ভার্চুয়াল চিঠি (পর্ব – পাঁচ)

ভার্চুয়াল চিঠি (পর্ব – পাঁচ)

?ইনবক্স চিঠি , সেতো আজ যান্ত্রিক ভালবাসা । বড্ড বেশী মায়া কান্না ! কেউ আর সেই আবেগ ঢেলে এখন আর সাদা কাগজ, কোশিটানা হালকা নীল-গোলাপী রঙের কাগজ নয় , খাতা জুড়ে বুক জুড়ে এখন আর হার্টের ছবি, রাজনীগন্ধার স্টিক, গোলাপ ফুল কিংবা এক জোড়া পাখির জলছাপ থাকে না। 
পাতার বুকের ডান পাশে কেউ আর তারিখ বা সময় বসিয়ে দেয় না। তোমার পাতা সুগন্ধী করতে পারফিউম স্পে করে না । 
দু’একটা শব্দ ভুল বা উপমা মনের মতো না হলে, এখন কেউ আর তোমাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে কাঁদে না ,কিংবা ঘরের মেঝে ছুঁড়ে ফেলে দেয় না! 
চিঠি তোমাকে এখন আর লুকিয়ে রাখার দরকার হয় না। 
বড় বেশী উন্মুক্ত। তুমি অন্য হাতে গিয়ে মহাভারতকে আর উল্টে দাও না! প্রেরককে তাই কথার নোংরা জালে ধরা পড়তে হয় না। 
এখন আর অজানা ভয়-উৎকণ্ঠা -সংকোচ নিয়ে কিংবা হলুদ বা নীল বা গোলাপী বা যে কোন রঙের খামে , তুমি প্রাপকের কাছে যাও না। ডাক অফিসের আলসেমি আর হরতাল-অবরোধ তোমাকে বেঁধে রাখতে পারে না। 
ভুল গন্তব্যে গিয়ে অন্যের দরজায় কড়া নাড়া গেছো ভুলে! বরং সবাই আজ তোমাকে পড়ে। প্রাপক বহুসংখ্যক! প্রেরকও জানতে পারে ঠিঁক ঠিকানায় তুমি গিয়ে হাজির। 
কলম পাল্টে কি-বোর্ড দিয়ে এখন তোমাকে লেখা হয়! ব্যাক স্পেস কি’টি ক্ষয় হতে হতে ভেঙ্গে যায় নি। তবে মাঝে মাঝে কাজ করে না! ডিলেট কি’টি আছে তাই রক্ষে। তোমাকে এখন সংরক্ষণে রাখা যায়। 
পচনের হাত থেকে বাঁচার জন্য নয়! লেখার জন্য। এই কিছু মনে পড়লো, লিখব। ভুল হলে ছিঁড়বো না, রাগ করবো না! মনের মতো লাইন হলেই লিখব! এখন সেভ, পরে আবার কিছু লিখব। কবিতা বা উক্তি দরকার, গুগল বন্ধু সাথেই আছে।
প্রাপক তোমাকে পেয়ে এখন আর সেই ভালবাসার মিষ্টি ঘ্রাণ বা স্পর্শ খুঁজে পায় না! আবেগে আল্পুত হয় না। 
পরে সময় করে আবার পড়ার জন্য জমিয়ে রাখে না। রাতের ঘুম নষ্ট করে না। 
তোমাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদে না! তুমি এখন শুধু যান্ত্রিক। সহজলভ্য! অনুভূতি শূন্য! দৈনন্দিন নাগরিক ব্যস্ততায়, আমার সাদা স্ক্রিনে ভেসে ওঠা তুমি এক ভার্চুয়াল প্রতিচ্ছবি ।
আমার এক কলেজ বন্ধু একদিন আমাকে কয়েকটা লেখা পড়তে দিয়ে বল্লো দেখ … কথা গুলো এখন কতটা বাস্তবিক তাই না বান্ধবী ? 
আমিও বল্লাম হুম , রেখে দিলাম যত্ন করে গুগল ড্রাইভে , আজ কাজে লাগলো । আমি ওকে বলেছিলাম শোন সবকিছুতেই সময়ের সাথে সাথে মানুষ মানিয়ে নেয় , অভ্যস্ত হয়ে পরে , তখন ওভাবেই আবেগ ঢালে , এখনকার দিনে চিঠি নেই তো কিহয়েছে ! 
আবেগ তো আর মরে যায় নি , আবেগ তো আবেগের মতোই ঝড় তুলে এগিয়ে যায় মন থেকে মনে , হোক না সে মোবাইল মেসেজ কিংবা ফেবু ইনবক্স , টুইট কিংবা হুয়াটসে … বেদম চুটিয়ে প্রেম করছে সকলে , বরং প্রেম আরো দেদার করবার সুযোগ করে দিয়েছে , প্রেম তো প্রেম ই । 
বন্ধুরা আজ আমার ইনবক্স চিঠির প্রস্তাব পর্বের – ৫ নং সংখ্যা । 

