Eid O Edur Kopali
ঈদ ও ইঁদুর কপালে – অধ্যাপক নজরুল হাবিবী
বড় প্রতিক্ষিত এক মাস সিয়াম সাধনার পর বিশ্ব মুসলিমের দ্বারে উপস্থিত আজ ঈদুল ফেতর। ‘ঈদ’ আরবী শব্দ, মানে হাসি-খুশি, আনন্দ এবং প্রসন্নতা। ইসলামী শরিয়ত এ আনন্দ কিন্তু সবাইকে ভাগ করে দিতে নারাজ। ঐ যে ভদ্র লোকটি রোজা রাখলো না পড়লো না নামাজ-তারাবিহ্, দিল না জাকাত-ফিতরা, আপন ছেলে-মেয়েকে এতটুকু বলল না দ্বীন-ধর্মের কথা, হালাল-হারাম, পর্দা-পুশিদার কথা, খুলে দেখল না হাদিস-কুআনের একটি পৃষ্ঠাও, করলো সূদের ব্যবসা, বল্ল মিথ্যা, মেয়েটি চলে গেল কোথায়, কোন ক্লাবে খবর নেবার সময় হয় নি, খেলো, ঘুমালো, করলো নর্তন-কুর্দন এ আনন্দ তার জন্য হবে কেন? ঈদের দিন যদিও তিনি লম্বা জুব্বা, মাথায় পাগড়ি, আতর-সুর্মার সমাহারে মসজিদের আগের কাতারে গিয়ে নামাজ পড়েন, দিলবাহারী নতুন জামা-কাপড় কিনে গায়ে জড়ান, রান্না করেন রসামৃত রসনা বিলাসে, রাষ্ট্রিয় কর্ণধার দেন শুভেচ্ছা-সেলামি, না, ঈদ তাকে আনন্দ-সুখ দেবে না।
‘সুখ’ একটি সংবেদনশীল এবং হৃদ্যিক শব্দ। মনের পবিত্রতম আস্থা-অবস্থানের সাথেই সুখ-শান্তি জড়িত। মনের আরোহ এবং অবরোহই সুখ-শান্তির উত্থান-পতন ঘটায়। নৈতিকতার ঘরে সুখ থাকে। আত্মার পূর্ণময় অন্বেষা, ঐশীর অন্বিতবাণীর লালনে এবং পালনে সুখ এসে নতজানু হয় চীর-ছেঁড়া ঘরে, ক্ষুধার্ত জঠরে। এ দল দেখতে পায় তাদের নাম লেখা হয় আর্শে আজমে, বেহেস্তীদের তালিকায়। ক্ষুধা তখন সুধা হয়ে আসে।
ইঁদুর কপালে
অন্যদিকে পাপাচার, মিথ্যা, লোভ লালসায় মন বয়ে বেড়ায় সদানিরানন্দ, অখুশি, অশান্তি, অস্বস্তির দোজখী আবহ। এই তো ঈদ এবং ওয়াঈদ। ঈদের দিন ঈদগাহে যাবার আগে ‘ওয়াঈদ’ শব্দটির সরল তাফসির প্রতিটি মুসলমানের মনে বদ্ধমূল থাকা উচিৎ। না হয় নামাজে পূর্ণতা আসবে না। ‘সুখ’ শব্দের জাপানী অনুবাদ ‘কুপোকা’ স্থান বিশেষে ‘কুপোকাত’। শব্দটিকে বাংলায় অর্থ করলে যা হয় তা কোন মানুষের প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু তাই-ই ঘটবে বদনসিব, গাফেল মুসলমানের। এদের সব কুপোকাত হতে বাধ্য। কারণ, এরা আবদুল্লাহ্ (আল্লাহর বান্দা) নয়। বাংলা বাগধারায় একেই বলে ‘ইঁদুর কপালে’। এখানে লাইলাতুল কদরের রাত এবং কিয়ামতের দিনের ফজর সমান। রুহুল আমিন বা জিব্রাইল (আ:) কুরআনের ভাষায়, ‘হিয়া হাত্তা মাতলাইল ফজর’( সুর্যোদয় অবধি) শুধু নয়, হিয়া হাত্তা গুরুবুশশাস’ বা কিয়ামতের সন্ধ্যা বেলায় যে দিন শেষ সূর্যাস্থ হবে সে পর্যন্ত রহমতধারা বর্ষণ করলেও এক শ্রেণীর মানুষ আনন্দ পাবে না। কারণ, তার মন। মনটি প্রস্তুত নয় সে কাওসারে অবগাহন করতে। এক দল যখন অলৌকিক শক্তিবলে পরমানন্দে স্বর্গে সময় কাটাবেন, আরেকদল তখন মানসিক এবং মানবিক অভিশাপে অলক্ষ্মীর ঝাঁটায় জর্জরিত হতে থাকবে। পাঠক, আপনি স্বীকার করুন বা নাই করুন, হিন্দুশাস্ত্রে ‘অলক্ষ্মী’ নামে একজন দেবী আছে। যে কিনা সমুদ্র মন্থন কালে লক্ষ্মীর জ্যেষ্ঠা ভগিনী অলক্ষ্মী রক্তমাল্য ও রক্তকমলে ভূষিতা হয়ে সমুদ্র হতে আবির্ভূতা হয়। দেবাসুরের মধ্যে তাকে কেহ বিবাহ করতে রাজী না হওয়ায় দু:সহ নামে একজন মহাতপা মুনি তাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেন। এবং পরে একে ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর বস্ত্র কৃষ্ণবর্ণ, হাতে ঝাঁটা, অলংকার লৌহ নির্মিত, সারা দেহে কাঁকরের চন্দন লিপ্ত এবং গদর্ভারূঢ়া। সে দুর্ভাগ্যের দেবী নামে পরিচিতা। মুসলিম সমাজে এ রকম লক্ষ্মী-অক্ষ্মীর অস্থিত্ব না থাকলেও, এ জাতীয় মাতা-ভগ্নির অভাব নেই। তারা প্রতিদিন আনন্দ করে। ‘পাব’ এ পাপ করে, সুতরাং আজকের রামাদ্বান ঈদের আনন্দ যদি তারাও পায় তা অযাথর্থ হবে বৈ কি।
আপন কোলে ঝোল
রোজা এলে রাষ্ট্রপ্রধান চিরাচরিত প্রথায় জনতার উদ্দেশ্যে গৎ বাঁধা একটি বাণী দিয়ে থাকেন ,‘সবার জন্য ঈদ বয়ে আনুক নির্মল আনন্দ’-ধরণের আপ্তবাক্য, মতলবি কথা আর কি। বাণীগুলি পুরাতন। শুধু পরিবর্তন হয় নামের। বকলম আলী থেকে মলম মিয়ায় রূপান্তর। বাণীতে সুন্দর সুন্দর শব্দ থাকে, মন মাতানো কথা থাকে, হৃদয় ছোঁয়া উপদেশ থাকে, অশ্র“ঝরা, প্রেম-দরদ থাকে, সব মিলিয়ে বাণীটি হয় ফুর ফুরে, ঝরঝরে। সংবেদন, সমবেদন এবং সংহতিতে পূর্ণ হয় বাসিবাণী। পড়ার পর মনে হয় আহারে, কত বড় মনের মানুষ এই বেদিশার এরশাদ!
কিন্তু বাস্তবতা হল, এরাইতো গণমানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে খায়, ধ্বংস করে দেয় মানবসভ্যতার বিচরণভূমি। তাদের বড়ই পছন্দ মানুষের রক্ত এবং হাড়-গোর দেখতে। আর একদল বাবা-স্বামির নামে গণতন্ত্রের ব্যানারে টাকা জমায় বিদেশী ব্যাংকে। ‘আপন কোলে ঝোল টানা’র নেতারা রচনা করেন বিশ্ব শান্তি সংস্থার সংবিধান।
বিভক্ত আনন্দ বিভক্ত বিশ্ব
কিছুদিন পূর্বে বৃটিশ প্রাইম মিনিষ্টার ডভেডি কমেরুন এবং ওবামা রোজার তাৎপর্য গেয়ে একটি বাণী দিয়েছেন বিশ্ব মুসলিমের জন্য। চোখ খুলে পড়লে দেখবেন কতইনা দরদ ইসলামের জন্য!? আহা! মারহাবা! আর চোখ বন্ধ করে পড়লে বুঝবেন ‘আসছে ঠেলা’। ঈদবাণী প্রচারতি হবার সাথে সাথে ইসরাইল ঘোষনা দিয়েছে তারা গাজায় স্থায়ী ভাবে বসতি নর্মিাণ করব। দেখুন কি ফজলিত?প্যালস্টোইনরে ৬০ বছররে কান্না এখন আর কউে শুনে না। কাশ্মির ও আফগানিস্তানের কথা তো পুরাতন। আমরা তাদের কথা আর বলি না। মনে হয় যেন বিষয়গুলি আমাদের জন্য নয়, নয় আর্ন্তজাতিক সমস্যা। এদের জন্য রামাদ্বানের বাণী ওরা দেন না। কারণ, সে সব দেশের মানুষ বার মাস রোজা রাখেন। সম্ভবতঃ কাজী নজরুল এদরে জন্যই গয়েছেনে,’জীবন যাদরে হররোজ রোজা, ক্ষুধায় আসে না নীদ.’। তাই রোজার ঐতিহাসিক মাহাত্ম তাদের বুঝার দরকার হয় না। বুঝাতওে হয় না। এ কথা ওবামারা জানেন। তা হলে দেখা গেল রোজার আনন্দ সবার জন্য নয়-বিভক্ত হয়েই রইল। বভিক্ত করইে ছাড়ল।
বিভক্তি নিয়েই দুনিয়া চলছে। বিশ্বটি সব সময় এবং সব কিছুতে দুভাগে ভাগ করা। সত্য-মিথ্যা, রাত-দিন, ভাল-মন্দ, বেহস্তে-দোজখ, আলো-আঁধার, পরাশক্তি-মরাশক্তি, উন্নত-অনুন্নত এবং গুরু আর গরু।
মিথ্যার যাঁতাকলে সত্যের ত্রাহী মধুসুদন রব। রাতের অন্ধকার গ্রাস করে নেয় চাঁদ-সূর্যের সমস্ত প্রভাকর। মন্দের দ্বন্ধে পূবালী পুষ্পগন্ধে আজ আর কোন আমেজ নেই। দোজখের দাবদাহ ম্লান করে দেয় জান্নাতি অপূর্ব আবহ। আঁধার সব সময় বিজয়ী আলোর উপর। পরাশক্তি গ্রাস করে নেয় মরাশক্তির অস্থি-মজ্জা, ভিটা, মাটি, পাটিও। উন্নতরা আকাশে বেড়ায়, অনুন্নতদের স্বদেশের মাটিতে কবরও মিলে না, তারা নিজ ভূমে পরবাসী, উম্মুক্ত কয়েদী। জেলে কয়দেীরা খাওয়া-থাকার নরিাপত্তা পায়। কন্তিু অনকে দশেরে মানুষ নজি দেশে সে অধকিারটুকুও পাচ্ছে না। ভক্ষিার থলটিওি কেড়ে নয়ো হচ্ছে।
গুরুর মাইর গরু তো খেয়েই চলছে সে আবহকাল থেকে। চষছে হাল, কাঁধে জোয়াল, মহাজনের গোলা টইটুম্বর, অনাহারী গরু যায় শুকুনের পেঠে। এই ভাবে আমরা ভাল আছি। বাঁচি, নাচি, খাই, গাই, হাসি-রাশি রাশি। একদিকে তৃতীয় বশ্বি জ্বলে পুড়ে চর্তুথ বিশ্বে রূপ নিচ্ছে অন্য দিকে শতকোটি বলিয়িন দিয়ে সাপ্লাই দয়ো হচ্ছে রক্তাক্ত গণতন্ত্র ইরাকে আফগানে! কী সাংঘাতিক আত্মপ্রবঞ্চনা! অথচ মানব মানসে, সভ্য আবাসে বিশ্বচিত্র এ রকম হবার কথা ছিল না। কথা ছিল:‘No one can be perfectly free till all are free; no one can be perfectly moral till all are moral; no one can be perfectly happy till all are happy.’ ঈদরে এই দিনে তাই হোক আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি বাংলাভাষাবাসি সহ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ্র জন্য ঈদ বয়ে আনুক সুখ-শান্ত-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ। সবার জন্য রইল পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা।
২৫.০৮.১০ লন্ডন। sagarsahara@hotmail.com
Priyoaustralia.com.au Sep 2010