বহে যায় দিন – Every person is born with talent

বহে যায় দিন – Every person is born with talent

> বহে-যায়-দিন সকল প্রকাশিত পর্ব >

ছয় ।। Every person is born with talent

এ কথা সত্যি যে প্রত্যেক মানুষের ভেতর কম-বেশী প্রতিভা বা ট্যালেন্ট আছে । কেনো না প্রত্যেকটি মানুষই প্রতিভা নিয়ে জন্মায় Every person is born with talent | তবে কারোর ভেতর সেই প্রতিভা থাকে প্রস্ফুটিত ফুলের মতো বিকশিত, ফলে সৌরভ ছড়ায় বাতাসের গায়ে- যা অন্য সকলে বাইরে থেকে তার আচার-আচরণে, চাল-চলনে, এমন কি কথা-বার্তায় দেখতে পায়, কিংবা উপলব্ধি করতে পারে। আবার উল্টোদিকে অনেকের ভেতর সেই প্রতিভা থাকে সুপ্ত বা ডরম্যান্ট – যা কিনা ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’-র মতো । সুযোগ-সুবিধা কিংবা উপযুক্ত পরিবেশের জন্য চাতকের মতো প্রতীক্ষায় থাকে কখন আসবে সেই সূবর্ণ সময় । সেই সূবর্ণ সময় এবং পরিবেশ পেলেই ফুটো করা বায়ু ভর্তি বেলুনের ভেতর থেকে যেমন হুড়মুড় করে বাতাস বেড়িয়ে আসে, সেই রকম তাদের ভেতর জগত থেকে বেড়িয়ে আসে প্রতিভা । তখন তাদের অই প্রতিভার বিচ্ছুরিত আলোয় আলোকিত হয় চারপাশ । অথচ তাদের মধ্যে বেশীর ভাগই জানে না এতোদিন কি করে এমন প্রতিভা লুকিয়ে ছিলো তাদের ভেতর অন্তরের গভীরে । তারা নিজেরাই অবাক, বিস্মিত ।

কিছু কিছু প্রতিভা বিকাশের মোক্ষম পরিবেশ হচ্ছে এই পরবাস । আমরা যারা দেশ ছেড়ে পরবাসে আছি, তারা ক’জনইবা আগে থেকে রান্না-বান্না কিংবা সঙ্গীত চর্চায় পারদর্শী হয়ে এসেছিলাম । হাতে গোণা গুটি কয়েক মাত্র । বেশীর ভাগই আনাড়ী । কিন্তু বিদেশে এলে প্রতিভার সেই সব দরোজা খুলে যায়, কারোর বেলায় অনিচ্ছায়, আবার কারোর বেলায় সখের বশে। পরবর্তী সময়ে আমরা অনেকেই হয়ে উঠি হয় চৌকশ সঙ্গীত শিল্পী কিংবা পাকা রাঁধুনি । আমার স্ত্রী এবং আমি যখন সেই ১৯৮৪ সালের শুরুতে এই ক্যানবেরায় এসেছিলাম, তখন আমরা কেউই ভালো রান্না করতে পারতাম না। দেশে সেই সুযোগ ছিলো না খুব একটা, বিশেষ করে আমার বেলায়। বাংলাদেশের সামাজিক পরিবেশে ক’জন পুরুষ রান্না শেখে। সংখ্যায় খুবই নগন্য । নেই বললেই চলে। অথচ বিদেশে এসে আমাদের, অর্থাৎ এই পুরুষদের, পরিস্থিতির চাপে পড়ে রান্না শিখে নিতে হয়েছে । এখন আমাদের ভেতর অনেকেই বড় বড় অনুষ্ঠানে রান্না করে তিন-চার শ’ অতিথিকে অনায়াসে পেট ভরে খাইয়ে দিতে পারেন।

