সবাইকে মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা আর শ্রদ্ধা ভাষা আন্দোলনে শহীদ ভাইদের প্রতি
অনেক দিন পর আবার লিখতে বসলাম, ব্যস্ততা আমার সব সখ গুলিকে কোথায় যেনো হারিয়ে ফেলছে!!
ছোট এক শহর কারাথা, প্রথম যখন এলাম কোন বাংলাদেশী ছিলনা জনি আর দাদা পরিবার ছাড়া, বেশী মন খারাপ হোত যখন দেশীয় অনুষঠান গুলির দিন আসতো, নিজেরা মিলে কোনভাবে উদযাপন করতাম, বিদেশী বন্ধুরা এসে উৎসাহ দিত। পোর্ট হেডল্যন্ড এর বাংলাদেশী পরিবার গুলি সবসময় তাদের অনুষ্ঠানে যেতে বলে, মাঝে মাঝে যাইও, কিন্তু দূরত্ত সে ইচ্ছা গুলিরও বাধা হয়ে দাড়ায়! যাইহোক, হটাৎ করেই এখানে কিছু স্বদেশী পেয়ে গেলাম। প্ল্যান করে ফেল্লাম ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করার।
মনে মনে ভাবছি, কখন কি করব? আমার সব টেনশন দুর করে দিল আমার প্রিয় মানুষটা!! শত ব্যস্ততার মাঝেও ঝটপট করে আমার বাড়িতে ২১ শে উদযাপনের স্টেজ করে ফেললো! মনটা ভরে গেল খুশীতে আর কৃতগ্গতায়!
২১শে ফেব্রুয়ারি সন্ধায় যথারিতী সময়মত সবাই হাজির। পোর্ট হেডল্যন্ড, টম প্রাইস এসব জায়গা থেকেও চলে এল কিছু বন্ধু-বান্ধব, ভীষন ভাল লাগল! এখানের সবাই খাবারের কথা আমাকে আগেই বলেছিল যে তারাও কিছু কিছু নিয়ে আসবে রান্না করে কিন্তু পোর্ট হেডল্যন্ড, টম প্রাইস থেকেও যে এত্ত এত্ত খাবার আসবে সত্তি ভাবিনি!
শুরু করলাম আমরা সবাই মিলে সেই প্রিয় গানটা দি্যে, “আমার ভাই এর রক্তে রাংগানো ….” আর পাশাপাশি শহীদ মিনারে পুষ্পদান!
এরপর পরপর এলো শিশুরা, সুমাইয়া, সোহান ২ ভাইবোন সুমি আর সাইদ এর ছেলে, মেয়ে। ভীষন লক্ষি এই বাচ্চা দুইজন দারুন ভাবে গান-বাজনার পাগল, হয়তো ওদের বাবা-মাকে দেখে শিখছে! ধন্য তোমরা সুমি আর সাইদ! ওরা সুন্দর করে গাইল বুলবুল পাখি সাথে আর একটা কবিতা! এর পর এল তানিয়া, মতি’র মেয়ে মাইসা । ভারী লাজুক এই মেয়েটি যে স্টেজে উঠবে ভাবিনি কখনো, সুন্দর করে কবিতা পড়ে অবাক করে দিল সবাইকে! ধন্য তোমরা মতি আর তানি্যা! এরপর এল রিদি , ময়না ভাবি আর রিয়াজ ভাই এর মেয়ে, পোর্ট হেডল্যন্ড থেকে এসেছেন, রিদির অসাধারন সুন্দর নাচ চমকে দিলো সবাইকে! “দুর্গম গিরি কান্তার মরু” আর ” আমি বান্গলার গান গাই।” ঢাকায় থাকতে শেখা নাচগুলো এখনো চর্চা করে যাচ্ছে মা-বাবার উৎসাহে! ধন্য আপনারা ময়না ভাবি আর রিয়াজ ভাই!
এরপর একে একে এল সুমি, তানিয়া, দিনা, মতি, সাঈদ তাদের গানের ভান্ডার নিয়ে! সুমি আর সাইদ আগে থেকেই গান-বাজনা, নাটকের সাথে জড়িত, মতি-তানিয়া এসব ব্যপারে চরম উৎসাহী, শুধু সামনে গাইতে লজ্জা পায়, জোড় করেই স্টেজে উঠালাম! দীনা – জনি সদ্য বিবাহিত কাপল, টম প্রাইস থেকে এসেছে প্রোগ্রাম দেখতে, জোড় করেই দিনাকে রাজী করালাম ,শেষে গেয়ে শোনালো , জনির কাছে জানতে পারলাম আগেও গাইত, তবে জনিকেও শোনায়নি এতদিন! এরপর কারাথাতে নতুন আসা ফারজানা গেয়ে শোনালো তার মিষ্টি গলার গান।
একসময় স্টেজে ওঠালাম আমাদের সবার প্রিয় বাদল দাদাকে, কারাথাতা’র সবচেয়ে প্রথম বাংলাদেশী! ওনি নিজের লেখা কবিতা আর পুরানো দিনের গান শোনালেন, ভাষা আন্দোলোন সম্পর্কেও অনেক কিছু বল্লেন, যা কিনা আমাদের এ অনুষ্ঠানের সার্থকতা বয়ে আনলো! বাদল দাদা আর মলিনা বৌদি কারাথায় আছেন অনেক দিন!!
মাহফুজ আর ওর বৌ মাহফুজা একটু চুপচাপ কিন্তু ঠিকই চলে আসছে দেখে খুব ভাল লাগল!
এরপর এল সুরাইয়া, ওর মা নিউজিল্যন্ড আর বাবা বাংলাদেশী, মেয়েটা ভীষন রকম ভাবেই বান্গালী! চিটাগাং এর ভাষায় কিছু কথা বল্ল, ওর বাবা চিটাগাং এর। এর পর এল আসেফ, যথারিতী অনুস্ঠানকে হাসি-ঠাট্টা দিয়ে ভরিয়ে তুল্লো ওর স্বভাব মত! উইখাম থাকে আসেফ, যেই জায়গাটা কারাথা থেকে ৩৫/৪০ মিনিট ড্রাইভ।
ছবি তোলার দায়িত্তে ছিল আমার সাহেব আর ভিডিও করল জনি। অনুষ্ঠানের ফাকে ডিনার ব্রেক ছিল, সবার আনা রাননা সাথে আমার নিজের করা খাবার দি্যে খুব মজা করে খেলাম সবাই। ফিরোজ ভাইএর করা মাছের বেক দিয়ে শুরু হোল খাওয়া দাওয়া, ওনি মাঝে লুনা ভাবির সাথে আমার কথা বলি্যে দিলেন টেলিফোনে, ভাবি খুব তাড়াতাড়িই আসছেন ঢাকা থেকে । এর পর পোর্ট হেডল্যন্ড থেকে আসা মোস্তাক ভাই জয়া ভাবি স্টেজে উঠলেন সাথে রিয়াজ ভাই ও ময়না ভাবি, ওনারা ওখানকার সবার হয়ে ধন্যবাদ জানালেন আমাদের। সবশেষে সবাই মিলে ” আমার সোনার বাংলা ” গান দিয়ে শেষ করলাম আমাদের এ অনুষ্ঠান। ধন্যবাদ সবাইকে!
২১ নি্যে কিছু কথা …..
আমার ভাই এর রক্তে রান্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী…….
বছর ঘুরে আবার চলে আসছে আমাদের সেই ২১ শে ফেব্রুয়ারী……. আন্তর্যাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত ও পরিচিত এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনের অনেক হারানো আর অনেক পাওয়ার এক সমৃদ্ধিময় দিন, যা কিনা কখনো ভোলার নয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারী আমাদের জাতীয় সত্তার প্রাণ স্পন্দনের নাম……বছরের ব্যবধান পেরিয়ে, কালের আবর্তে ঘুরে ঘুরে আবার এ দিনটি এসেছে অশ্রুসজল স্মৃতির মালা বহন করে। চারিদিকে বিভিন্ন ভাবে সাড়া পড়ে গেছে একে বরণ করার প্রচেষ্টায়। প্রকৃতি নিজেক সাজিয়ে তুলেছে বিভিন্ন রকম রং ও গন্ধের ফুলের সমারোহে, যেগুলি কিনা কিছুদিন পরেই আশ্রয় পাবে শহীদ মিনারের পাদদেশে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের উদ্দেশ্যে পুষ্পান্জলীর মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় সমস্ত বাঙ্গালী জাতি। রক্তীম কৃষ্ণচূড়াও ছড়িয়ে দেয় তার আগুন ঝরা রুপ চারিদিকে ।
ফেব্রুয়ারী বা ফাল্গুন মাস এলেই চারিদিকে কেমন উৎসব উৎসব ভাব শুরু হয়ে যায়, বাংলা একাডেমীর বিশাল প্রান্গন তৎপর হয়ে ওঠে নানান রকম কার্যকলাপে যেমন বই এর মেলা, গান-বাজনা, কবিতা পাঠ, বক্তৃতা ইত্যাদি। বড় বড় গাছপালা গুলির শাখা-প্রশাখা ভরে যায় অ-আ-ক-খ-তে আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসে চমৎকার সব গন সন্গীত আর কবিতা পাঠের আসর। হঠাৎ করেই যেন দেশীয় পোশাকের কদর বেড়ে যায়, সূতীর শাড়ি বিশেষ করে কালো পাড়ের সাদা শাড়ি, পাজামা-পান্জাবী পড়ে বিভিন্ন বয়সী পুরুষ ও মহিলারা ভীড় জমায় শহীদ মিনারে। বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর এই দিনটিতে মাতৃভাষার সম্মান বাঁচাতে সালাম-বরকতেরা যে আত্মাহুতি দিয়েছিল তা বৃথা যায়নি।
এসব তরুনদের তাজা রক্তে ভরে গিয়েছিল বাংলার মাটি। সালাম সালাম হাজার সালাম …..
তাঁদের অসীম সাহস, শক্তি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ নিয়ে যে লড়াই সেটাই পরবর্তিতে এনে দিয়েছে স্বাধীনতা, ভাষার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা আনতে গিয়ে হাড়িয়েছি আমরা অনেক গুলি প্রান আর তাই এই একুশ একদিকে যেমন এনে দেয় প্রাপ্তির আনন্দ আবার অন্যদিকে হারানোর কষ্টে মনকে করে দেয় ভারাক্রান্ত। আর তাই এই দিনে দলে দলে মানুষেরা শহীদ মিনারের চত্বরে জমা হয়ে ফুল দিয়ে জানায় তাদের মনের অপরিসীম শ্রদ্ধা। কোন বাঁধাই আটকাতে পারেনা জনগনকে, কুয়াশার কান্নাঝরা শীতের সকালে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নিয়ে নতুন শপথের অঙ্গীকার নিয়ে মন বলে ওঠে, “আমরা তোমাদের ভুলবোনা, ভুলবোনা……..
কিন্তু একুশের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কি শুধুই ফুল দিয়ে আর গানের মাঝ দিয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে ? না, কখনোই না, এই দিনটিকে শুধু এই তারিখের মাঝে না, বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের সবার দৈনন্দিন জীবনের মাঝে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের কর্মকান্ডের মাঝে একুশের আদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। পাশাপাশি আমাদের পরবর্তী জেনারেশানের মাঝে একুশের তাৎপর্য্যকে ছড়িয়ে দিতে হবে। শিশুদেরকে ছোটকাল থেকেই দিনটির পরিপূর্ণ মর্যাদা সম্পর্কে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে ২১শের গুরুত্ব।
বাঙ্গালীর চেতনার মাঝে একুশে ফেব্রুয়ারী যে পরশমনি হয়ে বেঁচে আছে সেই পরশমনির ছোঁয়ায় সমস্ত বাঙ্গালীর হৃদয়কে জাগিয়ে তুলে যার যার নিজ সত্তা সম্পর্কে বুঝিয়ে দিতে হবে। আমাদের ভাষার স্বকীয়তা যেন আমাদের ভাষা, সংস্কৃতির মাঝ দিয়ে আমাদের সামগ্রিক পরিচয় বহন করে। বিশ্ববাসী যেন বুঝতে পারে বাংলা ভাষার গুরুত্ব, সৌন্দর্য্য আর দিতে পারে এর যথাযথ মর্যাদা। বাঙ্গালী হিসাবে আজ আমরা এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকারী, আমাদের নিজস্ব ভাষা আছে, সংস্কৃতি আছে। এই ভাষা ও সংস্কৃতির সুষ্ঠু ব্যবহার এর যথাযথ মূল্যায়ন ও সার্থক প্রয়োগের মাঝেই আমাদের স্বকীয়তার সাফল্য নিহিত রয়েছে।
আমাদের সবার প্রার্থনা ও অঙ্গীকার হোক, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমিকে ভালবেসে আমরা যেন আমাদের আগামী দিন গুলিকে আরো সমৃদ্ধশালী করে তুলতে পারি। নিজেরদের ছোট ছোট স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধীকার দিয়ে সবার উপরে তার স্থান দিতে পারি, দেশের সবরকম কল্যানকর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে দেশ যাতে সামনে এগিয়ে যেতে পারে সেদিকে সচেষ্ট হতে পারি।। ২১ শে ফেব্রুয়ারী আমাদের জাতীয় চেতনার এক নতুন দিগন্তের উন্মোচনের দিন, আত্মশুদ্ধিতে উদ্বুব্ধ হবার দিন, তাই প্রতিটি বছরেরে এই ফাল্গুনের রান্গা ভোরে একুশের আগমন আমাদের সকল চাওয়া ও সাধনাকে নতুন করে যাচাই করার সুযোগ পাক।
শুধু বড় বড় নৈতিকতার বানী শুনিয়ে আর মিথ্যা আশ্বাসের মালা না গেঁথে সত্যিকারের দরদি মন নিয়ে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে, শুধু ফুল, মালা আর গানের মাঝ দিয়েই নয়, বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের সবাইকে আরো অনেক বেশী চেস্টা চালিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, একুশের আত্মদান সেই দিনই সার্থক হবে যেদিন আমরা এই আত্মত্যাগের যথার্থতা মন দিয়ে উপলব্ধি করে একে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবে রুপ দিতে পারবো।
মোদের গরব মোদের আশা…আমরি বাংলা ভাষা……..