অঙ্গ দান করুন জীবন বাঁচান
জন্ম নেবার পর জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে একদিন না একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে তবে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তায় সবাই চাই। স্বাভাবিক জীবন আর স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তার জন্যই মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দেয় উন্নত জীবনমানের আশায়। তারপরও মানুষের জীবনে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারে না। মৃত্যু যেকোন সময় যেকোনো আকারে এসে হাজির হতে পারে তাই প্রতিনিয়ত জীবনে বেঁচে থাকার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। চিকিৎসাবিদ্যা এখন মানুষের আয়ু অনেকগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ঔষুধের পাশাপাশি এখন শেষ চিকিৎসা হিসেবে এসেছে অঙ্গ প্রতিস্থাপন। এতোদিন শুধু অঙ্গ প্রতিস্থাপনের গল্প লোকমুখে এবং পত্রিকার পাতাতেই দেখেছি। এই প্রথমবার সামনাসামনি কাউকে দেখার অভিজ্ঞতা হলো যার শরীরে একটা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
আপনি চাইলেই মরনোত্তর আপনার অঙ্গ বা কোষ দান করতে পারেন। অবশ্য আপনি চাইলে অন্যান্য যেকোন সময়েও কোষ দান করতে পারেন। জযেমন আপনার পরিচিত কেউ বোন ম্যারো ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে আপনার শরীর থেকে তাঁর শরীরে বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন করতে পারেন তবে তার আগে আপনাকে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। ডিএনএ ম্যাচিং সহ আরো মোট আটটা বিষয় ম্যাচিং করা হয় রোগীর সাথে ডোনারের। অন্ততঃপক্ষে ছয়টা মিলে গেলেই বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করা হয়। আর এগুলো দানের মাধ্যমে আপনার তেমন কোন শারীরিক ক্ষতি হবার সুযোগ নেই তাই সারা বিশ্বব্যাপী অঙ্গ এবং কোষ দানের ব্যাপারটাকে এখন উৎসাহিত করা হচ্ছে।
আমাদের প্রতিবেশী নাজমুল ভাইয়ের হৃদযন্ত্রে বেশ কয়েকবার সমস্যা দেখা দেয়ার পর ডাক্তারেরা সিদ্ধান্ত নেন হৃদযন্তের প্রতিস্থাপনের কিন্তু হৃদযন্ত্র পাওয়াটা পুরোপুরি ভাগ্যের ব্যাপার তাই শুরুতে উনার হৃৎপিণ্ডে একটা অপারেশনের মাধ্যমে একটা ডিভাইস বসিয়ে দেয়া হলো যেটা হৃপিন্ডকে সাহায্য করবে কিন্তু এরপরও হৃৎপিণ্ডের কর্মকান্ডে তেমন কোন উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো না তখন আবার আরো একটা অপারেশনের মাধ্যমে আরো একটা ডিভাইস বসানো হলো। সেই ডিভাইসটা ছিলো একটু বিদঘুঁটে রকমের। আসল ডিভাইসটা শরীরের ভিতরে বসানো কিন্তু সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় শরীরের বাইরে থেকে। ভিতরের যন্ত্রটা থেকে একটা ছোট ব্যাসার্ধের পাইপের মধ্যে একটা তার এসে বাইরের ছোট ল্যাপটপের মতো যন্ত্রের সাথে সংযুক্ত। ল্যাপটপের মতো যন্ত্রটাকে আবার সময়ে সময়ে চার্জ দিয়ে সচল রাখতে হয়। এইভাবে বেশ কিছু দিন চলে গেলো আর আমরা মনেমনে দোয়া করছিলাম যেন কেউ একজন তাঁর হৃৎপিন্ডটা মরণোত্তর দান করে যান।
নাজমুল ভাই উনার শরীরের সাথে ল্যাপটপের মতো ডিভাইসটা বহন করার জন্য একটা ব্যাগ ব্যবহার করতেন। উনি সেই ব্যাগ শরীরে পেচিয়েই বাগান করা থেকে শুরু করে গাড়ি পর্যন্ত চালাতেন। আমি উনাকে দেখতাম আর অবাক হতাম। মানুষের মনের জোর ঠিক কতখানি হতে পারে। শুধুমাত্র মনের জোরে উনি সবকিছু করে বেড়াতেন। আমার ছেলে রায়ান উনাকে ভীষণ রকমের পছন্দ করে। উনার কাছাকাছি আসলেই বিভিন্ন ধরণের শারীরিক কসরৎ করতে থাকে। আমি খুব সাবধানে ওকে দূরে রাখার চেষ্টা করি কিন্তু সেও নাছোড়বান্দা ঠিকই ঘুরেফিরে উনার কাছে চলে যান। আমরা ভয়ে আঁতকে উঠলেও উনার মুখে সবসময় দেখছি স্মিত হাসি। উনার সেই একই কথা বাচ্চারা এমন দুষ্টুমি না করলে কি ভালো লাগে বলো।
অবশেষে একদিন সকাল ছয়টার সময় হাসপাতাল থেকে জানানো হলো উনার জন্য একটা হৃৎপিন্ড পাওয়া গেছে। উনারা যেন দ্রুতই হাসপাতালে চলে যান। সকাল নয়টার মধ্যে উনারা হাসপাতালে চলে গেলেন। সেখানে উনাকে গোসল করিয়ে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হলো। প্রাথমিক সব পরীক্ষা নিরীক্ষার পর দুপুর দেড়টার দিকে শুরু হলো একটা জটিল এবং দীর্ঘ অপারেশন প্রক্রিয়া। আমরা সবাই বিকেলে হাসপাতালে গেলাম। উনি তখনও অপারেশন থিয়েটারে। ডাক্তার বলেছেনঃ রাত দশটার উপর বেজে যাবে শেষ হতে। অবশেষে সফলভাবে উনার অপারেশন শেষ হয়। এরপর উনাকে আইসিইউ তে স্থানান্তর করা হয়। উনি খুব দ্রুতই রিকভার করতে শুরু করেন। এবং সপ্তাহখানেকের মাথায় উনাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। ডাক্তারদের যুক্তি হলো উনি বাসাতে থাকলে ভালো থাকবেন কিন্তু উনাকে রাখতে হবে হাসপাতালের পরিবেশে। যাতে উনি বেশি নড়াচড়া বা বেশি মানুষের সাথে কথা না বলেন। এখন পর্যন্ত উনি ভালো আছেন এবং আমরা দোয়া করি উনি আমাদের মাঝে আরো দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকবেন।
আমার ছাত্র রানা Acute Lymphoblastic Leukaemia রোগে আক্রান্ত যার সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায় ব্লাড ক্যান্সার। রানার দরকার ছিলো বোনম্যারো প্রতিস্থাপন। কেমথেরাপির পাশাপাশি চললো বোনম্যারো অনুসন্ধান। সিঙ্গাপুরের একটা হাসপাতালে চললো সেই খরচান্ত চিকিৎসা। কাকতালীয়ভাবে ওর ছোটবোন নীলোপলার সাথে ওর বোনম্যারো ম্যাচিং হয়ে গেলো। রানার চিকিৎসার শুরু থেকেই নীলোপলা তার ভাইয়ের জন্য কিছু করতে পারছে না বলে মনোকষ্টে ছিলো। অবশেষে তার সেই কষ্ট লাঘবের সময় আসলো। নীলোপলার শরীর থেকে রানার শরীরে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হলো সফলভাবে। এরপর তাকে একটা বছর পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এই এক বছরের মধ্যে তেমন কোন জটিলতা দেখা যায়নি। এক বছরের পর যখন ও বাড়ি ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই ডাক্তারেরা আবার একটা ফাইনাল টেস্ট করালেন। আর তখনই প্রথম ধরা পড়লো সমস্যাটা। রানার শরীর বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে আনা স্টেম সেলগুলোকে রিজেক্ট করতে শুরু করেছে। যার অর্থ রানাকে আবার পুরো চিকিৎসা প্রক্রিয়াটা নতুন করে শুরু করতে হবে। আবারো কেমোথেরাপি চলবে আর তার পাশাপাশি চলবে ডোনার অনুসন্ধান।
উপরের গল্প দুটো বলার মূল কারণ হচ্ছে কিভাবে অঙ্গ বা কোষের প্রতিস্থাপন আমাদের আপনজনদের বাঁচিয়ে আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে। নাজমুল ভাই ইতোমধ্যেই অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য নিবন্ধন করেছেন। উনি মারা যাবার পর উনার সবগুলো কার্যকর অঙ্গকে অন্যের জন্য উনি দান করে দিয়েছেন। আমার এক বন্ধুও ভাবিসহ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য নিবন্ধন করেছেন। আমি নিজেও সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছি কারণ আমার সামনে সবচেয়ে বড় উদাহরণ নাজমুল ভাই এবং রানার দীর্ঘ চিকিৎসা প্রক্রিয়া এবং অন্য একজনের অঙ্গ নিয়ে উনারা আমাদের মাঝে আরো অনেকদিন বেঁচে থাকবেন। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ব্যাপারে পরিবারের সব সদস্যদের মতামত নেয়ার কথা বলা হয়েছে। ভাবি শুরুতে রাজি ছিলেন না পরে ভাইয়া উনাকে রাজি করিয়েছেন। আমার গিন্নীও শুরুতে নিমরাজি ছিলো পরে রাজি হয়েছেন। এইভাবে আমরা যদি সবাই একটু সাহসী হয়ে উদ্যোগ নিই তাহলে কিন্তু অনেক সহজেই অনেক তাজা প্রাণ অকালে ঝরে পরা থেকে রক্ষা পায়।
অস্ট্রেলিয়াতে অঙ্গ এবং কোষ দানের রেকর্ড এখন পর্যন্ত মোটামুটি সন্তোষজনক। ডোনেটলাইফ অস্ট্রেলিয়ার তথ্যমতে প্রায় ১৪০০ অস্ট্রেলিয়ান বর্তমানে অপেক্ষমাণ তালিকায় রয়েছেন যাদের কোন না কোন অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে হবে। ২০১৮ সালে ৫৫৪ জন মৃত এবং ২৩৮ জন জীবিত মানুষ তাদের বিভিন্ন অঙ্গ ও কোষ দানের মাধ্যমে ১,৭৮২ জন অস্ট্রেলিয়ানের জীবন বাঁচিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে বেশিরভাগই (৬৯%) ডোনার হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। প্রতি তিনজন অস্ট্রেলিয়ানের মধ্যে একজন ডোনার হিসেবে নিবন্ধন করেছেন এবং প্রতি দশটা পরিবারের মধ্যে নয়টা পরিবার ডোনার হওয়ার সম্মতি প্রদান করেছেন। আপনি শরীরের চোখ, হৃৎপিন্ড, ফুসফুস, যকৃৎ, কিডনি, অগ্ন্যাশয় সবই ডোনেট করতে পারবেন। এমনকি হৃৎপিণ্ডের ভালভ ও কোষ, রক্তনালী, হাড়, রোগ, লিগামেন্ট, চামড়া, চোখের অংশ পর্যন্ত দান করতে পারেন। তবে নিবন্ধন প্রক্রিয়াটা একটু জটিল এবং দীর্ঘ। আপনি ডোনেট লাইফের ওয়েবসাইটে যেয়ে নিবন্ধন করতে পারেন অথবা মেডিকেয়ারের মাধ্যমেও নিবন্ধন করতে পারেন।
বিজ্ঞানের প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে এখন মানুষের জীবনকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এবং সেটাকে নিরাপদ রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে। আর অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করার নবনব পন্থা আবিষ্কার হচ্ছে প্রতিদিন। তারই সর্বশেষ সংযোজন অঙ্গ ও কোষ প্রতিস্থাপন। ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার কাটিয়ে আমার আপনার একটি অঙ্গ বা কোষ দান অন্য একটা মানুষ তথা পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে পারে যদিও নিজের পরিবারকে সেটা মানানো সহজ নয়। তাই আপনি কিভাবে নিজের পরিবারের সাথে অঙ্গ বা কোষ দানের ব্যাপারে আলাপ শুরু করতে পারেন সেই ব্যাপারেও ডোনার সংগঠনগুলো সাহায্য করে থাকে। তাই আর দেরি কেন আজই আপনার পরিবারের সাথে কথা বলে নিবন্ধন করে ফেলুন। আর অস্ট্রেলিয়াতে কে অঙ্গ বা কোষ দান করছে এটা গুরুত্ব দিয়ে গোপন রাখা হয়।
Md Yaqub Ali
আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।
Related Articles
Deshattobodh
দেশাত্ববোধঃ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোন পথে আলমামুন আশরাফী রাজনীতিবিদদের গালমন্দ করা সমাজের এখন একটা অংশ হয়ে গেছে যারা যুগের পর যুগ
জিম্মি বাংলাদেশ সরকার! জিম্মি শেখ হাসিনা!
ফজলুল বারী: বাংলাদেশে মানুষ নানাভাবে সরকার ও রাষ্ট্রের হাতে জিম্মি হয়। কিন্তু সরকারও যে দেশটায় জিম্মি হয় তা নিয়ে এ
‘লাইব্রেরী এসোছিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে ঢাকা’য় সেমিনার আয়োজন
লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘লাইব্রেরী এসোছিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনিসটিটিউট, ঢাকা’য় সেমিনার আয়োজনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত