তাজউদ্দীন আহমদ: যুদ্ধদিনের কাণ্ডারী
মে মাসের ১ তারিখ, ১৯৭১ সাল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নূরুল আজীম, তার বড় ভাই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র আনোয়ার আজীম এবং এই দুজনের সরকারি চাকুরে বাবাকে পাকিস্তান আর্মিরা তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে ধরে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় বাহাদুরাবাদ ঘাটের পাশে আর্মিক্যাম্পে। প্রতিদিন কিছুক্ষণ পরপর এই মানুষগুলোর ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। শরীর যখন আর নির্যাতন সইতে পারে না, এলিয়ে পড়ে মাটিতে, পাকিস্তানি সেনারা তখন আধমরা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে আনন্দে ফেটে পড়ে। বিশ্রাম নিতে বসে তারা কাছাকাছি। চলতে থাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা মানুষগুলো শুনতে পায় ওদের কথা। ওদের সমস্ত রাগ ছাত্র আর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর।
একেক সময় ওরা চুলের মুঠি ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘জানিস, তোদের নেতা তাজউদ্দীন যে হিন্দু? ওর নাম ত্যাজারাম সিং। এই লোকটা ভারতের গুপ্তচর। আট বছর বয়সে নাম পাল্টে তাজউদ্দীন নাম রেখেছে। তারপর আস্তে আস্তে সে আওয়ামী লীগে ঢুকে পাকিস্তানকে ভাঙার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তোদের মতো লেখাপড়া জানা ছাত্রদের মাথা খারাপ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ, যার মূল ষড়যন্ত্রকারী তাজউদ্দীন। পাকিস্তানকে ভাঙতে চায় সে, কারণ সে হিন্দু।’ তাজউদ্দীনের প্রতি আক্রোশ আর ঘৃণায় পাকিস্তানি সেনাদের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে।
আর মাত্র কিছু দিন পর, প্রকৌশলী হবে, স্বপ্নে বিভোর ছিল যে ছেলেটি, নির্যাতনের কষ্ট সইতে পারে না সে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আনোয়ার আজীম মে মাসের ৬ তারিখে। অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেন অন্য দুজন।
৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। বাংলা একাডেমীতে বসে কাজ করছিলেন সরদার ফজলুল করিম। পাকিস্তানি সেনারা লাথি মেরে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলে ছোটখাটো দৃঢ় এই মানুষটিকে। নিয়ে যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। তাঁর ওপর চলতে থাকে সীমাহীন অত্যাচার। অকথ্য গালাগাল মুক্তিযুদ্ধ নামক বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। তাদের মস্ত আক্রোশ যেন তাজউদ্দীনের ওপর। তাঁর জন্যই পাকিস্তানের এই দশা।
তাজউদ্দীন আহমদের শ্বশুর অধ্যাপক সৈয়দ সিরাজুল হক ২৫ মার্চ ১৯৭১, মেয়ের বাসায় যান দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে। রাতে আর ফিরে যাওয়া হয় না। সেই রাতে তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে আক্রমণ করে পাকিস্তান আর্মি, তিনি নজরবন্দী হয়ে যান তাদের হাতে। তারা ধারণা করে, এই মানুষটির যাতায়াত অনুসরণ করলে হয়তো তাজউদ্দীনের পরিবারের খোঁজ পাওয়া যাবে। এই বাড়িতে আর্মি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এখানেই একটি রুমে থাকতে দেওয়া হয় তাঁকে। সামরিক বাহিনীর লোকজন প্রায়ই এসে তাজউদ্দীন আহমদের শ্বশুরকে জিজ্ঞাসা করত, কীভাবে তিনি একজন সৈয়দ মানুষ হয়ে তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের শত্রু হিন্দু ত্যাজারাম সিংয়ের সঙ্গে। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, তাজউদ্দীন আহমদ আসলে ত্যাজারাম সিং— ভারতীয় গুপ্তচর। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিবাহিনী এ সবই পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্র।
১৯৭১ সালে ড. কামাল হোসেনকে আটক করে রাখা হয় পাকিস্তানে। গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা জেরা করার সময় তাঁর কাছ থেকে নানাভাবে জানতে চায় তাজউদ্দীন সম্পর্কে। ওরাই কখনো বলে, সে হিন্দু, নাম লক্ষ্মণ সিং। আবার নিজেরাই বলে বসে, তাজউদ্দীন আসলে শিখ মেজর। ওর আসল নাম মেজর ত্যাজারাম সিং। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় তাঁকে ভারত এই দেশে প্যারাস্যুট লাগিয়ে নামিয়ে দিয়ে গেছে। এই কথা শুনে ড. কামাল হোসেন বলতে চেষ্টা করেন, তিনি তাজউদ্দীনকে ভালোভাবে চেনেন। তিনি যে স্কুলে পড়তেন, তাজউদ্দীনও সেই একই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সেন্ট গ্রেগরীজের রি-ইউনিয়নের অনুষ্ঠানগুলোতে তিনি তাঁকে প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে দেখেছেন। তিনি তাদের বলেন, নিশ্চয়ই কেউ তাজউদ্দীন সম্পর্কে তাদের এসব নির্জলা মিথ্যা কথা বলে তামাশা করেছে।
ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলি খানের বাংলা অনুবাদ বইটির নাম বাংলাদেশের জন্ম। এই বইয়ের ৬৬ পৃষ্ঠায় তাজউদ্দীন সম্পর্কে তাঁর মনোভাব লিখেছেন—তাজউদ্দীন, গোঁড়া ভারতপন্থী আওয়ামী লীগার…। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে এবং সম্ভবত পাকিস্তানকেও ঘৃণা করতেন। তিনি আট বছর বয়স পর্যন্ত হিন্দু ছিলেন বলে একটি প্রচারণা ছিল। আমি গল্পটিকে সত্যি মনে করি না। কিন্তু তাঁর মানসিক গঠনে এর যথেষ্ট প্রকাশ ঘটত।
২.
১৯৭১ সালের নয় মাস পাকিস্তান সামরিক শক্তির কাছে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল মুক্তিবাহিনী। এই মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করা থেকে শুরু করে ন্যায়ের পক্ষে ভারতীয় সহযোগিতা আদায় করা, সেই সময় অন্যতম বৃহত্ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সম্পূর্ণ সমর্থন পাকিস্তানের পক্ষে থাকার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভে সমর্থ হওয়াসহ মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে। এই নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী থাকায় তাদের সমস্ত ক্রোধ এবং আক্রোশের মূল মানুষে পরিণত হন তাজউদ্দীন আহমদ।
মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যে ষড়যন্ত্রের যে জাল ছিন্ন হয়ে যায়, আবার তা বোনা শুরু হয় স্বাধীন দেশে। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ নির্মমভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের উল্টো স্রোতের দিকে টেনে নেওয়ার গভীর চেষ্টা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেপ্তার করে গৃহবন্দী করা হয়। এক সপ্তাহ পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে বন্দী করে রাখা হয়। বন্দী করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ আরও অনেক নেতাকে। বাংলাদেশ যেন আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, তাই ’৭১-এর পরীক্ষিত চারজন নেতাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায়, বন্দী অবস্থায় কারাগারের ভেতর হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, প্রথম অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং প্রথম স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে।
আজ ৩ নভেম্বর। আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মহান এই চার জাতীয় নেতাকে।
৩.
সবশেষে ২০০৯ সালের শেষ প্রান্তের বাংলাদেশে তাজউদ্দীন আহমদকে মনে করতে চাই তাঁরই রেখে যাওয়া কিছু কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে, যা বর্তমানেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
ক. ১৯৭২ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে ঢাকা সদর উত্তর সাবডিভিশনের (বর্তমান গাজীপুর জেলা) এসডিও নিযুক্ত হন শাহরিয়ার ইকবাল। প্রথম দেখায় নানা প্রসঙ্গে কথার পর তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে বলেন, ‘আমার কোনো আত্মীয়স্বজন পরিচয়ে কেউ যদি কোনো কাজের তদবির নিয়ে আপনার কাছে আসে এবং আপনি যদি মনে করেন কাজটি সঠিক, তারপরও কাজটি করবেন না। প্রয়োজনে আপনি আমাকে যেকোনো সময় ফোন করবেন, কিন্তু আমাকে না জানিয়ে আমার আত্মীয় পরিচয়ের কারও কোনো কাজ করবেন না।’
