News on Canberra Boishakhi Mela
কেনবেরার বৈশাখীমেলায় যা দেখেছি, শুনেছি আর বুঝেছি
ডঃ অজয় কর, কেনবেরা
গত ১৪ই এপ্রিল ২০১২, কেনবেরায় বাংলাদেশ দুতাবাস চত্তরে বাংলাদেশ সিনিওর ক্লাব কেনবেরা ও বাংলাদেশ দুতাবাস যৌথভাবে বৈশাখী মেলার আয়োজন করেছিল। এর আগের বছর গুলিতে এ মেলাটির আয়োজন করত কেনবেরার প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া এসোসিয়েশন কেনবেরা’, যেখানে বাংলাদেশ দুতাবাসের সরাসরি কোন ভুমিকা থাকতো বলে আমার জানা নেই- যতদূর জেনেছি, দুতাবাসের ভুমিকা থাকতো মেলার বিষেশ কোন একটা ইভেন্টের স্পন্সর হিসাবে। সে বিবেচনা থেকে এবারের কেনবেরায় বৈশাখীমেলার ভিন্নতা ছিল।
মেলাকে ঘিরে বাংলা রেডিও কেনবেরা জন্যে একটা বিশেষ অনুষ্টান করার তাগিদেই সারাদিন কাটিয়েছিলাম মেলাতে- ঘুরেছি্লাম মেলার এক স্টল থেকে অন্য স্টলে, আড্ডা দিয়েছি্লাম বন্ধুদের সাথে, মেলা নিয়ে কথা বলেছি্লাম ছোট বড়ো অনেকের সাথে- ছোট্টমনী ছোয়া আর জুমানা থেকে শুরু করে এ,সি,টি মাল্টিকালচারাল মিনিস্টার জয় বারচ-এর সাথে। আগ্রহীদের জন্যে বাংলা রেডিও অনুষ্টানটির লিঙ্ক দেওয়া হলঃ
ঢাকাতে আমার দেখা মেলার সাথে এই মেলার সামন্জস্যতা খুজে পেতে চেস্টা করেছিলাম-এ মেলাতে ঢাকার বৈশাখীমেলার প্রায় সবই ছিল-ভাতের সাথে ঈলিশ ভাজা ছিল, ঝাল মুড়ি ছিল, রকমারী সামগ্রীর স্টল ছিল, গানবাজনা ছিল, হাসি গল্পপ ছিল- ছিল না কেবল সন্ত্রাসবাজীর আতঙ্ক। স্বাধীনতার আগ থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদশে এই কিছুদিন আগেও বৈশাখীমেলায় গানবাজনা হয় বলে মেলা’র অনুষ্ঠান ভন্ডুল করতে বোমাবাজ়ী হয়েছিল। তবে, বোমাবাজীর খবর না থাকলেও বিভিন্নধরনের সাংস্ক্রিত অনুষ্ঠানকে ঘিরে অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় শহরের কোথাও কোথাও দলাদলি আর হাতাহাতির ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়- তবে, সে ঘটনার প্রেক্ষাপট হয়ত ভিন্ন।
বৈশাখীমেলা বাঙ্গালী সংস্কৃতির অঙ্গ। বাঙ্গালী সংস্কৃতির হাজার বছরের ঐতিহ্য বহনকারী সামগ্রীর প্রদর্শনী ছিল কেনবেরার এই বৈশাখীমেলাতে। বাংলা নতুন বছর ১৪১৯’কে বরন করতে মেলাতে নতুন প্রজন্মের শিশুকিশোরদের অংশগ্রহন ছিল চোখে পরার মত। এসব শিশুকিশোরদের মুখে বৈশাখী গান, সুরের তালে তালে ওদের নাচ, নির্ভেজাল বাংলায় ওদের কবিতা আবৃত্তি ছিল প্রসংশনীয়। যারা ছোট্টমনীদেরকে দিয়ে এধরনের অনুষ্ঠান করানোর পিছনে কাজ করেছেন, তাদের সাথে কথা বলে জেনেছি এ কাজ কষ্টসাধ্য তবে যুক্তিযুক্ত। কারন ওরাই এই বিদেশে অবাঙ্গালী-বাঙ্গালী’র মিশ্র পরিবেশে হাজার বছরের বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যর ধারক-বাহক হবে।
এই ছোট্ট পরিসরের বৈশাখীমেলায় চোখে পরার মত আরও একটি বিষয় ছিলঃ মেলায় প্রবেশ মুখে অস্ট্রেলিয়ার মাল্টিকালচারাল সোসাইটিতে বেড়ে উঠা বাংগালী কিশোর বয়শী ছাত্রীদের দেওয়া সাজগোজের স্টল- অন্যদের মেন্দী মাখিয়ে, নেইল পালিস করিয়ে, ফেইচ পেইন্ট করিয়ে সাজগোজে যাদের পছন্দ তাদের কাছে ওদের স্টলটা আকর্ষনীয় করে তুলেছিল ওরা। ‘অস্ট্রেলিয়ায় ভিণ্ণ পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে রেখে বাঙ্গালী ছেলেমেয়েকে বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে গড়ে তোলা অসম্ভব’ এই বিস্বাসে বিস্বাসী বাবা-মায়েরা মেলার বিভিন্ন ইভেন্টে ওই শিশুকিশোরদের অংশগ্রহন করা যদি দেখে থাকেন, তবে তারা বোধকরি নিশ্ছিত হয়েছেন যে, আমদের বাঙ্গালী ছেলেমেয়েকে যদি উপয়ুক্ত পরিবেশে বাঙ্গালী সংস্কৃতি’র চরচা করার সুয়োগ করে দেওয়া হয়- তবে ওরা এই ভিন্ন সমাজ ব্যাবস্থাতেও বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে লালন করেই বিশ্বনাগরিক হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে।
মেলায় কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিনিওর ক্লাবের এক সদস্য জানালেন কেনবেরাতে বাংলাদেশীদের সংখ্যার তুলনায় মেলায় উপস্থিতির সংখ্যা আরও বাড়তে পারত। কথাটির সত্যতা যাচাই হল বাংলাদেশ দুতাবাসের রাষ্ট্রদুতের কথাতে। তিনি জানালেন যে দুতাবাস চত্তরের একাংশ মেলার স্টলের জন্যে পরিস্কার পরিছন্ন্য করে রাখা হলেও খালি পড়েছিল কারন অনেকেরই মেলাতে স্টল দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু স্টল বসাননি তারা।
বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া এসোসিয়েশন কেনবেরার অপারগতায়, বৈশাখী মেলার আয়োজন করতে বাংলাদেশ সিনিওর ক্লাব কেনবেরা ও বাংলাদেশ দুতাবাসের উদ্যোগ নিসন্দেহে একটি সুন্দর সিধান্ত। প্রতিটি সংস্কৃতিমনা বাঙ্গালির মতো আমি তাদের ওই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
তবে, আমি ব্যক্তিগত ভাবে এও মনে করি বাংলাদেশী সংস্কৃতিকে বিদেশে সভা সমিতি’র মধ্যমে পরিচিতি করতেই শুধু নয়, বিদেশে ভিন্ন সমাজ ব্যাবস্থাতে বেড়ে উঠা বাঙ্গালী ছেলেমেয়েরা যাতে আগামীতে বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে সন্মানের সাথে লালন ও পালন করতে পারে, বাংলাদেশকে বিদেশে গরবের সাথে পরিচয় করাতে পারে- সে ব্যপারে দুতাবাসের কিছু করার রয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশী এসোসিয়েশন’র সাংস্কৃতিক কোন একটা ইভেন্ট-এ স্পন্সর করেই তাদের দায়িত্ত পালন হয় না। তেমনি, বাংলাদেশী কমুনিটিকেও দল-মত ভুলে দুতাবাসের আয়োজনে সারা দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।– এবারের এই বৈশাখীমেলায় আরও বাংলাদেশীদের উপস্থিতি থাকতে পারত।
আগেই বলেছি, কেনবেরার বৈশাখীমেলা ‘বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া এসোসিয়েশন কেনবেরা’ র একটা বাত্সরিক ইভেন্ট হিসাবে থাকলেও এবারে এসোসিয়েশনের কমিটির দায়িত্তে যারা ছিলেন, তারা তাদের কিছু সমস্যার কারনে এবারের বৈশাখীমেলার আয়োজন করতে পারেন নি। তাদের সমস্যাকে গুরুত্ত না দিয়ে ওই কমিটি যদি অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশী নতুন প্রজন্মের কথা ভেবে বৈশাখীমেলা (কেউর কেউর মতে, বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় সাংস্কৃতিক ইভেন্ট) আয়োজনে গুরুত্ত দিত তাহলে হয়ত তাদের সিন্ধান্ত ঠিক হত। কেননা, অস্ট্রেলিয়াতে স্কুল পড়ুয়া মাইগ্রান্ট ফ্যামিলি’র ছেলেমেয়েরা যাতে তাদের বাবা-মায়ের পিছনে ফেলে আশা সংস্কৃতিকে জানতে পারে, এসব ছেলেমেয়েরা যাতে একে অপরের সংস্কৃতির প্রতি শ্রধ্যাশীল হয়ে গড়ে উঠতে পারে সেই লখ্যকে সামনে রেখে অস্ট্রেলিয়ান সরকার কমুনিটি ফান্ড দিয়ে এসব এসোসিয়েশনকে সহায়তা দিয়ে থাকে, আর সেই ফান্ড নেওয়ার পর কমিটি যদি তাদের দায় দায়িত্ত ঠিক মত পালন না করতে পারে, তার দায়ভার ওই এসোসিয়েশনের উপরই কিন্তু বড়তায়।
এবারের এই বৈশাখীমেলা থেকে এটাই আমার মনে হয়েছে যে, বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে প্রবাসে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে বিদেশের মাটিতেও সংস্কৃতিমনা সকল মানুষের এক হয়ে ধর্ম-বর্ণ, দল-মত ভুলে কাজ করতে হবে।
Photo courtesy Ahmed Imran.