করোনাকালীন দুর্গা পূজা
করোনাকালে মানব জীবনে এনেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। আমরা ছোটবেলায় ব্যাকরণ বইয়ে অনুবাদ পড়তাম। বাংলা থেকে ইংরেজি বা ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করার একটা বিষয় ছিলো মানব সমাজের সামাজিকতা নিয়ে। প্রথম লাইনটাই শুরু হতো এভাবেঃ ‘মানুষ সামাজিক জীব’। এরপরের লাইনগুলোর মর্মার্থ ছিলো তাই মানুষ একাকী বসবাস করতে পারে না বরং সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ একে অপরের মৌলিক প্রয়োজন মিটিয়ে সমাজে ভারসাম্য বজায় রাখে। মানুষের সামাজিকতার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। আর সেগুলো উপলক্ষে মানুষ একজায়গায় জমায়েত হয়। এতেকরে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া হয় এবং সামাজিক বন্ধনটা আরও সুদৃঢ় হয় কিন্তু করোনা এসে আমাদের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে দূরত্ব বজায় রেখে চললেই বরং মঙ্গল। আমরা এখন আর অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে চাই না আর অবশ্যম্ভাবী হিসেবে জনসমাগম এড়িয়ে চলি। অবশ্য সরকারিভাবে সকল ধরণের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাই সেই সুযোগও নেই খুব একটা। অনেকেই ঘরোয়াভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও সেখানে জনসমাগম সীমিত রাখা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সেই সংখ্যাটা এখন বিশজন।
সব ধরণের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হলেও মানুষ নিয়মের মধ্যে থেকে সীমিত আকারে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করে যাচ্ছেন। বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে দুর্গা পূজা। অস্ট্রেলিয়াতে পুরোপুরি ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যে স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে প্রতিবছর দুর্গা পূজা পালন করা হয়। আমাদের বাসা মিন্টোর সবচেয়ে কাছাকাছি আগমনী অস্ট্রেলিয়া এবং শঙ্খনাদ নামে দুটি সংগঠন প্রতিবছর দুর্গা পূজাসহ কালী পূজা এবং সরস্বতী পূজার আয়োজন করে আসছে। আমরা সপরিবারে দুটো পূজাতেই যায় প্রতিবছর। এটা আমাকে আমাদের কুষ্টিয়ার বিভিন্ন পূজামণ্ডপে প্রতিমা দেখে বেড়ানোর স্মৃতি মনেকরিয়ে দেয়। কলেজের পর সেটা একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলো। পূজোর কটাদিন প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিয়ম করে আমরা বন্ধুরা মিলে ঘন্টা হিসেবে দুটো ভ্যান ভাড়া করে কুষ্টিয়ার সব পূজা মণ্ডপ ঘুরেঘুরে প্রতিমা দেখে বেড়াতাম। আর দিনশেষে কোন হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে থেকে লুচি আর লাবড়া দিয়ে ভুরিভোজ করে ঢেকুর তুলতে তুলতে বাসায় ফিরতাম। আমাদের বন্ধু সুদীপ্তর বাসা ছিলো পূজার সময় আমাদের আড্ডাস্থল। কাকিমার হাতের লুচি লাবড়া না খেলে মনেহতো এইবারের পূজাটা ঠিক জমলো না। কাকিমা গত হয়েছেন বেশ কবছর কিন্তু এখনও আমার স্মৃতিতে কাকিমা উজ্জ্বল। ছোটখাটো একজন মানুষ যখন কথা বলেন কন্ঠস্বরের মধ্যে কিশোরীর মতো এক ধরণের রিনরিনে আওয়াজ হয় আর যার সমস্ত চেতনা জুড়ে আছে ঢাকায় অবস্থান করা একমাত্র ছেলের ভালোর চিন্তা। আমরা আসলেই অনেক সৌভাগ্যবান যে যুগেযুগে সৃষ্টিকর্তা আমাদের মায়ের রূপে এই পৃথিবীতে আবির্ভুত হয়ে আমাদের দেখাশোনা করেন।
সার্বজনীন শারদীয় দুর্গা পূজার আরো একটা অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ ছিলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত মাসিক ম্যাগাজিন আনন্দমেলার ‘পূজাবার্ষিকী সংখ্যা’। আমরা সারাবছর অপেক্ষা করে থাকতাম কবে আনন্দমেলার পূজাবার্ষিকী সংখ্যা হাতে পাবো। আনন্দমেলার অন্য সংখ্যাগুলো আমরা তেমন একটা মাথা ঘামাতাম না কিন্তু পূজাবার্ষিকী সংখ্যা চাই ই চাই। কুষ্টিয়া শহরের সবচেয়ে বড় এবং পুরোনো বইয়ের দোকান ‘বইমেলা’ ছিলো আনন্দমেলা পাওয়ার স্থান। পূজার অনেকদিন আগে থেকেই আমরা বইমেলাতে যেয়ে খোঁজ নিতে শুরু করতাম। এরপর যখন হাতে পেতাম তখন প্রথম বসাতেই অরণ্যদেব আর প্রফেসর শঙ্কুর কমিকস শেষ করতাম। তারপর একেএকে কাকাবাবু, কিংকর কিশোর রায়ের সিরিজগুলোর বাইরেও থাকতো অনেক সুন্দর সুন্দর কিশোর বয়স উপযোগী উপন্যাস। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা আনন্দমেলাটা পড়তাম। একবার শেষ করে আবার রিভিশন দিতাম একের পর এক। এভাবেই চলতো পরবর্তি পূজাবার্ষিকী সংখ্যা হাতে পাবার আগে পর্যন্ত।
আমাদের বয়স বেড়েছে। আমরা একসময় কুষ্টিয়া ছেড়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি কিন্তু দুর্গা পূজার ছুটিতে বাড়ি যাওয়া এবং আনন্দমেলার পূজাবার্ষিকী সংখ্যাটা পড়ার নেশা একটুও কমেনি। পরবর্তিতে সংসার জীবনেও সেটা অক্ষুন্ন থেকেছে। পূজার সময় উত্তরার আজমপুরের ফুটপাতের খোকন ভাইয়ের দোকান থেকে আনন্দমেলা কিনে নিয়ে এসে পড়তাম। অস্ট্রেলিয়া আসার পর প্রথম কয়েকবছর খুঁজেছিলাম কিভাবে আনন্দমেলা কেনা যায়? পরবর্তিতে ইঙ্গেলবার্নের দাওয়াত রেস্তোরাতে ‘আনন্দধারা’র কিছু ম্যাগাজিন দেখে যোগাযোগ করলাম স্বত্বাধিকারী শ্রীমন্ত দাদার সাথে। উনি বললেন উনারা নিয়মিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন সহ বইয়ের অর্ডার নেন। আমি পূজা সামনে আসার সাথে সাথে আনন্দমেলা ‘পূজাবার্ষিকী’ সংখ্যা অর্ডার দিয়ে দিলাম। উনার বাসা স্ট্রাটফিল্ডে। আমাদের বাসা থেকে বেশ দূরে তাই উনি ফারহান ভাইয়ের মারফত সেটা আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ফারহান ভাই দাওয়াত রেস্তোরাতে কাজ করেন কিন্তু নিয়মিত শ্রীমন্ত দাদার ওখানে যান। গত বছরের মতো এ বছরও ফারহান ভাই আমার জন্য আনন্দমেলা বয়ে নিয়ে এসেছেন।
করোনার প্রাদুর্ভাবে সকল প্রকার উৎসব যেখানে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সেখানে দুর্গা পূজার উৎসবও বন্ধ হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া করোনার প্রথম ধাক্কাটা ঠিকমতো সামাল দিতে পারলেও দ্বিতীয় ধাক্কাটাতে একেবারেই বেসামাল হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় ধাক্কায় প্রথমবারের তুলনায় অনেক বেশি সংক্রমণ হয়েছে বিশেষকরে ভিকটোরিয়া অঙ্গরাজ্যে একসময় প্রতিদিনের সংক্রমণ সংখ্যা সাতশ ছাড়িয়ে যায়। অবশ্য এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। ভিকটোরিয়াতে দ্বিতীয় ধাক্কায় সবচেয়ে কড়াকড়িভাবে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। অন্যান্য রাজ্যগুলোও তাদের বর্ডার বন্ধ করে দেয়। প্রথম ধাক্কার পর এই দ্বিতীয় ধাক্কার কারণে সব ধরণের জনমাগমকে শুধু নিরুৎসাহিতই করা হয়নি বরং নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাই অবধারিতভাবেই উৎসবগুলো পালন বন্ধ হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় শঙ্খনাদ পরিবারের কতিপয় সদস্য বাসার মধ্যে সীমিত পরিসরে দেবী দুর্গার আগমনকাল মহালয়া পালন করেছেন। সৌমিক ঘোষ এবং শ্রেয়সী দাশ দম্পতি, অভিজিৎ দাস এবং মৈথিলী হোর দম্পতি, অনুপম দেব এবং মৌমিতা শর্মী দম্পতি, রিপন ভট্টাচার্য দম্পতি, সুমন বর্ধন দম্পতি, প্রিয়াংকা চক্রবর্তী দম্পতি সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় দেবী দুর্গাকে স্বাগত জানানো হয়েছে।
শুরুতেই মহালয়ার চন্ডীপাঠের সাথে নৃত্য পরিবেশন করেন শ্রেয়সী দাশ। এরপর মৈথিলী হোর, প্রিয়াংকা চক্রবর্তী এবং মৌমিতা শর্মীর দলীয় সংগীত তারপর রিপন ভট্টাচার্যের মন্ত্রপাঠ এবং সুমন বর্ধনের একক আরাধনা সংগীত। আর পুরো সময়টা সঞ্চালনা করেন অভিজিৎ দাস। অনুষ্ঠানের অংশগুলো খন্ড খন্ড আকারে বিভিন্ন স্থানে ধারণ করে পরবর্তিতে জোড়া দিয়ে একটা সুন্দর অনুষ্ঠানের আকার দেয়া হয়েছে। দেবী দুর্গাকে সরাসরি আরতি দিতে না পারলেও ভক্তি শ্রদ্ধার কোন কমতি ছিলো না এই খন্ড খন্ড আয়োজনে। তবে জিনিসটা ছিলো না সেটা হলো ঢাকের আর কাঁসার অবিশ্রান্ত বাদ্য পাশাপাশি আরতির উলুধ্বনি। ছোটবেলায় যেকোন পূজামণ্ডপের কাছাকাছি গেলেই আমরা নাকে ধূপের গন্ধ পেতাম সেটাও এবার অনুপস্থিত। আর সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা এইবার আমরা মিস করছি সেটা হলো পূজোর প্রসাদ। আর একটা বিষয়ের কথা না বললেই নয় সেটা হলো পূজা উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা। আর গত বছর শঙ্খনাদ বাংলাদেশের বারোয়ারী পূজার আদলে আয়োজন করেছিলো বিভিন্ন নাটিকার। পূজার প্ৰত্যেকটা দিনই তাঁদের কোন না কোন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ছিলো। অবশ্য এ বছরও অনালাইনে অর্ডার করে আমরা আনন্দমেলার পূজাবার্ষিকী সংখ্যা হাতে পেয়েছি। এইবারের পূজার সান্তনা বলতে এটুকুই। আনন্দমেলা হাতে পেয়েই সেদিন রাত্রে বসে কাকাবাবুর কমিকস শেষ করে ফেলেছি। ধীরেধীরে বাকি লেখাগুলোও পড়া হবে।
দেবী দুর্গা যেমন দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অসুরকে দমন করে এই পৃথিবীতে শান্তি এবং সাম্য ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন আশাকরি করোনাকালের দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর সময় শেষে পৃথিবীতে আবারও বইবে শান্তি এবং সুখের সুবাতাস। তখন আবার আমরা সামাজিকভাবে দলবেঁধে আমাদের সার্বজনীন উৎসবগুলো পালন করতে পারবো। এবারের সীমিত আয়োজনে সবাই এই আশাবাদই ব্যক্ত করেছেন। সবার মনের মনিকোঠায় আবারও সেই একই স্বর বেজে উঠেছে সেই আদি কথাটা ‘আসছে বছর আবার হবে’।
Md Yaqub Ali
আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।
Related Articles
সিডনির নীপবন পল্লীতে আমাদের প্রাণের বিজয়মেলা
‘শতফুল প্রস্ফুটিত হোক’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে প্রথমে জাতীয় সঙ্গীত এবং “এসো পুষ্পিত পল্লবে এসো শাপলা শালুক ঝিলে”এই থিম সঙ্গীত
তারেক মাসুদ, মিশুক মুনির
ফজলুল বারী: অমর চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, সাংবাদিক মিশুক মুনির সহ পাঁচজন একই সড়ক দূর্ঘটনায় প্রান হারিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতিদিন সড়ক দূর্ঘটনায় কুড়ি
স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন: স্বপ্ন যেখানে বাস্তব
স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন কিছু তরুণের একটি অভাবনীয় স্বপ্নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব দিক দিয়েই বাংলাদেশের আর দশটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান