পৃথিবীর পথে পথে, সেই পথ যেন না শেষ হয় (পর্ব ৩)
আমেরিকা এসে এখানকার একজনের কাছে প্রথম যখন শুনেছিলাম, তার পরিবার ঘাসের ব্যবসা করে; হঠাৎ করে শুনে প্রথমে কিছুটা থমকে যাই। একসময় বুঝতে পারি, ঘাসের ব্যবসা এখানে বেশ লাভজনক ব্যবসাই। জমির পর জমি এরা ঘাসের চাষ করে যায়। বিভিন্ন জাতের বাহারি ঘাস। সৌখিন মানুষেরা সেই সব ঘাস কিনে নিয়ে লাগায় নিজ বাড়ির আঙিনায়, কিংবা অফিসের চারপাশে। এরা বলে গ্রাস ফার্ম বা ঘাস খামার। শুধু ঘাস নয়, আছে আমাদের দেশের মত কৃষিখামারও।
যে বন্য সুখে আমি বড় হয়েছি, সেটা এখানে বিরল। ছোটবেলায় কাদা মাটি ছিল, কলমি ফুল ছিল। শীতের সকালে কুয়াশার ভীড়ে লুকিয়ে থাকা ডাহুক ছিল। কচুরি পানা ছিলো, লাউয়ের ডগায় বসে থাকা ফিঙে ছিল। উত্তর আকাশে ধ্রুব তারাটি ছিলো। কুমড়ো ফুল আর রক্তজবারা ছিলো। শিমুল গাছের ছায়া-ঢাকা গাঁয়ের মেঠো পথটি ছিলো। বাংলায় আমার চারপাশের একমাত্র শিল্পী, একমাত্র স্থপতি ছিলো প্রকৃতি। সে মনের সুখে নিজের মত করে সাজিয়ে নিতো দশ দিগন্ত।
ছবিঃ কাদামাটিও যে মিস করা যায়, সেটা এখানে না আসলে বুঝতাম না।
এখানে, আধুনিক প্রযুক্তি, অত্যাধুনিক জীবন-যাপন। চোখ মেলে তাকালেই আকাশ ছোঁয়া ভবন। তবু, এখনো কেন জানি, আকাশ নয়, মাটির কাছাকাছি কোথাও ছুটে গেলেই সবচেয়ে বেশি স্বস্তি বোধ করি। তবে, আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, শহর থেকে বেরিয়ে গেলে এখানেও পাওয়া যায় প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য। কি জানি, হয়তো একটা কৃষি খামারই হতে পারে, প্রকৃতির সেরকম এক আনন্দভূমি। অন্ততপক্ষে, কিছুটা বৈচিত্রতো থাকবেই। ইট পাথরের শহরের চেয়েতো আলাদা হবে। সে আশা মনে নিয়ে, একদিন ঠিকই গিয়ে উপস্থিত হলাম, পাহাড়ী উপত্যকার মাঝে গড়ে উঠা এখানকার এক কৃষি খামারে।
ছবিঃ খামারের আসপাশে গড়ে উঠা আবাসস্থলগুলো
একটা নয়, একসাথে অনেকগুলো খামারই আসলে ছিলো। খামারগুলোর মাঝ দিয়ে যেতে যেতে দেখছিলাম কোনোটায় গরু আছে তো অন্যটাতে আছে ঘোড়া, কোথাও বা আবার জড়ো করে রাখা আছে শুকনো খড়ের স্তূপ। তবে, প্রায় সবগুলো খামারেই আছে সব্জির বাগান।
এক সাথে অনেকগুলো খামার থাকার বেশ কিছু সুবিধাও আছে। কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য রাস্তা করে দিয়েছে, খাল কেটে দিয়েছে; যাতে করে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা পানি উপত্যকা থেকে সহজে বেরিয়ে যেতে পারে।
ছবিঃ খামারগুলোর পথ ধরে…
আমার যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে গিয়ে ঢোকার পথেই দেখি চিক-চিক ডাকে ধূলো উড়িয়ে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে মুরগীর বাচ্চাগুলো। খুবই সাধারণ একটা দৃশ্য, কিন্তু সেটাই আমার কাছে অনন্য আনন্দের উৎস হয়ে দাঁড়ালো। ফার্মের মালিক ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে ভিতরে নিয়ে গেলেন।
খানিকটা সময়ের পর উনার সাথে বেরিয়ে পড়ি। তিনি বলে গেলেন ফার্মটি গড়ে উঠার ছোট্ট ইতিহাস। সেটা বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার বেশ আবেগী হয়ে উঠলেন। বুঝা যায় খুব আগ্রহ নিয়ে তিনি এখানে আছেন।
ছবিঃ এখানে কাজ করে কি কখনো বিরক্ত হওয়া সম্ভব!
কিন্তু, অত ইতিহাস বলার সময় কি আর আছে! কাজের সময়ে কাজ। সামনে নতুন বীজ বপণ করতে হবে। তাই, কিছুক্ষণের মধ্যেই কোন দিকে যেতে হবে সেটা দেখিয়ে দিয়েই, নিজ গিয়ে উপস্থিত হলেন জমির মাঝখানে। চালাতে শুরু করেলেন ট্রাক্টর।
ফিরে এলে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, কত জন থাকেন এই ফার্মে। উনি বললেন, রাতে দুইজন এখানে থাকেন, তাদের ফ্যামিলি এখানে। আর, দিনে আরো দুইজন আসে কাজ করতে। মাত্র চারজন, উনি সহ পাঁচজন।
ছবিঃ সেই চার-পাঁচজনের একজন।
এত বড় ফার্ম অথচ মাত্র চার-পাঁচজন লোক মিলে চালিয়ে নিচ্ছেন। তার উপর আবার বেশ কিছু গবাদি পশুও আছে। শুধু কি তাই, উনার ফার্মের গরুর সাথে পাশের ফার্মের ষাঁড়ের কি পরিমাণ ব্যাপক প্রেম, সে কাহিনীও জানাতে ভুললেন না।
আমি অবশ্য অপেক্ষা করছিলাম রাখাল দেখার জন্য; অপেক্ষা করছিলাম কে এই গবাদি পশুগুলোকে সামলায়, সেটা দেখার জন্য। ততক্ষণে, কোনো ধরণের সম্ভাবনা না থাকার পরও, আমার চোখের উপর ভাসতে শুরু করেছে কোমরে বাঁধা গামছা, হাতে ছড়ি, কানে বাজতে শুরু করেছে বাঁশি। কিন্তু, কিসের কি! আমেরিকান রাখাল আসলো জিন্স আর কেডস্ পায়ে, কপালের উপরে তোলা সানগ্লাস। তার থেকেও বড় কথা রাখাল নয়, রাখালী। সে-সময়ে মনে মনে শুধু ভাবছিলাম, আজ পল্লীকবি জসিম উদ্দিন যদি সাথে থাকতো, তাহলে অনুরোধ করে বলতাম- লেখেন দেখি দুই একটা লাইন, শুনে প্রাণ ভরাই!
ছবিঃ রাখালী
এত সব কিছুর মাঝেও, অনেক অনেক দূর থেকে, প্রায় সবগুলো খামারেই থাকা সাদা সাদা কিছু জিনিস চোখে পড়ছিলো। সাদা রঙের প্লাস্টিকে ঢাকা, স্তূপ করে রাখা কোন এক বস্তু। কোনো ভাবেই সেটা কি জিনিস ধারণা করতে পারলাম না। উপায়ান্তর না দেখে, আমার খামার মালিককে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জানালেন- শীতের সময় সব কিছু তুষারের নীচে ঢাকা পড়ে যাবে। তখন মাঠে ঘাস থাকবে না। তাই, গবাদি পশু গুলোর শীতকালীন খাবারের জন্য, স্তূপ করে সবাই ঘাস সংরক্ষণ করে রাখে। বুঝতে পারলাম, এ-সমস্যাটা আমাদের দেশে নেই।
পার্বত্য উপত্যকা এমনিতেই আমার খুব পছন্দের। তার উপর, সেখানটাতে যদি থাকে এত সব আয়োজন, তাহলেতো আর কথাই নেই। আবার যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে, ফিরে আসার সময় ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, শহর থেকে দূরের এই জনবিরল এলাকায় কেমন থাকে রাতের বেলা, কিসের ডাক শুনতে পাওয়া যায়, কি রকম শব্দ থাকে চারপাশে। তিনি জানালেন, গান শুনতে পাওয়া যায়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিসের গান, কার গান। উত্তর আসলো- কখনো বৃষ্টির গান, কখনো তারার গান!