অস্ট্রেলিয়ায় মহান একুশ এবং একুশের বৈশ্বিক চেতনার ক্রমোত্থান (৩) (প্রাসঙ্গিক ভাবনাঃ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ লাকেম্বা প্রকল্পের তহবিল সংগ্রহ)
সকল আলোচনা-সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে অত্যন্ত সফলতার সাথে বিগত ১৩ই অক্টোবর’১৯ রেড রোজ ফাংশান সেন্টার রকডেলে সম্পন্ন হয়ে গেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ লাকেম্বা প্রকল্প বাস্তবায়নের তহবিল সংগ্রহের নৈশভোজ অনুষ্ঠান। আয়োজকদের তথ্যানুযায়ী এই নৈশভোজের মাধ্যমে সর্বমোট ৩৫,৩০০ ডলারের তহবিল সংগৃহীত হয়েছে। একুশপ্রেমী উৎসাহীদের উপছেপরা প্রাণচাঞ্চল্য উপস্থিতি প্রমান করেছে একুশের সাথে বাঙালিদের নিবিড় সম্পর্ক কত গভীরে প্রোথিত। আয়োজকদের একজন অনুষ্ঠানের দিন সকালে এই অপ্রত্যাশিত সাড়ার বিষয়টি আমাকে নিশ্চিত করেছেন, যা আরেকজন আয়োজক আমাকে বেশ কিছু দিন আগেই এই বিষয়ে আস্বস্থ্য করেছিলেন। এই সাড়াজাগানোর পেছনে কঠোর পরিশ্রমের জন্য উষ্ণ অভিনন্দন সকল আয়োজক এবং উৎসাহী মাতৃভাষা প্রেমীদের। বাঙালিদের স্বভাবজাত প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে এই অপ্রত্যাশিত সাড়ায় ভাটা না দেখা দিলে আয়োজকদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের বিশতম বার্ষিকীতে সিডনীতে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধের মাধ্যমে স্থানীয় বিভিন্ন ভাষাভাষীরা নিজ নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণের নতুন নিশানা পাবে। স্থানীয়দের জন্য এই স্মৃতিসৌধ হবে নিজ নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণের মাধ্যমে সকলের সংস্কৃতি কৃষ্টিকে বহুজাতিক এই সমাজে প্রজন্মান্তরে টিকিয়ে রাখার প্রাত্যহিক প্রতীকী তাগিদ।
বাঙালি অতিশয় আবেগ তাড়িত জাতি। বাঙালি একাধারে অত্যন্ত পরিশ্রমী ও দৃষ্টান্তমূলক ত্যাগের পাশাপাশি পরশ্রীকাতর ও বিশ্বাসঘাতকার দৃষ্টান্ত রেখে আসছে শতশত বছর ধরে। পলাশীর যুদ্ধ, সাতচল্লিশের দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বায়ান্নের মাতৃভাষা রক্ষা ভিত্তিক মহান একুশের অভ্যুদয়, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, পচাত্তরের ঘৃণ্যতম হত্যাযজ্ঞ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং একুশে’র “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে উত্তরণ ইত্যাদির সবকিছুই বাঙালীর ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। নবাব সিরাজদৌলা, মীরজাফর, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, খোন্দকার মোস্তাক প্রত্যেকেই বাঙালি সন্তান। সর্বমোট ছয়টি নোবেল বিজয় করে বাঙালিরাই পৃথিবীর মধ্যে অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। মহান একুশে‘র চেতনাদীপ্ত বাঙালি কানাডা প্রবাসী প্রয়াত রফিকুল ইসলাম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে পৃথিবীর সকল ভাষাভাষীর অনুকরণীয় দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত হলেও তাঁর অবদানকে জাতীয় পর্যায়েও প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস একপর্যায়ে যেমন স্পষ্টভাবে লক্ষণীয় ছিল, তেমনি সিডনীতে ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এবং “একুশে কর্নার” এর বৈশ্বিক দার্শনিক বিষয়াদি বহুজাতিক সমাজে সম্মানিতভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও বাঙালিদের তথাকথিত আবেগের মোড়কে কুলসিত করার কঠিন ষড়যন্ত্র স্পষ্টতভাবে অব্যাহত। ফলে লাকেম্বার স্মৃতিসৌধের সফলতম বাস্তবায়ন নিয়ে আমার গভীর সংশয় দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে মহান একুশের ঐতিহ্য সকল ভাষাভাষীর কাছে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার প্রেক্ষাপট আদৌ প্রতিফলিত হবে কিনা তা আয়োজকরা পরিস্কার করতে পারেনি। রেড রোজ ফাংশান সেন্টারে নৈশভোজে উপছেপরা উপস্থিতির পাশাপাশি নৈশভোজ অনুষ্ঠানের বস্তুনিষ্ঠহীন সঞ্চালনা এবং উপস্থাপনা, এক বছরেরও বেশী সময় ধরে প্রধান আয়োজকগণের সাথে নিয়মিত শলা-পরামর্শের অভিজ্ঞতা, স্মৃতিসৌধ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থেকে নৈশভোজের পূর্বাপর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি সমাজকর্মীদের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত-মন্তব্য, এবং সর্বোপরি “স্বাধীন কণ্ঠ” পত্রিকার চতুর্থ বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে আমার সাথে স্থানীয় সম্মানিত সংসদ সদস্যসহ কমিউনিটি বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের উৎসাহী আলোচনার তথ্যাদি আমার এই সংশয়কে গভীরতর করে তুলেছে। সিডনীতে ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এর মত বৈশ্বিক অর্জনকে জাতীয় ঐতিহ্যের আবেগ, “শহীদ মিনার” এর সাথে ঘৃণ্যতম বিতর্কে এক যুগেরও বেশী সময়ের এক নীরব যুদ্ধের অধ্যায় অতিক্রম করে আমরা লাকেম্বার স্মৃতিসৌধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে আসলেও আমার গভীর সংশয়ের ভিত্তিঃ বাঙালিদের আবেগ তাড়িত আন্তবিরোধের কারনে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশী সময় থেকে কানাডার টরেন্টো শহরের কনফেডারেশন পার্কের অনুমোদিত স্থানে স্মৃতিসৌধ বাস্তবায়ন সফলতার মুখ না দেখা, সিডনীর কোগড়ায় শহীদ মিনারের প্রকল্প অনুমোদনের মাঝ পথে থমকে দাঁড়ানো, স্থানীয় সংসদ সদস্য কর্তৃক উল্লেখযোগ্য পরিমান অনুদানের ঘোষণার পরও ইঙ্গেলবার্নে শহীদ মিনার বাস্তবায়ন দীর্ঘ সময় ধরে বিলম্বনা।
আমরা বহুজাতিক সমাজের সদস্য হিসেবে গর্ববোধ করলেও সর্বক্ষেত্রেই আমাদের সংকীর্ণ মানসিকতার কাছে বার বার পরাজয় বরণ করে চলেছি। ব্যাক্তি স্বার্থ হাসিল অথবা অপরের কীর্তির প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে জাতীয় গর্ব ঐতিহ্যকে আড়াল করেও আমাদেরকে জাহির করতে আমরা বেশী অভ্যস্থ। বিশেষ করে এই স্মৃতিসৌধ প্রকল্পের প্রধান আয়োজকদের আন্তরিকতা, চ্যালেঞ্জ এবং কমিউনিটি কেন্দ্রিক সেবামুলক উদার মানসিকতার বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ না থাকলে তাঁদের এই মহতী প্রচেষ্টার পরিকল্পনার বিভিন্ন পর্যায় এবং নৈশভোজের উপস্থাপনার অনেকাংশ আমাকে বেশ হতাশ করেছে। অনুষ্ঠানে বসে সামগ্রিকভাবেই আমার বার বার মনে হয়েছে স্মৃতিসৌধ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য, মহান একুশের আন্তর্জাতিকতার ছাপ, তথা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সকল ভাষাভাষীদের কাছে একুশের অহংকারী গুরুত্বের বিষয়টিকে আগলে রেখে যেন ব্যাক্তি প্রচার বা তোষামদি মানসিকতাই প্রাধান্য পেয়েছে। স্মৃতিসৌধ বাস্তবায়নের মহতী প্রচেষ্টার যুক্তিকতা বিশ্লেষণের তুলনায় নৈশভোজের সফল আনুষ্ঠানিকতা বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে। বাঙালি হিসেবে বাংলাভাষীদের একচ্ছত্র উপস্থিতি প্রশংসনীয় হলেও সেই তুলনায় ভিন্ন ভাষাভাষীদের উপস্থিতি ছিল সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক। অবশ্য স্থানীয় মেয়রের মুল্যবান বক্তৃতা প্রমান করেছে এটি শুধুই বাংলাভাষীদের জন্য যদিও স্থানীয় সংসদ সদস্যের বক্তৃতায় ভিন্নতা প্রকাশ পেয়েছে। এই স্মৃতিসৌধের নামাকরন নিয়ে এখনও আমি সন্দিহান, কারন পাওয়ার পয়েন্টের উপস্থাপনাসহ, উদ্বোধনী সঞ্চালক, উপস্থাপক এবং স্বয়ং উদ্যোক্তার উপস্থাপনায় বিভিন্ন নামে স্মৃতিসৌধের নাম উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন “ইন্টারন্যাশনাল মাদার ডে ল্যাংগুয়েজ মনুমেন্ট”, “ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ মনুমেন্ট”, “ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে মনুমেন্ট”…, কোনটি সঠিক??? স্মৃতিসৌধ বাস্তবায়নে সংখ্যায় পাঁচ জন বলা হলেও নাম বলা হয়েছে ছয় জনের। এই মহতী উদ্যোগে মান্যবর হাই কমিশনারের উপস্থিতি আমাদের সকলকে অনুপ্রাণিত করেছে নির্দ্বিধায় বলা যায়। কিন্তু সিডনীর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধের প্রতিষ্ঠার মহতী উদ্যোগের মত অনুষ্ঠানে মান্যবর হাই কমিশনারের জীবন বৃত্তান্তের সুদীর্ঘ বয়ান উপস্থিত অতিথিদেরসহ স্বয়ং হাই কমিশনার মহোদয়কেও এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখী করেছে। বিশেষ করে যেখানে আমাদের জাতীয় গর্বের “শহীদ মিনার” এর আন্তর্জাতিক সংস্করণ হিসেবে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এর দার্শনিক বিষয় এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তোষামোদি মানসিকতায় অভ্যস্থতার কারনে আয়োজকগণ সম্ভবত ভুলেই গেছেন বিষয়টি শুধু আন্তর্জাতিক ইস্যুই নয়, এটি পৃথিবীর সকল ভাষাভাষীর প্রত্যেকের মৌলিক অধিকারের ইস্যু। অধিকিন্তু কমিউনিটির মধ্যে ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনা বিষয় অথবা স্মৃতিসৌধের বাস্তবায়ন এবং নকশা বিষয়ে বিভিল্ল মিডিয়ায় প্রচারিত গঠনমূলক প্রস্তাবনার বিষয়গুলি আয়োজকগণ আমলে নিয়েছেন বা নেননি সে বিষয়ে আলকপাত করা হয়েছে বলে মনে হয় না।
লাকেম্বায় প্রতিষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ সকলপ্রকার সীমাবদ্ধতার প্রাচীর ডিঙিয়ে বাস্তবায়নের মুখ দেখবে এই প্রত্যাশা করি। তবে সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় স্মৃতিসৌধটি বাস্তবায়ন বিষয়ে আয়োজকগণকে আরও স্বচ্চতা, নিরপেক্ষতাসহ কৌশলী অবস্থান অপরিহার্য বলে প্রতীয়মান। অন্যথায় নৈশভোজ অনুষ্ঠানের মতই স্মৃতিসৌধটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও তা আনুষ্ঠানিকতা পর্যন্তই আয়োজকদের ব্যক্তিগত প্রচার এবং তোষামোদের বেড়াজালে বন্ধি হয়ে পড়বে। মহান একুশের চেতনা নামাকরনের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আশা করি বাস্তবায়িত স্মৃতিসৌধটি সকল ভাষাভাষীর কল্যানে একুশের চেতনার পরিস্ফুটন করে স্থানীয় বাঙালিদেরকে অন্যান্য ভাষাভাষীদের কাছে সম্মানিত করে তুলেবে।
(চলবে)
Nirmal Paul
নির্মল পাল; ইমেইলঃ nirmalpaul@optusnet.com.au; প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপারশনঃ এমএলসি মুভমেন্ট ইনটারন্যাশন্যাল ইনক; প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকারী দলনেতাঃ পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”; প্রকাশিত গ্রন্থঃ “বিশ্বায়নে শহীদ মিনার”; বৈশ্বিক দর্শনঃ “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”, (স্থানীয় বর্ণমালা সংরক্ষণ কেন্দ্র)
Related Articles
High Commissioner for Bangladesh presented his letter of credence
Bangladesh High Commission, Canberra Press Release 27 November 2008 High Commissioner for Bangladesh presented his letter of credence The newly
'Labor Team' for Strathfield Council election – 8 Sep 2012
Dear Community friend, I informed you earlier that I have been preselected by the Labor Party to lead the Labor
An Appeal to Fund Research into low cost river bank protection in Bangladesh
Dear All, One of my closest engineering friends whose name is Imdad is attempting to launch an appeal to fund