source


Place your ads here!

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment