Child Health and Wellbeing
বাচ্চার অপুষ্টি ভাবনা !! সাপ্লিমেন্ট সহায়ক
আলমামুন আশরাফী
বাচ্চা নিয়ে মা-বাবার চিন্তার অন্ত নেই। সোনামনি কি খাবে, আর কি খাবে না – এ নিয়ে সারাদিন দৌড়-ঝাপ দিতে-দিতে নিজেদের নাওয়া-খাওয়া বন্দ করে চাল-চুলো সিকেয় তুলে সন্যাসী হবার যোগাড়। এশিয়ানরা এ দৌড়ে একটুখানি এগিয়ে পশ্চিমের তুলনায়। আর বাংলাদেশ বল্লেতো পোয়াবারো! দেখা গেল বাচ্চা মাংশ খাচ্ছে কিন্তু দুধ গিলছে না; আবার দুধ গিলছে কিন্তু সব্জি নিচ্ছে না! তারপর ঢাকার বাজারের ভেজালের কথা বল্লেতো অক্কা – মাল্টিভেজালের অভার ডোজে সচল মানুষ বিকল হয়ে অকালে ঝরে যাচ্ছে। ছুটাছুটি করছে ডাক্তার আর ডায়াগোনাইজ সেন্টারে – এর বাইরের আলো চোখে পড়ে না। ফলে গচ্চা যাচ্ছে কাড়ি-কাড়ি টাকা, বিসর্জন দিতে হচ্ছে জায়গা-জমি। টাকার অংকের অমিলে গরমিলে মেজাজের ফাকে বিজ্ঞ ডাক্তার অজ্ঞ মাল্টিভিটামিন বা ভিটামিন নেয়ার ব্যবস্থাপত্র দেয়! এই মাল্টিভিটামিন বা ভিটামিন বাচ্চার দরকার কি দরকার নাই তা জানা না থাকেল ক্ষতির মাত্রা দেখে আক্কেল গুড়ুম হতে পারে। তাই অন্তরক্ষার জন্য কয়েকটা ব্যাপার জানা দরকার যা এখানে তুলে ধরা হলঃ
অধিকাংশ বাচ্চার মাল্টিভিটামিন নেয়ার দরকার নেই
মাল্টি শব্দের অভিধানিক অর্থই হল নির্দিষ্ট্র পরিমানে কোন বস্তুতে ভেজাল মেশানো যেমন মাল্টিক্যালার সার্ট বা শাড়ী। ফলে ভেজালের মাত্রায় গরমিল হলেই (ইভেন ন্যানোস্কেলে) অমিল আসবে জীবন চলার পথে। তাই সুস্থ্য ও স্বভাবিক বাচ্চাদের মাল্টিভিটামিন খাবার ব্যাপারে আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়ার্টিক্স (AAP) পরামর্শ দেয় না। বলা হচ্ছে যে “বাচ্চা যদি পরিমিত পরিমানে খাবার টেবিলের সব খাবার শেষ করে উঠে তার জন্য মাল্টিভিটামিন জরুরি নয়”। পরিমিত খাবার বলতে এখানে সব ধরণের খাবারে রুচি আছে এবং রুচি সহকারে সব খাবার শেষ করা (অন্য কথায় ব্যালান্স ডায়েট)। এ তালিকায় শাকসব্জি থেকে শুরু করে মাছ, মাংশ, ফলমূল, দুধ, ডিম ও মিনারেলস আছে যা চিত্রে দেখানো হল। তাই বাচ্চারা নিয়মিত সব ধরণের খাবার গলাধিকরণ করলে মাল্টিভিটামিন নেয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
অধিকাংশ বাচ্চার ভিটামিন ডি জরুরী
স্বভাবতঃ বাচ্চারা পরিমিত ভিটামিন ডি পায় না – কারণ তারা বেশী সময় পার করে না রোদ্রে যেখানে ভিটামিন ডি তৈরী হয়। আবার যখন রৌদ্রে সময় দেয়, তখন হয়তো রোদ্রে পুড়ে তামা হয়ে যাই যা চামড়াকে ভিটামিন ডি তৈরীতে বাধা দেয়। এ ছাড়াও, সুষম দুধ (ল্যাক্টোজের মাত্রা) পান করেনা (বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে) যা দরকার। আসলে ভিটামিন ডি জরুরী বাচ্চার গঠনে – এটা ক্যালসিয়াম এ্যাবজর্ব করে হাড়ের গঠনে সাহায্য করার জন্য। দেখা যায় যে, বাচ্চারা যদি শৈশবেই যথেষ্ট পেশী শক্তির অধিকারী হয়, তবে যৌবনে অস্টেপোরোসিস হবার সম্বাবনা অনেক কম থাকে – রিচার্যারদের ধারণা। ২০০৮ সাল থেকে APP রিকমান্ড করছে বাচ্চাদেরকে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট হিসাবে খেতে, বিশেষ করে যাদের রৌদ্রের সাথে নিয়মিত মাখামাখি নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের বাচ্চাদের জন্য ভিটামিন ডি অত্যন্ত জরুরী কারণ এম্নিতেই আমরা কালো, তারপর বিদেশে এসে রৌদ্রের মুখোমুখি একেবারেই হই না। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, আমাদের বেশীরভাগেরই ভিটামিন ডি’র অভাব যার পরিণতি বুড়া বয়সে হাড়-গোড় ব্যাথা-জনিত সমস্যা।
এর সাথে মিনারেল আইরনও অত্যন্ত জরুরী যা মাসল ও ব্লাডসেল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বলা হয় প্রতিদিন ১০ গ্রাম করে আইরন নেয়া দরকার একজন বাড়তি বাচ্চার। আর শৈশবে পদার্পণ করছে এমন বাচ্চার জন্য আইরন দরকার ১২-১৫ গ্রাম প্রতিদিন।
মাল্টিভিটামিন সাহায্য না করলেও ক্ষতি করতে পারে
আগেই বলেছি মাল্টি শব্দের অর্থ ভেজাল ফলে মাত্রার অসুষম বন্ঠনে (disproportionate ingredients) অসময়ে লন্ঠন জ্বালাতে পারে জীবন দ্বীপে। তাই ডাক্তার ভাটিয়ার মতে (APP), কোন বাচ্চা যদি নিয়মিত সেরেল্যাক ও দুধ খায় তবে মাল্টিভিটামিন কখনোই বেশী দেয়া যাবে না (overdose)। কিন্তু যদি দেখা যাই যে, বাচ্চা প্রতিনিয়ত সিক হচ্ছে (on and off) এবং গ্রোথ অস্বাভাবিক তবে সে ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ মতো ব্যবস্থাপত্র নেয়া জরুরী। মাল্টিভিটামিন এক্ষেত্রে জরুরী হতে পারে; অনেকটা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া।
মাল্টিভিটামিনের অভারডোজ সাধারণতঃ নানা রকমের পাশ্বপ্রতির্কিয়ার জন্ম দেয়। খুব কমন পাশ্বপ্রতির্কিয়াগুলো হল এলার্জিক রিয়াকশন যেমন র্যা শ, চুল্কানি, শ্বাস কষ্ট, বুকে চাপ, গাল, মুখ, ঠোট ও জিব্বা ফুলা, ইত্যাদি। ভিটামিনের মাত্রাতিরিক্ত অভারডোজ অনেক সময় লাইফ থ্রেটেনিং হতে পারে, শুরু হতে পারে ওয়েট লস, মাথা ব্যাথা ও ব্যাক পেন।
মেগা-ফ্যাটি এসিড ব্রেন ডেভোল্পমেন্টে উপকারী কিনা – ইভেন সেপ কিনা সংশয়ে
ডাক্তার কিম্বার্লির (APP) মতে, আজোব্ধি এমন কোন প্রুফ নেই যে ওমেগা-৩, ৬ ও ৯ বাচ্চাদের জন্য উপকারী এবং ব্রেন ডেভোল্পমেন্টে সাহায্য করে। ফলে এগুলো বাচ্চাদের হরহামেশা রিকমান্ড করা শ্রেয় নয়। ২০০৭ সালের এক স্টাডি (Lipids in Health and Disease) থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ওমেগা-৩ ফ্যাটি-এ্সিড অনেক সময় সাহায্য করতে পারে কমিনিকেশন্স ডিসঅডার (hyperactivity) জনিত সমস্যায়। আবার অন্য সমীক্ষায় (August 2009 Issue of Neurology) দেখা যাচ্ছে, ওমেগা-৩ কোন কাজই করেনা এক্ষেত্রে। তাই হাইপার এ্যাক্টিভিটি-জনিত কোন সমস্যা থাকলে ওমেগা-৩ বা মেগা-ফ্যাটি-এসিড খাবার মেনুতে আনার আগে ডাক্তারের পরামর্শ জরুরী। বিখ্যাত ডাক্তার গুইলিয়ানোর মতে, মেগা-ফেটি-এ্সিডের উপর এ্যাডভান্স কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়নি। তাই অহেতুক জরুরী না হলে কোনভাবেই ফ্যাটি-এসিড বাচ্চাদের সেবন করানো যাবে না ব্রেন ডেভোল্পমেণ্টের দোহাই দিয়ে। সাময়িক ব্রেন ফাংশন বলে কিছু আছে কিনা জানা নেই তবে এমনটা নয় যেমনটা আছে ভায়াগ্রা সেবনে।
ভিটামিনের ডোসের জন্য বোতলের গায়ে লেখা পড়ুন
ভিটামিনের পরিমান সাধারণতঃ I.U.S বা mgm লেখা থাকে। বলা হয়, ডাক্তারের উপদেশ ছাড়াও বোতলের গায়ের লেখা ফলো করতে। কোন কারণে ডাক্তার ভুল অভারডোজের প্রেস্কিপশন্স দিলে ক্ষতি হতে পারে। যেটা আমরা হরহামেশা অবহেলা করি তা হলো বোতলের/শিশির গায়ের লেখা কখনো পড়ি না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও তাই – ঔষুধের বোতলের গায়ের লেখা কখনো পড়া হয় না। অথচ ওটা দেখেই একজন ডাক্তার ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন; বুঝতে পারেন ঔষুধের গুরুত্ব ও ব্যবহারবিধি। এ ব্যাপারে আরো সচেতনতা কাম্য। লক্ষ করলে এক্সপায়ার ঔষধ কেনার হাত থেকেও রেহাই পাওয়া যায় যা ঢাকাতে বাজারমাত। এক্সপায়ার ঔষধ খেয়ে বাচ্চারা বিকলংগ হচ্ছে, হারাচ্ছে দেহের ভারসাম্য চিরতরে।
ষ্টোর করুন সঠিকভাবে – ব্রান্ড জরুরী
ঔষধের ধর্ম অনুযায়ী বাসায় ষ্টোর করা জরুরী। ফ্রিজে রাখার ঔষধ বাইরে রাখলে হারাতে পারে গুনাগুন কারণ এগুলো কেমিক্যালস – অবস্থা ভেদে ধর্ম পরিবর্তন হয়।
প্রত্যেক দেশে ফুড এন্ড ড্রাগ এ্যাডমিনিষ্ট্রেশন ভিটামিনের (/ঔষধের) ব্রান্ড রেগুলেশন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে লিকুইড ঔষধ বাজারে ছাড়ার আগেই টেষ্ট করা হয় গুনাগুন ঠিক আছে কিনা। কিন্তু পিলের ক্ষেত্রে সচরাচর সব দায়িত্ব প্রস্তুতকারী কোম্পানীর। কোম্পানীর দায়িত্ব হলো ভিটামিনের সঠিক গুনাগুন ইন্সিউর করা। বাজারের ঔষুধের গুনাগুনের মাত্রা নির্ধারণে এখানেই যত গন্ডগোল। সে জন্য সচরাচর ভাল ব্রান্ডের ঔষধ কেনা উত্তম, বিশেষ করে পিল/বড়ি কারণ ভাল ব্রান্ড মানে ভাল কোম্পানী। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা হয় তা হল, ভিটামিনের গুনগত পরিমানে কম বেশী থাকে নিন্ম ব্রান্ডের ঔষধে কারণ মাল্টিভেজালে এভেন ন্যানোস্কেলের হেরফেরে অনিষ্ট হতে আসতে পারে। ফলে দু’টাকা বেশী গচ্চা গেলেও ব্রান্ডের ঔষধ কিনলে ফল ভাল পাবার সম্ভাবনা উজ্জল, সাথে জীবনের ঝুকি কম। তাই ডাক্তারের দোহায় না দিয়ে চোখ খুলে পড়ে বুঝে নিন এবং ব্রান্ড চিনে ঔষধ কিনুন।
খাদ্যাভাস থেকে ভিটামিন গ্রহন করুন
ভিটামিনের জন্য সবচেয়ে বড় ডিপো হল নিয়মিত সব ধরণের খাদ্য গ্রহন করা (ব্যালান্স ডায়েট) – যেমন ফল, মূল, মাংশ, সাকসব্জি ও দুধ। চিত্রে খাবারের প্লেট দেখানো হলো, সাথে বাচ্চার পিল খাওয়ার দৃশ্য। সে ক্ষেত্রে খাবার টেবিলে সব ধরণের খাবার পরিবেশন জরুরী, বিশেষ করে নানা রকমের ফলমূল। আজকাল্কার বাচ্চারা ফল-মূলের পরিবর্তে ম্যাগডোনান্ড খেতে পছন্দ করে। কিন্তু এরি ফাকে খেলার ছলে, কৌশলে ফল-মূল খাওয়ার অভ্যাস জরুরী, সাথে দুধ ও মিনারেলস বাড়তি বাচ্চার জন্য। মিনারেলন্সের তালিকায় থাকা উচিত আইরন, জিংক, ম্যাগ্নেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ইত্যাদি যা নিয়ে অন্য কোন্দিন আলোচনা করবো।
ভিটামিন ডি খাদ্যে অপ্রতুল কিন্তু পাওয়া সম্ভব
ভিটামিন ডি খুব অল্প খাবারে পাওয়া যায়। ফ্যাটি মাছ যেমন সালমন ও টুনা মাছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ডি আছে। বিফ লিভারেও বেশ ভিটামিন ডি আছে কিন্তু সবার জন্য প্রযোজ্য নয় কারণ বিফে প্রচুর পরিমানে কোলেষ্টেরল থাকে যা হ্নদ রোগের ঝুকি বাড়ায়। অধিক পরিমানে ডি পাওয়া যায় দুধ থেকে – বলা হয়ে থাকে দুধ ভিটামিন ডি’র ডিপো। অরেজ্ঞ জুসে ও কিছু সেরেলাকেও ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। তাই নিয়মিত দুধ ও অরেজ্ঞ পান করা উচিত, বিশেষ করে সকালে। আমি দেখেছি, ফ্রান্সের মানুষ প্রতিদিন সকালে অরেজ্ঞের জুস (৮০%) পান করে – অনেকটা নিয়মিত।
ভিটামিনের ও মিনারেলের মাত্রা (একজন ৩~৮ বছরের বাচ্চার জন্য)
ভিটামিন ডোজ (IU/day) মিনারেল ডোজ (মিলিগ্রাম/day)
এ ৪০০ আইরন ১০
বি(ফ্যাটিএসিড) ৩০০~৪০০ জিংক ৫
সি ২৫ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ৪০০
ডি ৪০০ সেলেনিয়াম ৩০
ই ৩০০ ম্যাগ্নেসিয়াম ১৩০
উল্লেখ্য, ডোজের মাত্রা কম-বেশী হতে পারে নানান দেশের নানান স্কেলে।