একুশে পদক ২০১০: আমাদের অহঙ্কার
১৯৭৬ সাল থেকে প্রতি বছরই একুশে পদক প্রদান করা হয়। ২০১০ সালের একুশে পদক পেলেন ১৫ জন। এর মধ্যে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ৬ ব্যক্তিত্বকে দেওয়া হয়েছে এ স্বীকৃতি। তাদের পদক পাওয়া নিয়ে এই প্রতিবেদন।
সাঈদ আহমদ : বাংলাদেশে চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা নাজির আহমদের ছোট ভাই বিশিষ্ট নাট্যকার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘বিশ্বনাটক’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবেই সবসময় বেঁচে থাকবেন সাঈদ আহমদ। তার জন্ম ১৯৩১ সালের ১ জানুয়ারি, ঢাকায়। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভের পর ১৯৫৬ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেন তিনি। তার উলেল্গখযোগ্য নাট্যগ্রন্থ ‘প্রতিদিন একদিন’, ‘কালবেলা’, ‘মাইলপোস্ট’, ‘তৃষ্ণায়’, ‘শেষ নবাব’। তার উলেল্গখযোগ্য প্রবন্ধ [মনোগ্রাফ] হচ্ছে ‘দ্য থিং মাইলপোস্ট’, ‘সারভাইবাল’, ‘আর্ট ইন বাংলাদেশ’, ‘ফাইভ পেইন্টার অব বাংলাদেশ’, ‘কন্টেমপরারি আর্ট’, ‘কন্টেমপরারি গ্রাফিকস আর্টস অব বাংলাদেশ’। ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ১৯৭৬ সালে সুফি মোতাহার হোসেন পুরস্কার পান। গত জানুয়ারি মাসে তার প্রয়াণ হয়। প্রয়াত এই ব্যক্তিত্বকে নাটক শাখায় মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। বেঁচে থাকতে পেলে একুশে পদক না পাওয়া হয়তো তার অন্যরকম এক অতৃপ্তি ছিল।
নাসিরউদ্দিন ইউসুফ : ঢাকার মঞ্চ তথা বাংলাদেশের মঞ্চনাটকে নাসিরউদ্দিন ইউসুফের অবদান অনেক। বিশেষ করে মঞ্চনাটকে তার নিরীক্ষাধর্মী প্রযোজনাগুলো প্রশংসা কুড়িয়েছে। সেলিম আল দীনের বিভিন্ন নাটক নিয়ে ঢাকা থিয়েটারের বেশিরভাগ প্রযোজনা-নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। তাই ‘প্রাচ্য’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘বিনোদিনী’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসী’, ‘বনপাংশুল’, ‘হাতহদাই’ প্রভৃতি নাটক সমৃদ্ধ করেছে আমাদের মঞ্চনাটককে। শুধু তা-ই নয়, চ্যানেল আইয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন’ অনুষ্ঠান নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানটি এখন বিটিভিতেও নিয়মিত প্রচার হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন’ বিশেষ ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুনরুদ্ধারে কাজ করে যাচ্ছেন এই অনুষ্ঠানের পরিচালক ও উপস্থাপক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। এবারের একুশে পদক তার ঘরেও উঠেছে। নাট্যকলায় অবদানের জন্য তাকে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘একুশে পদক প্রাপ্তির কথা শোনার পরই সেলিম আল দীনের কথা মনে পড়েছে। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে বড্ড আনন্দিত হতো। আমার এ স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে তার অবদান অনেক। আর নাটকের প্রতিটি মানুষের জন্য এ সম্মান উৎসর্গ করছি।’
পার্থপ্রতিম মজুমদার : দেশের সংস্কৃতি চর্চা থেকে মূকাভিনয় শিল্প প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এ শিল্পকে নিবু নিবু অবস্থা থেকে আবার সরব করার ক্ষেত্রে পার্থপ্রতিম মজুমদারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মূকাভিনেতা মার্সেল মার্সোর পরেই স্থান দেওয়া হয় তাকে। দীর্ঘদিন প্যারিসে অবস্থান করছেন তিনি। সময়-সুযোগ পেলেই দেশে এসে মূকাভিনয় চর্চার প্রসারে কাজ করেন পার্থপ্রতিম। সেই সুবাদে গত কয়েক বছর মঞ্চ থেকে শুরু করে টিভি অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনচিত্রে মূকাভিনয় দেখা যাচ্ছে। সল্ফপ্রতি পার্থপ্রতিম মজুমদার দেশে এসে একটি মূকাভিনয় ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার প্রাথমিক কথাবার্তাও হয়েছে। এসব অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক পেলেন পার্থপ্রতিম।
লায়লা হাসান : বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন লায়লা হাসান। এ সংগঠনের কার্যক্রম হিসেবে সারাদেশে নৃত্যের উন্নয়নে কাজ করে আসছেন তিনি। দেশের নৃত্যাঙ্গনে ইতিবাচক অবদানের জন্য এবারের একুশে পদক প্রদান করা হয়েছে তাকে। লায়লা হাসান বলেন, ‘আমার যতটুকু মনে পড়ে ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ নৃত্যে অবদানের জন্য একুশে পদক দেওয়া হয়েছিল। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। দেরিতে হলেও নৃত্যকলার জন্য একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। এ সম্মান নৃত্যাঙ্গনের সবার। এ স্বীকৃতি আগামীতে আরও ভালো কাজ করায় আগ্রহী করে তুলবে আমাদের।’
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে, ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’র মতো অসংখ্য গান লিখে ও সুর করে সঙ্গীতাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তার লেখা ও সুর করা অসংখ্য কালজয়ী গান আছে। সঙ্গীতে অবদানের জন্য একুশে পদকের সম্মান দেওয়া হয়েছে তাকে। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বলেন, ‘আমার সবচেয়ে ভালো লাগছে বেঁচে থাকতেই একুশে পদক পেলাম। আর কাজের ক্ষেত্রে দায়িত্ববোধটা বেড়ে গেল। তরুণ প্রজন্মের জন্য তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে এমন কিছু গান করতে চাই।’
হানিফ সংকেত : প্রায় ২০ বছর ধরে দর্শকের পছন্দের শীর্ষে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। বিটিভির এই জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের প্রতি পর্বেই সমাজ সচেতনতামূলক নাটিকা ও প্রতিবেদন দেখানো হয়। ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে সমাজের নানা দিক তুলে ধরেন হানিফ সংকেত। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নীরবে-নিভৃতে সমাজে আলো ছড়িয়ে দিতে অবদান রাখছেন, তাদের খুঁজে বের করে সম্মান জানায় ‘ইত্যাদি’। সে ক্ষেত্রে সামাজিক উন্নয়নে ‘ইত্যাদি’র ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই সামাজিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে এবারের একুশে পদক পেলেন হানিফ সংকেত। তিনি বলেন, ‘যে কোনো সম্মান পেলেই ভালো লাগে। তবে এ সম্মান অনেক উঁচুমানের। এটা নিজের দায়িত্ব ও সামাজিক দায়বদ্ধতা অনেক বাড়িয়ে দেয়। একুশে পদক আমাকে সমাজের প্রতি আরও দায়িত্বশীল করে তুলেছে। সমাজের উন্নয়নে আমার কাজ অব্যাহত থাকবে।’
original source at http://www.samakal.com.bd/details.php?news=28&action=main&menu_type=&option=single&news_id=49189&pub_no=260
দীর্ঘ ৪০ বছরের অক্লান্ত শ্রমের স্বীকৃতি পেলাম-এই পাওয়াটা একটি গৌরবের বিষয়: মূকাভিনেতা পার্থপ্রতিম মজুমদার
একুশের পদকপ্রাপ্ত মূকাভিনেতা প্যারিসে প্রবাসী পার্থপ্রতিম মজুমদার বার্তা সংস্খা এনার কাছে অনুভূতি ব্যক্তকালে ১৯ ফেবন্সুয়ারি বলেছেন, দীর্ঘ ৪০ বছরের অক্লান্ত শ্রমের স্বীকৃতি পেলাম| এই পাওয়াটা একটি গৌরবের বিষয়| একইসাথে ঢাকায় আত্মর্জাতিক মানের একটি আধুনিক ‘মাইম একাডেমী’ গড়ার যে স্বপ্ন ছিল তা বাত্মবায়নের পথ সুগম হলো|
প্যারিস থেকে টেলিফোনে পার্থপ্রতিম মজুমদার এনাকে আরো বলেছেন, আমি বিশেষ একটি প্রকল্পে ব্যত রয়েছি বিধায় নিজ হাতে এওয়ার্ড নিতে পারলাম না-এটা যেমন দু:খবোধের ব্যাপার, অপরদিকে যারা আমাকে পুত্রস্নেহে পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ দিয়েছেন, সেই পরমশ্রদ্ধেয় বারী মজুমদার এবং ইলা মজুমদারের মাধ্যমে এওয়ার্ড গ্রহণ করতে পেরে কী যে আনন্দ পাচ্ছি-তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারবো না|
তিনি বলেন, আমি আরো গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছি আমার সুপ্রিয় দর্শকদের-যারা আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে দীর্ঘ ৪ দশক যাবত বাঁচিয়ে রেখেছেন আমার শিল্পকে| তবে আমি সবসময় মনে করি জীবদ্দশায় সকলের সম্মান পাওয়া উচিত| তাহলে সংশ্লিষ্ট শিল্পী বা লেখক বা সাংবাদিক অথবা স্খাপত্যবিদ কিংবা বিজ্ঞানী উৎসাহ পাবেন আরো নতুন কিছু করতে| আরো ভালো কাজে অনুপ্রাণীত করার স্বার্থেই জীবদ্দশায় এমন সম্মান দিতে সংশ্লিষ্টরা সজাগ থাকবেন বলে আশা করছি| দীর্ঘ ৩০ বছর যাবত প্রবাসী পার্থপ্রতিম মজুমদার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন একুশে এওয়ার্ড কমিটির সকলকে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ড. আতিয়ার রহমানের প্রতি| কেননা ঢাকায় মূকাভিনেতার নিজস্ব ঠিকানা করে দিয়েছেন ড. আতিয়ার|
পার্থপ্রতিম মজুমদার বলেছেন, গ্রামীন ফোনের সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় যাবো মাইম একাডেমী প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করতে|
উল্লেখ্য যে, গত বছর ইউরোপের সেরা ‘মলিয়েরে এওয়ার্ড-২০০৯’ পেয়েছেন মূকাভিনেতা পার্থ প্রতিম মজুমদার| ঐ এওয়ার্ডের সাথে জড়িত একটি নাট্যদলের সাথে তিনি বর্তমানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শো করছেন বিধায় ঢাকায় যেতে পারেননি একুশে পদক নিতে|
original source at http://www.khabor.com/news/prabash/02/prabasher_news_02202010_0000003.htm