ভোজনানন্দ ও এশার ঈদ

ভোজনানন্দ ও এশার ঈদ

 

ভেজিটেবল লাজানিয়ার ডিশভোজনানন্দ শব্দটি দেখে কেউ ভুল করেও যেন ভাববেন না যে এটি কোনো ব্যক্তির নাম। কেউ যদি মনে করেন, ভোজনানন্দ হয়তো কবি জীবনানন্দ বা স্বামী বিবেকানন্দের কোনো ঘনিষ্ঠজন, তা-ও মহাভুল। তবে সবার মাঝেই এই অনুভূতি কমবেশি আছে বা সময় বিশেষে ভোজনানন্দ হয়। ভুখা মানুষ যখন সামান্য নুনভাতও কাঁচা মরিচ দিয়ে খেতে পায়, তখন তার আত্মা দুলে ওঠে ভোজনানন্দে। চেহারায় ধরা দেয় স্বর্গীয় তৃপ্তি। এই আনন্দ পেটুকের রসনাতৃপ্তির আনন্দ নয়। এ এক অন্য রকম আনন্দ। সারা দিনের রোজার শেষে রোজাদার ব্যক্তি যখন শীতল পানি বা মিষ্টি শরবত সহযোগে পরিমিত ইফতার গ্রহণ করেন, তার অন্তর তখন ভরে ওঠে অনির্বচনীয় সুখে। উপবাসক্লিষ্ট ক্লান্ত চেহারায় তার আভা ছড়ায় বেহেশতি প্রশান্তি।

এশা ভুখা দরিদ্রও না, রোজাদারও নয়। খাদ্যানন্দ যে মানুষকে স্বর্গীয় তৃপ্তি দেয় বা ভোজনানন্দ বেহেশতি প্রশান্তি আনে এমন অনুভূতির সঙ্গে তার পরিচয়ই ঘটেনি। খাদ্যের অভাব কাকে বলে এটা এশা জানে না। সময়ের খাবার সময়ে গ্রহণ করার সুযোগ আছে বলে ক্ষুধিত হওয়ার সুযোগই ঘটেনি কখনো। তবে বিদেশে আসার পর ভোজনানন্দ বা খাদ্যানন্দে বিভোর লোকজন দেখে সে বিস্মিত হয়েছে। তার ওপর খাদ্যাসক্তি থেকে কেউ কেউ এমন বিশাল অবয়ব ধারণ করেছে যে, তাদের দেখে রীতিমতো ভীত এশা।

যেকোনো অনুষ্ঠানে বা দাওয়াতে থাকে খানাপিনার বিশাল আয়োজন। খাবার দেখে ভিরমি খাওয়ার জোগাড় প্রায়। কোনো তরিকা অনুসৃত হয় না খাদ্যসম্ভার উপস্থাপনে। বিরিয়ানি থেকে শুঁটকি সব পদের সমাহার থাকে। কাবাব, রোস্ট, কালিয়ার পাশাপাশি মাছের দোপিঁয়াজা, আস্ত গ্রিলড ফিশ এবং শাক-শুঁটকি, ভর্তা-ভাজি কোনোটাই বাদ যায় না। খাবারের প্রাচুর্যের মতোই পরিবেশও থাকে মানুষে মানুষে জনাকীর্ণ। একবার খাদ্যসম্ভারের পাশে যেতে পারলে ভোজনবিলাসী যাঁরা, তাঁরা সবকিছু এক পাতেই নিতে চেষ্টা করেন। এশাকে একবার দাওয়াতে একজন কাবাব কালিয়ার সঙ্গে শুঁটকি ভুনাও তুলে দিতে যাচ্ছিলেন।

এশা আঁতকে উঠে প্লেট সরিয়ে নিলে তিনি বললেন, ‘সবাই নিয়েছে, মনে হচ্ছে শুঁটকি মজা হয়েছে, নিয়ে নিন।’

এশা নম্র কণ্ঠে বলেছিল, ‘মাংসের সঙ্গে নেব না। এগুলোই শেষ করতে পারব কি না, জানি না। যদি পারি পরে এসে নেব।’

তিনি ভিড়ের দিকে ইঙ্গিত করে নিচু স্বরে বললেন, ‘মনে হয় না খাবার টেবিলের কাছে দ্বিতীয়বার আসতে পারবেন!’

তখন এশার একটা বিষয় বোধগম্য হলো, কেন মানুষ দাওয়াতে গেলে প্রথামতো ও রুচিমতো ভাত-মাছ ও শাকসবজি শুঁটকি নেওয়ার পর পোলাও-কোর্মা ও কালিয়া-কাবাব পাতে নিতে পারে না। যাঁরা ভোজনাসক্ত নন, তাঁরা চোখের লোভে সব ধরনের খাবার এক পাতে নেন না। ভোজনরসিকেরা খাদ্যানন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় সবই একসঙ্গে নিয়ে উপভোগ করেন। এশা মনে মনে ভাবে, যারা পছন্দমতো দু-এক পদ দিয়ে খেয়েছে, তারা তৃপ্ত বেশি, নাকি যারা বিরিয়ানি থেকে ভর্তা সবই গোগ্রাসে উদরস্থ করেছে, তারা বেশি তৃপ্ত? সুখ, তৃপ্তি, খাদ্যানন্দ সবই আইনস্টাইনের থিওরি মোতাবেকই আপেক্ষিক।

এশা বাংলাদেশের এমন এক অঞ্চল থেকে এসেছে, যেখানে মাছের প্রাচুর্য রয়েছে। তাই শুঁটকির কোনো প্রয়োজনই হয় না। মাছ শুকিয়ে শুঁটকি বানিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ ওদের এলাকায় তেমন নেই।

বিদেশে এসে অবাক হয়ে দেখল, অনেক জাতির মানুষই শুঁটকি খায় এবং তাদের শুঁটকিরও গন্ধ রয়েছে। এক বন্ধুর কাছে একদিন বলেছিল, ‘জানো, আমার ধারণাই ছিল না যে বিদেশিরাও শুঁটকি খায় এবং তাদের শুঁটকিতেও গন্ধ আছে!’

বন্ধু বলেছিল, ‘আরে শুঁটকিতে গন্ধ থাকবেই স্বদেশি বিদেশি বলে কোনো কথা নেই। শুঁটকির উপকারিতা আছে জানো তো?’

: এমন অদ্ভুত গন্ধওয়ালা বস্তু উপকারী! তা কী উপকার হয় শুনি?

: আমাদের দেশে মানুষ প্রচুর শুঁটকি খায় জানো তো। রোদে শুকানো জিনিসের খাদ্যগুণ বেড়ে যায় তা শুনেছ নিশ্চয়? এই কারণে আমাদের লোকজনের হাড় মজবুত, গ্রামেও হাত-পা ভাঙা বয়স্ক মানুষ কম দেখা যায়।

এশা কথাটা বিশ্বাস করবে কি না, ভাবছিল। সে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা শুঁটকির উপকারিতা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে কি?’

: আরে নিজের চোখে দেখে বলছি, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? গ্রামে দেখবে দুষ্টুমি-বাঁদরামি করে ছোট বাচ্চাদের হাত-পা প্রায়ই ভাঙে আর বুড়োবুড়িদের হাড় ভাঙাভাঙি কমই হয় শুঁটকি খাওয়ার কারণে। এ দেশে দেখ হসপিটালে অনেক বয়স্ক এই হিপ সার্জারি করে ঘরে ফিরে যাচ্ছে, আবার নি ইনজুরি নিয়ে ফিরে আসছে।

এশা ভাবল হয়তো কথাটা সত্যি তবে শুঁটকিকে সালাম।

এশা ঈদে রান্না করবে। ইন্টারনেট ঘেঁটে যত রেসিপি এশা পেল, কোনোটাই পছন্দ হলো না তার। একজনকে ফোন করে ছানার মিষ্টির রেসিপি চাইল। কারণ ওনার নিজের হাতে বানানো মিষ্টি খেয়ে খুব ভালো লেগেছিল।

ভদ্রমহিলা অদ্ভুত। রেসিপি তো তিনি দিলেনই না, তবে উপদেশ দিলেন অনেক। বললেন, ‘দেখো, চারদিকে প্রায় শোনা যায় রক্তে মিষ্টি বেড়ে গেছে আর মিষ্টি খাইয়ে মানুষকে মারার ফন্দি করো না। টক-ঝাল-নোনতা এতেই হবে।’

: টক-ঝাল না হয় বুঝলাম কিন্তু নোনতা নিয়েই যত চিন্তা।

: কেন ডালপুরি-শিঙাড়া এসব করো।

: আচ্ছা দেখি।

ভেজিটেবল লাজানিয়ার ডিশভেজিটেবল লাজানিয়ার ডিশএশা বাজারের কেনা জিনিস খাওয়াবে না ঠিক করল। যদিও সে রান্নার ‘র-ও জানে না। অনেক চিন্তাভাবনা করল। সব চিন্তা শেষে নিজের রেসিপিমতো শুধু সবজি দিয়ে ভেজিটেবল লাজানিয়া ওভেনে বেক করল। ছানার পুর দিয়ে পুলি পিঠা বানিয়ে তা তেলে না ভেজে ভাপে করল।

এশার ভেজিটেবল লাজানিয়া স্যান্ডউইচ ব্রেডের সঙ্গে খেয়ে সবাই খুব তৃপ্ত হলো। অনেকেই বলল, ওর লাজানিয়া খুব সুস্বাদু একটি ভেজিটেবল ডিশ। যিনি মিষ্টির রেসিপি দিতে চাননি, তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে এশার কাছে ভেজিটেবল লাজানিয়ার রেসিপি চাইলেন।

এশা আন্তরিকভাবে বলল, আমি রেসিপি লিখে রাখিনি যে; যদি চান তবে তা মুখে বলব আপনাকে একদিন।

এশার আনন্দ হলো ভেবে যে, ঈদের রান্না তার ভালোই হয়েছে। তাইতো লোকজন খেয়ে রেসিপি পর্যন্ত চাইছে।

দুই দিন পর আবার ছানার মিষ্টি তৈরি করনেওয়ালির ফোন। ভেজিটেবল লাজানিয়ার রেসিপি নিতে চান।

এশা বলল, বলছি শুনুন।

: সবুর করো, কাগজ-কলম হাতে নেই, আমার কিছু মনে থাকে না। লিখে রাখতে হবে।

: লিখুন তবে, দুটো মাঝারি আকৃতির তাজা বেগুন লাগবে, তার সঙ্গে আলু দু-তিনটা, আট ১০টা বাটন মাশরুম, কয়েকটা কাঁচা মরিচ সামান্য পেঁয়াজ পাতা যাকে এখানে বলে স্প্রিং অনিয়ন, আরও লাগবে সামান্য মোজারেলা চিজ।

: আচ্ছা পড়ছি শোনো।

এশা অবাক হয়ে বলে উঠল, এটাতো টেলিফোন নম্বর না!

: রাখ তো মেয়ে, মুরুব্বিদের সঙ্গে এত কঠিন হবে না; লেখার অভ্যাস নাই তো, ভুলভাল লিখলাম কিনা তাই দেখ একবার।

পড়ে শোনানোর পর নিজেই বললেন, ধুয়ে নিয়ে আলু-বেগুন আধ সেন্টিমিটার মাপে গোল গোল চাকতি করে কেটেছ দেখলাম?

: আগে আলু ছিলে অল্প পানিতে লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে নেবেন, যাতে না ভাঙে। তারপর কাটতে হবে, এবার…।

টেলিফোনের অপর প্রান্তে মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন, আস্তে থেমে থেমে বলো, তাড়াতাড়ি লিখতে পারি না, বোঝো না।

এশা ঈষৎ বিরক্ত হলো। উনি তাড়াতাড়ি লিখতে পারেন না, এটা ও জানবে কী করে!

: এবার সামান্য তেলে বেগুনের চাকগুলো এপিঠ-ওপিঠ পাঁচ মিনিট ফ্রাই প্যানে ভেজে নামান, ঢাকনা দিতে পারেন তবে ঢাকনায় জমা পানি যেন ফ্রাই প্যানে না পড়ে।

: এই মেয়ে শোনো, তুমি করেছ ওভেন বেক আর আমাকে বলছ পানিতে আলু সিদ্ধ করতে, তেলে বেগুন ভাঁজতে, কেন?

মহিলার গলাটা অভিমানী শোনাল।

এশা দরদমাখা কণ্ঠে বলল, ‘আহা শুনুন তো আগে। এবার বেকিং ডিশে অলিভ ওয়েল মাখিয়ে এক একটা আইটেম পরত পরত করে সাজান। প্রতি পরতে কাঁচা মরিচ ও স্প্রিং অনিয়নকুচি ছিটিয়ে তার ওপর সামান্য মোজারেলা চিজ ছড়িয়ে দিন। এভাবে আলু-বেগুন-মাশরুমের স্তরে স্তরে চিজ, কুচানো কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ পাতা দিয়ে সাজিয়ে ওভেনে ২৫-৩০ মিনিট বেক করে নিলেই হবে।

: ঠিক লিখেছি কিনা শোনো।

এশা মন দিয়ে শুনে বলল, ‘ঠিকই লিখেছেন। এবার আপনার মিষ্টির রেসিপিটা বলুন দেখি।’

: কিসের রেসিপি?

: সেই আপনার তৈরি ছানার বরফি?

মহিলা হেসে নিলেন একচোট। তারপর বললেন, তোমাকে শেখাচ্ছি তবে তুমি কাউকে বলবে না কেমন। দোকানের ছানার মিষ্টি বেলুন দিয়ে আস্তে চেপে পাতলা করে নিয়ে কেটে-ছেঁটে বরফি আকৃতি করো, তার ওপর কিশমিশ ঘিয়ে ভেজে পছন্দমতো নকশা করে বরফির টুকরায় চাপ দিয়ে গেঁথে দাও। বেশ হয়ে গেল।’

এশা বলল, ‘দারুণ বুদ্ধি!’

: বুঝেছ এসব হচ্ছে বিদেশে অর্জিত বুদ্ধি।

এশার খুব ভালো লাগল মহিলার সরলতায়। ওর ঈদ আনন্দ দ্বিগুণ হলো একজন মানুষের সৎ ও সরল স্বীকারোক্তি শুনে।

ঘটনা এখানেই শেষ হলো না। মহিলা আরও একদিন এশাকে ফোন করে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘জানো সেই তোমার শেখানো ভেজিটেবল লাজানিয়ার ডিশ আমার স্বদেশি-বিদেশি সব মেহমান খুব পছন্দ করেছে। তবে আমার মনে হলো মোজারেলা চিজ একটু বেশি রিচ হয়ে গেছে; অন্য চিজ দিয়ে করলে কেমন হয় বলো তো?’

: লো ফ্যাট ফেটা চিজ পাতলা করে কেটে সবজির পরতে পরতে দিয়ে ওপরে সামান্য মোজারেলা চিজ ছড়িয়ে দিয়ে করা যায়।

: ভালো বুদ্ধি দিয়েছ তো! এই খাবারটা ঠান্ডা খাওয়া যায়, তাই অফিস-স্কুলে স্যান্ডউইচে দিয়ে নেওয়ার জন্য খুব সুবিধা।

: আপনি তৈরি করে আমাকে ছবি তুলে পাঠাতে ভুলবেন না।

: আমিতো এবার বানাব দুজনের আন্দাজে।

: ভালোই তো এবার আন্দাজ শেখা হবে আমার।

কথাটা বলে এশা খুব হাসল। কারণ আসলেই ও আন্দাজ কথাটার মাথামুণ্ডু বোঝে না। বললে হয়, দুজনের জন্য বানাতে একটা আলু, আধখানা বেগুন, দু-তিনটা মাশরুম ইত্যাদি ইত্যাদি। সন্ধ্যার পর পর টেলিফোনে ছবি হাজির।

এশা ছবিগুলো দেখে মহিলার বুদ্ধির তারিফ না করে পারল না। এই বেচারির শেখার ক্ষমতা দারুণ। তার বিদেশে অর্জিত বুদ্ধিও চমৎকার।


Place your ads here!

Related Articles

নেপিয়ারের মাঠে হঠাৎ বৃষ্টি

ফজলুল বারী, নেপিয়ার থেকে নেপিয়ারে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ মঙ্গলবার। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রধান টি-টোয়েন্টি তারকা সাকিব আল হাসানের

My Take On The Multicultural Festival 2015

On the 14th of February, like most people in Canberra, my family and I attended the 2015 Multicultural Festival. At

স্টেইটস্‌ অভ আর্টঃ এল ক্যামিনো রিয়েল, ক্যালিফোর্নিয়া (প্রথমার্ধ)

ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে ড্রাইভ করতে গেলে এ-দিক সে-দিক হয়ে বারেবারে ঘুরে ফিরে আসে একটা রাস্তা। নামটাও খানিকটা অন্যরকম। এল ক্যামিনো

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment