বড় ঠেকায় পড়ে গেছে জনগণ – গদ্যকার্টুন আনিসুলহক
অবশেষে বিএনপির মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন কথাটা খোলসা করে বলেছেন। বলেছেন, নির্বাচন কমিশন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখ পিছিয়েছে, তাতে লাভ হয়নি, নিয়ম হলো, বিলখেলাপি বা ঋণখেলাপি যদি নির্বাচন করতে চায়, তাকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার অন্তত ১৫ দিন আগে খেলাপি বিল বা ঋণ শোধ করতে হবে। ৯ তারিখ থেকে ২০ তারিখ। আছে আর মাত্র ১১ দিন। এর মধ্যে ঋণ বা বিল শোধ করা হবে কখন, আর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে ১৫ দিন সময়টা পাওয়া যাবে কোত্থেকে! তার চেয়ে নিয়ম পাল্টান, বলুন, আগের দিনেও যদি কেউ ঋণ বা বিল হালনাগাদ করেন, তাহলে তিনি প্রার্থী হতে পারবেন।
বটে। আমাদের জাতীয় সংসদের সদস্য হতে চান যাঁরা, তাঁরা তাঁদের খেলাপি ঋণ বা বিল শোধ করবেন তখন, যখন তাঁরা জানবেন যে এ না হলে তাঁরা প্রার্থী হতে পারবেন না। আর যাঁরা ভোট করবেন না বলে ঠিক করেছেন, তাঁরা আর তাঁদের ঋণ বা বিল শোধ করতে যাবেন কোন দুঃখে?
এই হলো আমাদের প্রার্থী হতে ইচ্ছুক নেতাদের হাল। তাঁরা সবাইকে বলবেন, ঋণ শোধ করো, বিল বকেয়া রেখো না, আর নিজেরা সেটা স্বেচ্ছায় যথাসময়ে শোধ করবেন না। কেন করবেন? তাঁরা যে আমাদের নেতা! তাঁরা আছেন বলেই না আমরা আছি। নেতা না থাকলে কি দেশে জনগণ বলতে কোনো বস্তু থাকত!
নির্বাচন কমিশন প্রার্থিতার শর্ত একেবারে সরল-সহজ করে ফেললেই পারে। কোনো প্রার্থীকেই কোনো রকমের বিল বা ঋণ শোধ করতে হবে না। কোনো মামলায় কারও শাস্তি হয়েছে কি হয়নি, সেসবও দেখা হবে না। কারণ এঁরা জনসেবক। জনপ্রতিনিধি। জনগণ যদি কোনো বিলখেলাপি বা ঋণখেলাপিকে ভোট দেয়, তাহলে কমিশন আপত্তি করার কে? গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ জনগণের ইচ্ছাকে ঠেকাবে কী করে?
ঋণখেলাপি-বিলখেলাপি তো আর কারও টাকা মেরে দিচ্ছে না। জনগণের টাকা মেরে দিচ্ছে। কেউ বলতে পারবে, মোবাইল ফোনের গ্রাহক বিলখেলাপি হয়েছে? ওটা ঠিক সময়ে সবাই দেয়। নেতারাও দেন। কিন্তু সরকারি ফোনের বিল ওনারা কেন দেবেন? যাঁরা সংসদে বিল উত্থাপন করতে পারবেন, বিলের ওপর আলোচনা করতে পারবেন, তাঁরা কেন নিজেদের ফোনের বিল বা বিদ্যুৎ বিল শোধ করবেন? জনগণের টাকা তাঁরা ব্যাংক থেকে নিয়েছেন। এটা কেন তাঁরা শোধ করবেন? তাঁরা যে জনগণের প্রতিনিধি হবেন, জনগণের টাকা তো তাঁদেরই টাকা। ওই টাকা নেওয়ার, ভোগ করার এবং শোধ না করার অধিকার বিলকুল তাঁদের রয়েছে। সেই অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা জনগণের অধিকার হরণ করারই শামিল।
আর এ বিষয়ে ডান-বাম, সরকারি, বিরোধী দল কোনো পার্থক্য নেই। সাংসদদের ভাতা বাড়ানোর বিলে যেমন কোনো আপত্তি ওঠে না, তেমনি আগামীকালই সংসদে বিল উঠুক, মাননীয় সাংসদদের আর কোনো বিল শোধ করতে হবে না, সবাই মিলে সেটা টেবিল চাপড়ে সমর্থন করবেন। তখন আর আওয়ামীতে বিএনপিতে, ডানে, বামে কোনো পার্থক্য থাকবে না।
যা-ই হোক, আমরা চাই আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিক। সামান্য বিল বা ঋণ-খেলাপ গণতন্ত্রের পথে তাঁদের এই মহান যাত্রা তথা আত্মত্যাগের পথে বাধা হয়ে উঠুক, আমরা সেটা চাই না। কাজেই তাঁরা যা চান, আপনারা তাঁদের তা-ই দিন। তবু আমরা চাই তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিন। আর এর ফলে কিছু পরিমাণ ঋণ যদি শোধ হয়, কিছু বিল যদি পরিশোধিত হয়, সেটা আমাদের জন্য বাড়তি লাভ হিসেবে গণ্য হবে।
আমরা একটা অদ্ভুত চক্রের মধ্যে পড়েছি। আমরা ভোট দিয়ে যাঁদের নির্বাচিত করব, তাঁরা বিল শোধ করবেন না, ঋণ শোধ করবেন না। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এলাকায় শুধু নন, সারা দেশে একেকটা এমন নাম হয়ে উঠবেন, যাঁদের ভয়ে বাঘে-হরিণে এক ঘাটে জল খাবে। তিনিই হয়ে উঠবেন পুলিশ, তিনিই বিচারক। তাঁরা হবেন আইনপ্রণেতা, তবে নিজেরা আইন মানবেন না। আইনই তাঁদের মেনে চলবে। তাঁরা আমাদের শিক্ষানীতি দেবেন, শিক্ষাও দেবেন, কিন্তু তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। একাডেমিক শিক্ষাই একমাত্র শিক্ষা নয়, রবীন্দ্রনাথের মতো কেউ কেউ নিশ্চয়ই থাকবেন, যাঁদের প্রজ্ঞার কাছে নত থাকবে পুরো সভ্যতা, কিন্তু তাই বলে তাঁদের সবাইকেই কি রবীন্দ্রনাথ হতে হবে? হ্যাঁ, আপনারা যদি তাঁদের এসব দাবি না মানেন তাহলে তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না। অতএব তাঁদের জন্য সাত খুন পর্যন্ত মাফ করে দেওয়া হোক। সাত হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত তাঁরা ঋণ খেলাপ করতে পারবেন−নিয়ম করে দিন। ঢেউটিন তো ঢেউটিন, তাঁরা যদি বঙ্গভবনটাও লুটে খান, তাহলেও তাঁদের প্রার্থিতা বাতিল করা যাবে না। তবু তাঁরা ভোটে আসুন। এবার আমরা বড় ঠেকায় পড়েছি, ওনাদের দিয়ে ভোট করাতেই হবে। ঠেকা আমাদের, ওনাদের তো নয়। আমাদের কপালে আরও কত প্রকারের অপমান যে লেখা আছে!
হায়, কবে আমরা সভ্য হব, ভব্য হব, গণতন্ত্রের উপযুক্ত হয়ে উঠব! আমাদেরই দোষ! কারণ প্রবাদ আছে, যে জাতি যে রকম, সেই রকম নেতৃত্বই তারা লাভ করে। আমরাই তো এঁদের নেতা বানিয়েছি। দোষ আমাদের। কৃতকর্মের ফল তো আমাদের ভোগ করতেই হবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। | original source