একসময় আমিও মোটামুটিভাবে বেশী লোকের বিভিন্ন ধরনের রান্নার নিয়ম-কানুন রপ্ত করে নিয়েছি। পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে আমি যাদের কাছ থেকে বড় বড় অনুষ্ঠানের জন্য রান্না শিখেছি, তাদের মধ্যে আলী আকবর ভাই (উনি তখন সপরিবাবে ছিলেন, এখন ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন), জিল্লুর ভাই (জিল্লুর রহমান, এখনও এখানেই আছেন), তারা ভাবী (মিসেস আনোয়ারা বেগম, মরহুম ফকরুল আলম মিন্টু ভাইয়ের স্ত্রী, সিভিকের “শালিমার’ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের মালিক), মরহুম ডক্টর গোলাম কিবরিয়া (উনি ১৯৮৬ সালের শেষ দিকে নিউ ক্যাসেলে স্ত্রী ফ্রান্সিসের সঙ্গে সাঁতার কাটার সময় সমুদ্রে ডুবে ইন্তেকাল করেন, ইন্নালিল্লাহে……. রাজেউন) ভাইয়ের নাম উল্লেখ করার মতো । তাছাড়া রোকেয়া ভাবী (মিসেস হাসমত আলী) এবং দুই নাজমা ভাবী (মিসেস জিল্লুর রহমান এবং মিসেস ডক্টর মোখলেসুর রহমান)-র কাছে শিখেছি মিষ্টি বানানো। কোনো সন্দেহ নেই যে, এইসব ভাবীরা খুব ভালো রান্না করেন এবং বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি বানাতে পারেন ।

যাহোক, দু’একটা ঘটনার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সেই সময় বাবু ভাই (ফকরুল আহসান বাবু, একসময় আবাহনী ক্লাবের উইকেট কীপার ছিলেন এবং ব্যক্তিগত জীবনে ডক্টর নীলিমা ইব্রাহীমের মেয়ের জামাই) ডেভেলাপমেন্ট ইকোনোমিক্সের ছাত্র ছিলেন এবং ‘টোড হল’-এ থাকতেন । প্রথম দিকে উনি একাই ছিলেন । তখন ভাবী এবং বাচ্চারা কেউ আসেনি । উনি রান্নার ‘র’-ও জানতেন না । টোড হলে গিয়ে তাকে রান্না করে দিতাম, তবে শনিবার এবং রোববার উনি প্রায়ই আমাদের সঙ্গে খেতেন। একবার উনি অনুরোধ করলেন আমি যেনো এক টুকরো কাগজে ডাল রান্নার রেসিপি লিখে দেই । একদিন বাবু ভাইয়ের হলে গিয়ে দেখি উনি আমার হাতের লেখা সেই রেসিপির কাগজটা চুলার পেছনের দিকের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছেন । জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে বললেন, বারবার রুমে গিয়ে যাতে দেখতে না হয়, তাই এই ব্যবস্থা । সেদিন আমি প্রচন্ড হেসেছিলাম এই কারণে যে ভাগ্যিস টোড হলের অন্য আর সবাই বাংলা পড়তে পারে না । পরে অবশ্য উনি বেঁচে থাকার জন্য কিছু কিছু রান্না শিখেছিলেন ।

গত আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ অবধি প্রতি বছরের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে পালন করা হতো ‘বাংলাদেশ নাইট’ । বেশীর ভাগ অনুষ্ঠান হতো ফরেষ্ট সাবার্বের ‘ইটালো-অষ্ট্ৰেলিয়ান’ ক্লাবে। সেই সব অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পর্বের সঙ্গে ছিলো বাংলাদেশের, বিভিন্ন রকমের মুখরোচক সুস্বাদু খাবার। আলী আকবর ভাই, জিল্লুর ভাই, মরহুম ডক্টর গোলাম কিবরিয়া ভাই – এক এক জন এক এক বছর তিন-চার শত অতিথির পুরো রান্নার দায়িত্ব পালন করতেন । অবশ্য ভাবীরা তৈরী করতেন মিষ্টি জাতীয় খাবার।

১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্ঝন্ত আমি ছিলাম বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া এসোসিয়েশনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক । তখন বাংলাদেশ হাই কমিশনের কাউন্সিলর ছিলেন জনাব রাশেদ (তাঁর পুরো নাম মনে করতে পারছি না) । তাঁর স্ত্রী হলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মিসেস রেবেকা সুলতানা । আমি যে কোন অনুষ্ঠানের জন্য রেবেকা ভাবীকে টেলিফোন করলেই প্রাথমিক শুভেচ্ছার পর উনি সরাসরি জিজ্ঞেস করতেন কোথায়, কবে, কখন এবং কোন অনুষ্ঠানে গান গাইতে হবে । উনি কোনোও দিন মানা করেন নি, বরং উৎসাহ দিয়েছেন, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন এবং অনুষ্ঠান সাজানোর জন্য আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন । এতো বড় মাপের শিল্পী হয়েও তিনি এইসব ছোটখাটো অনুষ্ঠানে একাধিক গান গেয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করেছেন, আনন্দ দিয়েছেন । তবে সেইসব দিনগুলোতে আমাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা হয়তো দেশে থাকাকালীন সময়ে কোনোদিনও ‘সা রে গা মা পা ধা নি সা’-র চর্চা করেননি, কিন্তু তারাও স্টেজে উঠে সাবলীলভাবে এবং নিঃসংকোচে কোরাস গানে অংশগ্রহন করেছেন। এদের মধ্যে জয়নাল ভাই (জয়নাল আবেদীন, এখনও ক্যানবেরাতেই বসবাস করছেন), এজাজ (নাসের এজাজুল হক, সেই সময় এ-এন-ইউ-র পি-এইচ-ডি-র ছাত্র) এবং তপন ভাই (তপন মির্জা, পরে

এখান থেকে চলে গেছেন অন্যত্র) উল্লেখযোগ্য। তবে রুবী ভাবী (মিসেস ফজলুর রহমান । ফজলুর রহমান তখন ছিলেন এ-এন-ইউ-তে কেমেস্ট্রির পি-এইচ-ডি-র ছাত্র, বর্তমানে আমেরিকায় সপরিবারে বসবাস করছেন) অত্যন্ত সুন্দর গান গাইতেন । রুবী ভাবী একসময় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন । মাঝে মধ্যে দেখা যেতো দর্শকের চেয়ে স্টেজের সঙ্গীত শিল্পীর সংখ্যাই বেশী। অনেকে আবার বক্তা হিসেবেও নাম লিখিয়েছিলেন । রবীন্দ্র-নজরুল জন্ম-জয়ন্তী কিংবা মৃত্যু দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস অথবা শহীদ দিবস উপলক্ষ্যে যেকোনোও অনুষ্ঠানে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলে দেখা যেতো অনেকেই মাইক্রোফোন হাতে পেলে আর ছাড়তে চাইতেন না ।

গত শতকের আশির দশকে ক্যানবেরায় মুষ্টিমেয় বাংলাদেশীদের ভেতর ছিলো এক ধরনের আত্মীয়তার নিবীড় সম্পর্ক । আমরা সেই সময় সুযোগ-সুবিধা মতো ‘বারবিকিউ’-র আয়োজন করতাম আশেপাশের বিভিন্ন পার্কে । কোনোও কোনোদিন চলে যেতাম ‘কটার ড্যাম’ কিংবা ‘করিন ড্যাম’-এর পিকনিক স্পটে। ভাবীদের দায়িত্ব ছিলো নিজেদের বাচ্চা সামলানো । তারা সপ্তাহের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে মেতে উঠতেন তুমুল গাল-গল্পে । ভাইয়েরা ব্যস্ত থাকতেন মাছ ধরা আর বার-বি-কিউ রান্নায় । অবশেষে এক ধরনের আনন্দ-অনুভূতির পরশ সারা গায়ে মেখে ভর বিকেলে ফিরে আসতাম যার যার ঘরে ।

সেইসব দিনগুলোতে লেক বার্লি গ্রীফিনে কার্ব (দেখতে বাংলাদেশের রুই মাছের মতো) ধরতে যেতেন অনেকেই । মুন্সি ভাই (মুন্সি আনোয়ারুল ইসলাম, তখন ফরেস্ট্রিতে মাস্টার্সে পড়াশুনা করতেন। বর্তমানে বাংলাদেশে ফরেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের একজন উর্ধ্বতম কর্মকর্তা) এবং তাঁর স্ত্রী (হেলেন ভাবী), হাসমত ভাই ও আলী আকবর ভাই ছিলেন অন্যতম । আমরাও যেতাম, তবে মাছ ধরার চেয়ে ‘ফান’ হতো বেশী । যেদিন ফজলুর রহমান যেতেন, সেদিন কেউ কোনো মাছ পেতেন না। কারণ ওনাকে সবাই দোষারোপ করতেন লাউড ভয়েসের জন্য । উনি সারাক্ষণ জোরে জোরে এতো বেশী কথা বলতেন যে পানির গভীরে থেকে হয়তো মাছেরাও তার সব কথা শুনতে পেতো। ফলে ধরা পড়ার ভয়ে আশেপাশে কোনো মাছ আসতো না ।

একসময় আমরা কয়েক পরিবার মিলে রাতে, বিশেষ করে শুক্রবার, কবিতা পাঠের আসর আয়োজন করতাম । তবে বেশীর ভাগ আসর বসতো ডক্টর আবেদ চৌধুরী (স্বনামধন্য ‘জীন’ বিজ্ঞানী এবং কবি)-র কার্টিনের বাসায়। অইসব কবিতা পাঠ আসরের একটা নিয়ম ছিলো এবং তা হলো সবাইকে নিজের লেখা কবিতা কিংবা ছড়া পড়তে হবে। যদি কেউ স্বরচিত কিছু একটা না লিখে আনে, তবে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের কবিতা আবৃত্তি করতে হতো । একবার রমা দেওয়ান (তখন পড়াশুনা করতো, এখন রাঙ্গামাটিতে চাকুরী করে) কিছুই লিখে আনেনি । অগত্যা নিষ্কৃতি পাবার জন্য অই আসরে বসেই লিখে ফেললো, ‘লাল মুজা পায়, টুনু হেঁটে যায়’ । বলা আবশ্যক যে, টুনু তখন লেখাপড়া করতো খুব শান্ত-শিষ্ট এবং ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিলো।

যাহোক, এ কথা আজ আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, বিদেশে এসে আমাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটেছে । আমরা নিজেদেরকে বিভিন্ন দিকে প্রস্ফুটিত করতে পেরেছি । দেশে থাকলে পরিবেশগত কারণে কিংবা সামাজিক অবকাঠামোর জন্য আমাদের এই প্রতিভা হয়তো চিরদিনই সুপ্ত থাকতো। কোনোদিন বিকশিত হতো না । কেউ কোনোওদিন বুঝতে পারতাম না যে আমাদের ভেতর এতো প্রতিভার বীজ লুকিয়ে ছিলো । তবে এর জন্য প্রয়োজন পরিবেশ এবং অপরচুনিটি’ । এই মুহূর্তে আফ্রিকান একটা প্রবাস মনে পড়লো এবং এই প্রবাদটা দিয়েই শেষ করছি এই পর্ব ।

‘Every morning in Africa, a gazelle wakes up.

It knows it must run faster than the fastest lion or it will be killed. Every morning a lion wakes up. It knows it must outrun the slowest gazelle or it will starve to death

It doesn’t matter whether you are a lion or a gazelle. When the sun comes up, you better start running’.

(চলবে)

> বহে-যায়-দিন সকল প্রকাশিত পর্ব >


Tags assigned to this article:
বহে যায় দিন

Place your ads here!

Related Articles

পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব নিয়ে ককবরক (ত্রিপুরা) গান

তুরু রুতু তুরু রু সুমুর সুফতিয়ৈ: পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব নিয়ে ককবরক (ত্রিপুরা) গান ছবিতে: বাম দিক থেকে – মেয়ে

ছোটগল্প – আত্ম বিসর্জন

এক আমি তখন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। সদ্যই হলে ওঠেছি। পাঠ্যের পড়াশোনাতে যতটুকু না আমার আগ্রহ তার চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment