তৃতীয়া
বিকেলের দিকে ঝেঁপে এক পশলা বৃষ্টি হ’ল। দুপুরে খাবার পর মরণ ঘুম পেয়েছিল সুমি’র। ঘরে আর কেউ ছিল না। বারান্দার কাপড় গুলো ভিজেছে। তাই নিয়ে আণ্টি, ফারজানা, সবিতা, ববিতা আর বাকি হারামজাদীরা কত কথা শোনালো! কিল থাপ্পর তো রোজকার। রোজ কাজে বেরও, ঘরে ফিরে মাগিদের বাসনকোসন সাফ কর, কাপড় কাচ, আর তারপর গালিগালাজ আর মার হজম কর। সুমিও কম যায়নি। ইচ্ছে মত খিস্তি করে ঝাল মিটিয়েছে। কাপড় কি ওদের একার ভিজছে, তারও তো ভিজেছে। দুঃখে কষ্টে ঘর থেকে বেরিয়েছে। কোথাও যাওয়ার থাকলে একেবারেই চলে যেত। কিন্তু কোথাও যাওয়ার নেই। তার জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকে না।
হাঁটতে হাঁটতে হাতিরঝিলের ব্রিজে উঠে আসল। আজ সাজগোজ, ভাল কাপড় কিছুই পরেনি। দু’চোখে রাজ্যের বিতৃষ্ণা। তবু না তাকিয়েও বুঝতে পারে, কিছু চোখ চেয়ে রয়। ঐ চোখ গুলোয় কি আছে তা তার মুখস্ত। আজ ইচ্ছে করে না, তেড়ে গিয়ে কথা শোনাতে।
ব্রিজের একধারে বসে থাকে সে। মায়ের মুখটা বড্ড মনে পড়ছে। বেশিক্ষণ ভাবতে ভাল লাগে না। মা তাকে পেয়ে খুশি হয়নি কখনও। মায়ের লজ্জা, কষ্টের কারণ ছিল সে। যেদিন সে চলে গিয়েছিল সেদিন থেকে হয়ত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল।
মাকে চিঠি লিখেছিল একবার। জবাব পায়নি। তারপর সেবার ঈদে যখন অনেক লজ্জা নিয়ে বাড়ি গেল, বড় ভাইজান মায়ের সামনে কত অপমান করল। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। মা কিচ্ছু বলল না। কি বলবে, কেন বলবে!
অভিমানের পোকা গুলো এখন আর আগের মত কিলবিল করে না, কিন্তু মাঝে মাঝে থেকে থেকে গর্ত থেকে উঁকি দেয়। তখন দাঁতে ইচ্ছে মত গুল ঘসে। আজ তাও নেই। এখন ঘরে থাকলে, সবিতা রাজ্যের গল্প শোনাত। বাজারে কোন লোক কি বলছে আর সে কি জবাব দিয়েছে। শুনলে হাসি পায়।
হাসতে খুব ইচ্ছে করছে সুমির। কিন্তু আজ কিছুই ভাল লাগছে না। আণ্টি তো তাকে ভাল জানে। আজ সেও…। চিন্তায় বাধ সাধল একটা পুলিশ। “ যাহ, ওঠ, এখানে কি করস? ভাগ!”
আজ কোনও প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া করতেও ইছছা করছে না।
হঠাৎ খুব ক্ষুধা লাগছে। নিজের ডেরায় ফিরবে? নাকি কারো কাছে হাত পাতবে। হাত তো রোজ ই পাতে। হাত পাতা তার কাছে কোন ব্যাপার না। কিন্তু যদি কেউ ঝামেলা করে? শরীর মন অবসন্ন হয়ে আছে। নতুন ঝামেলা নিতে রাজি নয় সুমি।
তাই বলে এখনই ঘরে ফিরতে মন চাইছে না।
এক বাদাম ওয়ালা টুকরি পেতে বসেছে। কাছে গিয়ে সুমি হাত পাতে, “ দুটাকার বাদাম দিবা, আমার কাছে পয়সা নাই। বাদামওয়ালা, দাঁত খিচিয়ে বলল, “যা যা, খবরদার, ব্যাবসা নষ্ট করবি না।“ সুমি আশে পাশে তাকায়। প্রেমিক প্রেমিকারা বসে আছে। সন্ধ্যা নামি নামি করছে। এর মধ্যে বাদাম কুটকুট করছে আর হাতাহাতি, অসভ্যতা সব চলছে বাদামওয়ালা কে ঘিরে। সুমি মাঝে মাঝে চোখ ফেরাতে পারে না। তার গহীন গোপন স্বপ্নে এক রাজারকুমার আছে। তার সাথে যদি কখনও এমন অসভ্যতা ভাগ্যে জুটত!
একবার এক এন,জি,ও থেকে রাজপুত্রের মত এক মানুষ এসেছিল। কত সুন্দর করে কথা বলে, ভালবাসা , মমতা, দু চোখে মুখে ঝরে পড়ে। সুমি প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। রাতের পর রাত সেই মানুষটি তার বুকের ভেতর সিংহাসনে বসে তার মনের রাজ্য শাসন করেছে। শেষের দিকে মানুষটা বুঝে গেল। তারপর থেকে আর আসত না। সুমি-ই বোকামিটা করে ফেলেছিল, পরন্ত বিকেলে মানুষটার হাত ধরে। প্রেমের স্পর্শ টের পাওয়া যায়। দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে আসতেই পেটটাও মুচড়ে ওঠে।
মাটিতে একটা আধ খাওয়া বাটার বন পড়ে আছে। সুমি আকুল হয়ে তুলে নিয়ে কামড় বসায়।
শহরের হলুদ বাতি গুলো জ্বলে গেছে। বড় মহোনীয় লাগে । আকাশ আর সোডিয়াম আলো কত সুন্দর করে ঢেকে দেয় অপূর্ণতা, কলুষতা আর অপ্রাপ্তি। ক্ষণিকের সেই মুগ্ধতা সম্বল করে, ক্লান্ত পায়ে, অনির্দিষ্ট গন্তব্যে, হেঁটে যায় এক শিখণ্ডী।
নায়না শাহরীন চৌধুরী
Related Articles
স্মৃতি
আমার নীলাম্বরী আজ আসমানি রঙের হাল্কা থ্রিপিস পরে আছে, যেন একখন্ড আকাশ! নৌকার গলুইয়ে বসে পা ঝুলিয়ে দিয়েছে। আমায় ডেকে
অসম্পূর্ণ সকাল
সকালের চাক ভাঙ্গা রোদ গায়ে মাখতে বেলকুনিতে দাঁড়ালাম। সচরাচর এই সময়টায় আমি বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে চায়ের সাথে প্রকৃতি পান করি। আমার
স্বপ্ন-বিধায়ক (অন্তরা ১)
মা ছোটোবেলায় সবসময় একটা কথা বলতেন,” বাবা মেয়েদের সবসময় সন্মান করে চলবা, নিজের বোনের মত দেখবা, তুমি একা তোমার তো