খ. বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় তাজউদ্দীন আহমদ যখন অর্থমন্ত্রী, তখন তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হামিদুল্লাহ সাহেবকে বলে দিয়েছিলেন, ‘দেশের অর্থনীতির ব্যাপারে প্রতিদিনের রিপোর্ট আমাকে এক দেড় পৃষ্ঠার মধ্যে টাইপ করে পাঠাবেন। যেন আমি পুরো চিত্র পাই। এখানে কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা করবেন না। কখনো আমার সন্তুষ্টির জন্য চেষ্টা করবেন না। সঠিক চিত্র পেলে আমি সংশোধন করার চেষ্টা করতে পারব।’
গ. আবুল মাল আবদুল মুহিত (বর্তমান অর্থমন্ত্রী) সাহেবের একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ঘনিষ্ঠভাবে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে দেখেছেন প্রচণ্ড রকমের আত্মসমালোচনায় বিশ্বাসী একজন মানুষ হিসেবে। তাজউদ্দীন আহমদ বলতেন, ‘আমরা দেশ শাসন করছি, দেশের মঙ্গল চাই, কাজেই আমাদের দুর্বলতা আছে, এগুলো মানা উচিত। স্বীকার করা উচিত। আমরা তো সব জানি না, তাই শিখতে হবে।’
ঘ. তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রী ছিলেন যত দিন, সাধারণত প্রতিদিনের ফাইল সে দিনই প্রয়োজনীয় নিদের্শনা দিয়ে ছেড়ে দিতেন। অর্থসচিব কফিলউদ্দীন মাহমুদ একবার লক্ষ করলেন, তিন-চার দিনের বেশি হয়ে যাচ্ছে একটি প্রমোশনের ফাইল ফিরে আসছে না। এমন সময় তাজউদ্দীন আহমদ কফিলউদ্দীন মাহমুদকে ডেকে পাঠালেন। টেবিলের ওপর সেই ফাইলটি রাখা। তিনি ফাইলটি দেখিয়ে বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই এই ফাইলটির বিষয়ে ভেবেছেন।’
হ্যাঁ-সূচক উত্তর শুনে তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘২৫ মার্চ রাতে আমার স্ত্রী ছোট ছেলে আর মেয়েটিকে নিয়ে ভাড়াটিয়া সেজে পাকিস্তান আর্মির হাত থেকে রক্ষা পায়। ২৬ তারিখ আমাদের বাসার দেয়াল টপকে এদিক-সেদিক দুই রাত থেকে একপর্যায়ে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে যান। তিনি বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেন না। তিনি আমার স্ত্রীকে আরও নিরাপদ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে রাস্তার সামনে গিয়ে বলেন, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি চাবি ফেলে এসেছি। চাবিটা নিয়ে এক মিনিটের মধ্যেই আসছি। তিনি যে ভেতরে গেলেন আর দরজা খুললেন না। আমার স্ত্রী নিরুপায় হয়ে রাস্তার পাশে রাখা ইটের পাঁজার পেছনে ছোট বাচ্চা দুটিকে নিয়ে লুকিয়ে রইলেন বাইরে, তখন কারফিউ।’ ‘সেই ভদ্রলোকের প্রমোশনের ফাইল এটি। আমি কয়েক দিন চিন্তা করলাম। আমার ব্যক্তিগত বিষয় তাঁর সারা জীবনের এই চাকরির প্রমোশনের বিষয়ের সঙ্গে জড়ানো ন্যায়সংগত কাজ হবে না। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার একান্তই আমার।’ তিনি তাঁর প্রমোশনের সুপারিশ অনুমোদন করে দিয়েছেন।
কফিলউদ্দীনের মনে হলো, আমরা গল্পে-ইতিহাসে অত্যন্ত মহত্ এবং মহান মানুষদের যেসব উদাহরণ পড়ি, এটি তারই একটি। ব্যক্তিগত সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, ক্রোধ, প্রতিশোধ—এগুলোর ঊর্ধ্বে উঠে নৈর্ব্যক্তিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে ক্ষমতা, এটি সেই ক্ষমতা।
ঙ. একবার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম ক্যাবিনেট মিটিং শেষ করে সচিবালয়ের ভেতরেই নিজেদের অফিস বিল্ডিংয়ে ফিরছিলেন। বিল্ডিংয়ের গেটের সামনের পুলিশ তাজউদ্দীন আহমদকে আটকে দিলেন। বললেন, ‘আপনার পরিচয়পত্র দেখান।’ নূরুল ইসলাম তাড়াতাড়ি বলেন, ‘আরে ভাই, করো কী, আমাদের অর্থমন্ত্রী!’ পুলিশ বেচারা সরি বলতে অস্থির। তাজউদ্দীন আহমদের ভ্রূক্ষেপ নেই, তিনি একটু হেসে কথা বলতে বলতে ভেতরে ঢুকলেন। তাজউদ্দীন আহমদ একেবারেই সাধারণভাবে চলতেন।
(তথ্যসূত্র: সাক্ষাত্কার এবং তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা বই থেকে নেওয়া।)
সিমিন হোসেন রিমি: প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা।