বহে যায় দিন – কেবল বেদনা অনন্ত হয়, আমি বেদনায় বেঁচে থাকি
> বহে-যায়-দিন সকল প্রকাশিত পর্ব >
।। পাঁচ ৷৷ কেবল বেদনা অনন্ত হয়, আমি বেদনায় বেঁচে থাকি
জন্মগত সূত্রে প্রায় প্রত্যেকটি বাংলাদেশী কোনো না কোনো দিক দিয়ে রাজনীতির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। রাজনীতি যেনো বাংলাদেশীদের জীবনের একটা অঙ্গ । আর তাই বেশীর ভাগ বাংলাদেশীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জীবনের একটা সুন্দর সোনালী সময় পার করে দেয় রাজনীতির পেছনে । কেউ কিছু পায়, তবে অনেকে কিছুই পায় না । তবুও সবাই ধূমায়িত চায়ের টেবিলে, মাঠে-ময়দানে, অফিসে, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে, হাটে-ঘাটে-বাজারে, এমন কী চলতি পথে যানবাহনেও রাজনীতি নিয়ে তুখোড় আলাপ-আলোচনায় মেতে ওঠে। আসলে রাজনীতি প্রায় সব বাংলাদেশীর রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে মিশে আছে।
কথায় আছে, দু’জন বাংলাদেশী একত্র হলে তিন তিনটা রাজনৈতিক দল গড়ে তোলে । মতের এই অমিলের জন্যই আজ বাংলাদেশে একশ’-য়ের ওপর রাজনৈতিক দল । তবে বেশীর ভাগ রাজনৈতিক দলের সদস্য সংখ্যা খুবই নগন্য । এর প্রধান কারণ হচ্ছে মতের অমিলের দরুণ কিংবা কিছু না পাবার অনুশোচনায় গুটিকয়েক ‘লাইক মাইন্ডেড’ রাজনীতিবিদ কিংবা আঁতেল বড় বড় রাজনৈতিক দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়ে তোলেন এইসব ছোট ছোট রাজনৈতিক দল ।
তাছাড়া টিকে থাকার জন্যও বাংলাদেশে রাজনীতি হলো জীবনের একটা অংশ । বেঁচে থাকার জন্য আমাদের যেমন ভাত-কাপড় আর বাসস্থানের প্রয়োজন, ঠিক তেমনই এগুলো পাবার জন্য রাজনীতির প্রয়োজন । বাংলাদেশে রাজনীতি বাদ দিয়ে জীবন চলে না, চলতে পারে না । রাজনীতিবিহীন জীবন চলে বিদেশে, বিশেষ করে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতে । কেনোনা অই সব দেশের সাধারণ জনগনের জন্য রয়েছে সরকার। আমাদের দেশে সরকার আছে নিজেদের জন্য, জনগণের জন্য নয় ।
আমরা যারা প্রথম প্রজন্ম স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য বিদেশে আসি, দেশ ছেড়ে আসার সময় অনেকে নিজেদের মনের অজান্তেই ‘লাগেজ’-এর সাথে যেই জিনিসটা নিয়ে আসি, তা হলো রাজনৈতিক সচেতন মন । ফলে বিদেশের মাটিতে আমরা গড়ে তুলি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল । সঙ্গে করে নিয়ে আসা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে বলেই আমরা রোমে গিয়ে সহজে রোমান হতে পারি না । আসলে আমরা সহজেই নিজেদের অস্তিত্ব এবং স্বাতন্ত্রকে বিসর্জন দিতে পারি না । প্রথম প্রজন্ম হিসেবে প্রবাসের শিল্প-সংস্কৃতি কিংবা রাজনীতির সঙ্গে এসিমিলেট করা আমাদের স্বভাব নয় । কিংবা বুকের ভেতর দারুণ ইচ্ছে জমা থাকলেও সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না । বাংলাদেশী হিসেবে নিঃসন্দেহে আমাদের আইডেন্টিটির সঙ্গে এক ধরনের অহংকার জড়িয়ে আছে। আর সেই অহংকারকে বিসর্জন দিয়ে অনেকের মতো পশ্চিমা সোসাইটির সাথে সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে পারি না, কিছুতেই না ।
বাংলাদেশের আলো-বাতাস, গাছের ডাল-পাতা, সবুজ ঘাসের বুক, নদীর স্রোত আর পাখ-পাখালীর রঙিন পালকের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা সোনালী শৈশব এবং স্মৃতিমাখা দিনগুলো পেছনে ফেলে যখন আমরা বিদেশের মাটিতে পা রাখি, তখন প্রথম খুঁজি দেশী আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা সুপরিচিত বা অল্প পরিচিত কাউকে । ভাগ্য প্রসন্ন হলে কেউ কেউ পেয়ে যাই, অন্যথায় অপরিচিতদের সঙ্গে পরিচিত হই । পরিচয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভাই-ভাবী অথবা আপা-ভাইসাব বানিয়ে ফেলি । কখনও-সখনও বয়স্কদের পেলে আঙ্কেল-আন্টি বলে সম্ভোধন করি । তারপর মতের মিল হলে ক্রমশ গড়ে ওঠে সখ্যতা । নইলে শুরু হয় বৈরী সম্পর্ক, যেমন লেখক আর প্রকাশকের মধ্যে গড়ে ওঠা জটিল সম্পর্ক
পৃথিবীর সকল বড় বড় শহরে যেখানে প্রচুর বাংলাদেশী বসবাস করেন, সেখানে রয়েছে একাধিক দল বা গ্রুপ । এমন দৃশ্য বিরল নয়। গত ২৮শে মার্চ ২০০৬ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় ন্যু ইয়র্ক থেকে মিনা ফারাহ ‘প্রবাসে মাইনরিটির আইডি ক্রাইসিস’ শিরোনামে একটা লেখায় চমৎকারভাবে উপস্থাপিত করেছেন সেখানে বাংলাদেশীরা আগাছার মতো অসংখ্য প্রবাসী সংগঠন তৈরী করে কিভাবে নিজেদের আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগছেন । এইসব বাংলাদেশীরা নিজেদের পরিচয় বা প্রচারের জন্য অথবা একধরনের আত্মতৃপ্তির জন্য সমিতি খোলেন, বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলেন । কোনো কোনো সংগঠন আবার রাজনৈতিক গন্ডির বাইরে, যেমন ভাই-বোন সংগঠন, রুমমেট সংগঠন, পাড়া সংগঠন, থানা সংগঠন, জেলা সংগঠন ইত্যাদি । সুযোগ পেলেই এইসব সো-কল্ড নেতারা “ই” মিডিয়াতে নিজেদের ছবি ফলাও করে ছাপান, সভা-সমিতির মঞ্চে বক্তৃতায় কথার তুমুল ঝড় তোলেন । দেশপ্রেমে গদগদ হন । তারপর বক্তৃতার শেষে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বাড়ী ফেরেন । মিনা ফারাহ উল্লেখ করেছেন এখন আমেরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশীদের মধ্যে প্রচন্ড বিভক্তি, দলাদলি – এমন কি কোর্ট কাচারীও। এই দৃশ্য শুধু যে আমেরিকাতেই দেখা যায়, তা নয়।
সিডনীর কথাই ধরা যাক । জানি, ওখানে অনেক বাংলাদেশী আছেন । থাকবেনই তো । থাকাটা স্বাভাবিক । কেনো না সিডনী হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় শহর। বাংলাদেশীদের মধ্যে কতো যে গ্রুপ, কতো যে বিভাজন – তার কোনো ইয়ত্তা নেই ।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে সিডনীবাসী কাউকে জিজ্ঞেস করলে কেউ সরাসরি বলতে পারবেন না তাঁদের শহরে বাংলাদেশীদের মধ্যে কতোগুলো রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক দল আছে । দল বেশী থাকা মানে কোন্দল । আর এই কোন্দল থেকে জন্ম নেয় কাদা ছোড়াছুড়ি । সুযোগ পেলেই একে অপরের বিরুদ্ধে এক হাত নেন । সময়ে অসময়ে আদাজল খেয়ে বর্ষণ করেন “অনল বাণ” । এইসব করার জন্য ইদানীং বেশ কিছু ইলেক্ট্রোনিক পত্র-পত্রিকা রয়েছে । এই ইন্টারনেট মিডিয়াগুলোতে পরবাসী বাংলাদেশীরা তাদের সুচিন্তিত মতামত, বিভিন্ন কর্মকান্ডের বিশদ বিবরণ এবং নানা সমস্যার কথাই শুধু তুলে ধরেন না, বরং সঙ্গে সঙ্গে একজন আরেক জনের বিরুদ্ধে কিংবা একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে প্রচার করেন নানান ধরনের মুখরোচক কাহিনী । পরবর্তীতে উল্টোপাশের পত্র-পত্রিকায় দেখা যায় পাল্টা বিবৃতি কিংবা জম-জমাট ফিচার বা আর্টিকেল । নিঃসন্দেহে এই নিয়ে দু’পক্ষই বেশ কিছুদিন ব্যস্ত থাকেন পরচর্চায় । যার ফলে ব্যক্তিগত মতানৈক্য কিংবা রাজনৈতিক চিন্তা-ধারার অমিল শেষ পর্যন্ত পারিবারিক পর্যায়ে পৌঁছে ।
একইভাবে উদাহরণ হিসেবে ক্যানবেরার কথাই ধরা যাক। সেই ১৯৮৪ সালে ক্যানবেরাতে এসেই পেলাম হাতে গোণা কয়েকটা পরিবার নিয়ে একটাই সংগঠন – বাংলাদেশ-অষ্ট্ৰেলিয়া এসোসিয়েশন যা এখনও টিকে আছে । এই এসোসিয়েশনের ছাতার নীচে খুশী মুখ নিয়ে সবাই এসে মিলিত হতাম । যদিও কেউ কারোর আত্মীয় ছিলাম না, কিন্তু সবার মধ্যে ছিলো একধরনের নিবীড় সম্পর্ক । বিশেষ করে আমরা যারা তখন ছাত্র ছিলাম, সেই সময়ে কয়েকজন ‘বড় ভাই-ভাবী’ আমাদের জন্য কী না করেছেন । খোঁজ খবর নেওয়া থেকে শুরু করে মাঝে মধ্যে বাসায় নিয়ে সারাদিন হৈ চৈ করা আর পেট পুরে খাওয়া-দাওয়া- সবই ছিলো । ১৯৮৬ সালের শুরুতে শুরুতে এই শান্ত-নিবীড় সম্পর্কের মধ্যে নেমে এসেছিলো শ্রাবণের ঘন কালো মেঘ। এসোসিয়েশনের ইলেকশনের আগে সবাই চাইছিলো হাসমত (মীর হাসমত আলী, এখন রিটায়ার্ড ক্যানবেরাতেই সপরিবারে বসবাস করছেন) ভাইকে প্রেসিডেন্ট বানাতে। তাতে কয়েকজন সো-কল্ড ‘আঁতেল’ নাখোশ ছিলেন । কেনো না আমাদের সহজাত নিয়মে আমরা সবাই চাই নেতা হতে, কেই কর্মী হতে চাই না । Groucho Marx খুবই সত্যি বলেছেন, “I don’t want to belong to any club that will accept me as a member’। এইসব আঁতেলরা ছিলেন পুঁথিগত ‘বিদ্যা’-য় অগ্রগামী । সুতরাং প্রেসিডেন্ট হতে হলে তাদের মধ্য থেকেই হতে হবে । এই ছিলো তাদের ধারণা, মন-মানসিকতা । অথচ বাকী সবাই নির্দ্বিধায় চেয়েছেন হাসমত ভাইকে । এই নিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার অনেক চেষ্টা করেও শেষতক কোনো লাভ হয়নি। ফলে যা হবার, তাই হয়েছে । এসোসিয়েশন ভেঙ্গে গড়ে তোলা হলো ‘বাংলাদেশ ফোরাম’ । অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই মেঘলা বিহীন স্বচ্ছ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেলো দু’টি ভিন্ন গ্রুপ । এই বিভাজনের কোনোই প্রয়োজন ছিলো না। তবুও হয়েছে । শুধু জেদের বশে । কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বছর দুই চলার পর একদিন ‘বাংলাদেশ ফোরাম’ মুখ থুবরে পড়ে যায় । পরবর্তীতে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি । কারণ ‘বাংলাদেশ ফোরাম’-এর জন্মের সময় যারা ছিলেন কান্ডারী, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের উৎসাহ এবং উদ্দীপনা ফুটো করা বেলুনের মতোই থিতিয়ে আসে । এছাড়া তাদের মধ্যে কয়েকজন চাকুরীর সুবাদে চলে গিয়েছিলেন অন্যত্র। বাদবাকী যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন ছাত্র। সাতকূল ভেবে তারা পড়াশুনায় মনোনিবেশ করলে অন্যান্যদের উৎসাহে আরও বেশী ভাটা পড়ে ।
‘মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক প্রাণী” – রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই সত্য অনুযায়ী সমাজের সকল স্তরের নাগরিকদের, বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজকে রাজনৈতিক ভাবে সমাজ সচেতন হতে হয় । এই অমোঘ সত্যকে একটু ঘুরিয়ে অনায়াসে বলা যায় ‘বাংলাদেশী মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক সচেতন’ । এই পর্বের শুরুতেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশী প্রায় প্রতিটি মানুষের রক্তের হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে মিলেমিশে আছে প্রগাঢ় রাজনীতি । তবে বাংলাদেশী যারা দেশে থাকাকালীন অবস্থায় কোনোদিনই কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, তারা পরবাসে এসেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃত্ত হয়ে যান। তার প্রধান কারণ হচ্ছে একধরনের ‘দেশপ্রেম’ ।
পরবাসে বাংলাদেশীরা বাঙালীর বহমান ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করি, পালন করি কিছু কিছু মহান দিবস – যেমন বাংলা বর্ষবরণ বা বৈশাখী মেলা, শহীদ দিবস বা ভাষা দিবস কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারী, বই মেলা, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ঈদ পুর্নমিলনী বা ঈদ মেলা । এমন কী বাংলাদেশ থেকে বিখ্যাত কিংবা স্বল্প পরিচিত শিল্পী এনে সঙ্গীতানুষ্ঠান করি, নাটকও মঞ্চায়ন করি ।
তাতে আমরা স্বদেশের সাথে নিজেদের একধরনের সম্পৃত্ততার কথা জানিয়ে দিই । নিজেদের মনের ভেতর স্বান্তনা খুঁজে বেড়াই । জানি, আমাদের মনের মধ্যে দেশ ছাড়ার অনেক বেদনা জমা আছে, লুকিয়ে আছে হাহাকার । ভাবতে অবাক লাগে, সত্যি আমরা বছরের পর বছর এই পরবাসে বুকের ভেতর নীল বেদনা নিয়ে কী রকম বেঁচে আছি । তাই তো কবি হাসান হাফিজুর রহমানের ‘আমার ভেতরে বাঘ’ কাব্যগ্রন্থের একটা কবিতার লাইন মনে পড়লো, ‘কেবল বেদনা অনন্ত হয়, আমি বেদনায় বেঁচে থাকি ।’
(চলবে)
> বহে-যায়-দিন সকল প্রকাশিত পর্ব >
Related Articles
Diversity
Diversity is often preached as quite a simple process which simply requires an immigrant coming from a foreign land with
Almamun Ashrafi's Bangla Article
কবে কারিগরি শিক্ষা উঠবে আভিজাত্যের আঙ্গিনায়? ১৫ কোটি মানুষের দেশে চাহিদা অনুযায়ী স্কিল্ড ওয়ার্কারের অভাব! অথচ চায়না ও ইন্ডিয়া সমস্ত
Capital Punishment: Arguments For Against
There has been on-going debate on whether death penalty or capital punishment should be retained or abolished. Both sides advance