প্রেমিকের চিঠি ….নং-৫

? আচ্ছা বলবে তোমার দেয়া এক একটা স্টাটাসের শব্দ কেন আমাকে দোলায় , তোমার নিজের লেখা কিংবা অন্যের লেখা কবিতা গান যখন তুমি ছবিতে কিংবা এমনি পোষ্ট করো , আমি পাগলের মতো পড়ি আর ভাবি , 
তোমাকে যেটুকু পাই তোমার কবিতায় পাই, তোমার ছবিতে পাই। 
তোমার ছবি আর কবিতার প্রেমে কাটাই নন্দিত সময়।তুমি আমার ছবির দেশ, তুমি আমার কবিতার দেশ। কতো না কবি, লেখক ও দার্শনিক যুগে যুগে তাদের জন্মের শহর ছেড়ে গিয়েছিল প্রজ্ঞাপারমিতা প্যারী, রোম, মিলান, তুরিণের শিল্পভূমিতে। 
দূরের ভূগোল ভালোবাসে হয়েছিল দূরবাসী। আমার প্রিয় দার্শনিক নিৎসে তার জন্মের জর্মন নাগরিকতা ছুঁড়ে ফেলে দেশহীন হয়েছিল। 

ছুটে গিয়েছিল আলপসের পাহাড়ে, ইটালির শিল্পভূমির টানে। হোটেলে হোটেলে কাটিয়েছিল জীবনের অনেকটা সময়। নিৎসের মতো আমিও সব ছেড়ে যেতে চাই তোমার উষ্ণতার কাছে। শিল্প জমিনের মতো তোমার বুকের জ্যোৎস্না বরিষনে।

তোমার ছবি আমার দেশহীন দেশ। তুমি মোহন মৃত্তিকা আমার। পৃথিবীর রক্তপথে কোথাও যাওয়ার অভয়ারণ্য নেই তোমার বুকের জমিন ছাড়া। তোমার ছবির কাছে আমি যাই ছুটে। তুমি আমার অভয়ারণ্য। 

তোমার ছবির জন্য অপেক্ষায় থাকি কখন তোমার ছবি ফুলের মতো ফুটবে। তুমি নতুন নতুন সাজে তোমাকে রিক্রিয়েট করে চলেছ, যা দেখে, যা অবলোকন করে আমার ভালোবাসার সিম্যান্টিক্স বিহ্বল হয়ে ওঠে। 

বলো, কোন্ পঙক্তি সাজিয়ে তোমারে বর্ণনা করি! কোনো শব্দমালা নেই আমার যা দিয়ে লিখতে পারি তোমার সুন্দরম। 
অট কট্যিওর (Haute couture) পরলে তোমাকে যেমন মানায়, মসলিন বা তাঁতের শাড়িতেও তুমি তৈরি করো বাঙালি নারী অঙ্গের তরঙ্গ।তোমাকে ওরিয়ন্টাল সাজে যেমন মানায়, অক্সিডেন্টাল সাজেও তুমি সাবলীল। 

তুমি যেমন ট্রান্স-আটলান্টিক সাজের মেয়ে তেমনি মেঠোপথে, হলুদ সর্ষের ক্ষেতে পালতোলা নাওয়ের মতো। তোমাকে যে সাজে, যে অঙ্গে দেখার সাধ হয়, তুমি ঢেকিতে পার দিচ্ছো খালি পায়ে এক চিলতে খোলা শ্যামল কোমর খুলে। আকাশে বিদ্যুৎ রেখার মতো আলোর তীর ছুটছে তোমার অঙ্গের বাঁকে বাঁকে। তুমি দুলে দুলে উঠছো যেন এক নদীবাঁক। 
তোমাকে দেখছি স্নান শেষে ভেজা শাড়িতে জল ভরা কলশি কাঁঙ্খে ফিরছো ঘরে। তুমি যেনো ফিদার ক্যানভাসে হেঁটে চলেছ গজগামিনীর প্রমিত নিতম্বীনি। 
মাতিসের ক্যানভাসে ন্যুডিটির আর্টস অ্যান্ড অ্যাসথেটিকস ঝরে পড়ছে তোমার আঁচল ভেজা জলের বিন্দু। জলের বুদ্বুদে তুমি বহতা নদী।

দেখি তোমার ছবি, গ্রীবার চাঁদে ছড়ানো চুলের ঢেউ, আঁচল উড়িয়ে বাতাসে তরঙ্গ তোলা ছবি। যে নন্দন ছবি তুমি তোমার কবিতার পাশে জাক্সটাপোজ করেছ সেখানে তোমাকে শাশ্বতী লাগছে। তোমার কবিতা আর তোমাকে পড়ি ঋষির মতো মগ্নমন। 
তোমার রূপচারুতা আয়াতের মতো আবৃত্তি করি।তুমি সুদর্শনা উড়িতেছ বিকেলের বাতাসে, বসন্ত বাতাসে। এই বন্দনা, এই প্রেমার্তি শুনে তুমি কি স্পন্দিত হও না দূরতমাসু? 
এসো এই আয়াতে আয়াতে প্রতুল জড়িয়ে একীভূত হই, বিলীন হই, দ্রবীভূত হই। তোমার ছবির অনঙ্গ জাগুক অজন্তা ইলোরা ও খাজুরাহোর অঙ্গের মতো শিল্পীত। 

সম্পন্ন অভিসারে পড়ে থাকা আমার কবন্ধ দেহে জাগুক স্পর্শের বাহুযুগ, জাগুক অবলোকনের চোখ আর চুম্বনের ঠোঁট। হোক সম্পন্ন অভিসার। 
বিলম্বে কি যে ভুল জানো নাই সখি! বিলম্বের খেলায় বেহুলা কি জানিত চুম্বনের আগে যাবে ভেসে প্রভূ লক্ষ্মীন্দর! 
এসো বুকলগ্ন হই। মরমে কই, “আর কিছু নেই, আর কিছু নেই, বাহুতে বাজুতে তোমার দেহকাব্য জড়িয়ে রয়েছো মুক্তছন্দ পাথরের খাজুরাহো।”
প্যারীতে হেমিংওয়ে ম্যুজে দু লুক্সেমবার্গ মিউজিয়মে সময় করে দেখতে যেতো পল সেজানের ছবি। আমি দেখতে আসি ফেসবুকের গ্যালারিতে তোমার ছবি — আর্টস অন ফটোগ্রাফস! 
সেখানে তোমার ছবির আলো দেখি।আমার চোখ তোমার ছবির কালেক্টর, কিউরেটর। ঝাঁকঝাঁক ছবির ভিড় থেকে তুলে আনি স্পন্দনজাগানিয়া কিছু ছবি, তোমার ছবি। আমি সাজিয়েছি আমার গ্যালারি চন্দ্রালোক প্রিয়দর্শীর ছবিতে ছবিতে। তুমিই আমার ম্যুজে দু লুক্সেমবার্গ, তুমিই আমার পল সেজানের ক্যানভাস। 
আমি তোমার হেমিংওয়ে।তোমাকে রোজ রিলিজিয়াসলি দেখি। হেমিংওয়ে সময় পেলেই হেঁটে হেঁটে সেই মিউজিয়মে যেতো, আমি রোজ যাই অন্তর্গত আমারই বুকের ভিতরে যেখানে সেলফে সাজিয়েছি তোমার উচ্ছল তরঙ্গ তোলা সব ছবি। 
কি যে দিদৃক্ষা জাগে! তোমার ছবিগুলো ক্লোজ আপ দেখি, কোনাকুনি দেখি, মিডলং থেকে দেখি, ডিসট্যান্স থেকে দেখি। তোমার স্থির ছবির ভিতর যে মেয়েটি ভরতনাট্যম নাচে, মনিপুরী, কুচিপুরী নাচে, তার তাতা থৈথৈ মুদ্রা দেখি। 
তার গান শুনি। স্থির ছবির ভিতর তোমার চোখের কটাক্ষ যে ভাষায় কথা কয়, তাকে আমি অনুবাদ করতে করতে শেষে দ্বিধান্বিত হই, অক্ষম অনুবাদকের মতো হতাশায় নিপতিত হই। 
তোমার চোখের কটাক্ষের ভাষা অনুবাদ করা যায় না। জীবনানন্দ দাশ চোখের ওই ভাষাকেই বলেছেন, কবিতা। তুমি সেই কবিতা আমার! সেই কবিতাকে নিয়ে আমি কাটাই আমার হাইবারনেটেড সময়— আধো ঘুম, আধো জাগরণে। 
কবে পাবো তারে, তাহারে পাবো স্পর্শে, স্পর্শের সান্নিধ্যে। হয়তো পাবো না। প্লাটোনিক প্রেম কি তবে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ জায়নামাজ? 
একটা চুমুর ডানা উড়ে উড়ে তোমার চোখের পাতায়, ঠোঁটের ঢেউয়ে, গ্রীবার ঢালে,পদ্মফুল নাভিমূলে, কোমরের নদীবাঁকে, চুলের তমাল মেঘে শিশিরের শব্দের মতো নামে চুপিসারে। 
অমনি গোলাম আলী গেয়ে ওঠে, 
যাব তাসাবুর মেরা চুপকে সে তুঝে ছুঁ আয়ে আপনি হার শ্বাস সে মুঝকো তেরি খুশবু আয়ে…❤️
…….

প্রতীকী ছবি
Najmin Mortuza

Najmin Mortuza

দার্শনিক বোধ তাড়িত সময় সচেতন নিষ্ঠাবান কবি। চলমান বাস্তবতাকে ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরম্পরায় জারিত করে তিনি কাব্য রূপান্তরে অভ্যস্ত। কাব্য রচনার পাশাপাশি ক্ষেত্রসমীক্ষাধর্মী মৌলিক গবেষণা ও কথাসাহিত্য সাধনায় তাঁর নিবেদন উল্লেখ করার মতো। গবেষণাকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্যঃ জারিগানের আসরে "বিষাদ-সিন্ধু" আত্তীকরণ ও পরিবেশন পদ্ধতি শীর্ষক গ্রন্থের জন্য সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১২ অর্জন করেছেন।


Place your ads here!

Related Articles

Aren’t Rohingyas Bengalis, and Arakan integral to Bangladesh?

Every society has certain taboos – cultural/religious, social, and political – set apart and designated as restricted or forbidden to

সুধাংশু তুই পালা

একটা ছোট পরিসংখ্যান দেই। বাংলাদেশে ১৯৪১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল শতকরা ২৮ ভাগ। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের অব্যবহিত পরে তা

Book launch: Vulnerability and Adaptation to Climate Change in Bangladesh by Bangladesh Scientist Dr Younus

Bangladeshi-Australian Research Fellow of Adelaide University, Dr Younus’ book entitled ‘Vulnerability and Adaptation to Climate Change in Bangladesh’ has recently

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment