একুশে’র চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন” বাস্তবায়নের রূপরেখা-৩ (প্রায়োগিক কৌশল)
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদ কর্তৃক মহান একুশে ফেব্রুয়ারি’কে বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এবং সকল সদস্যরাষ্ট্র তথা ভাষাভাষী কর্তৃক বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর দিবসটি যথাযথ গুরুত্বের সাথে উদযাপনের প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণার উপর ভিত্তি করে বিশ্বের সকল ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষা রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সকল ভাষাভাষীর মধ্যে একুশের চেতনার উন্মেষ সঞ্চারণে উদ্ভুদ্ধকরন প্রক্রিয়া হিসেবে একুশের চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা’র দার্শনিক রূপরেখা প্রণীত হয়েছে। এমএলসি মুভমেন্টের প্রণীত এই রূপরেখায় মাতৃভাষা বাংলা’ রক্ষার মহান একুশের চেতনা’র মত পৃথিবীর যেকোন ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষা রক্ষায় একুশের চেতনাকেই চেতনা উন্মেষের অনুঘটক হিসেবে সকল ভাষাভাষীর জন্য সমন্বিত সাধারণ কৌশল হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। যাতে বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিটি ভাষা অবক্ষয়রোধে সকল ভাষাভাষীরা নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রতি সাধারন আবেগজড়িত সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়; মাতৃভাষার চর্চা, সুরক্ষা এবং সংরক্ষনে প্রত্যেক ভাষাভাষীর মধ্যেই গণসচেতনতাসহ যেকোন মাতৃভাষার প্রতিই স্বাভাবিক সমান মর্যাদাপূর্ণ মূল্যবোধ সঞ্চারিত হয়। বিশ্বের সকল রাষ্ট্র, জাতি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাক্তি সকলে একযোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশীদার হিসেবে এই দিবসকে সামনে রেখে সারাবছর জুড়ে সময়-সুযোগ মত নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা এবং রক্ষায় শরীক হওয়াকে পবিত্র দায়িত্ব বলে অনুভব করে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার প্রক্রিয়ায় প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক বায়ান্নের মহান একুশ, একুশের চেতনা এবং এই চেতনাকে কেন্দ্রকরে পরবর্তী প্রায় দুইযুগ ধরে(১৯৫২-১৯৭১)জাতীয় সংস্কৃতি, ঐক্য এবং ঐতিহ্যকে সুসংগত করার লক্ষ্যে সকল সংঘাতপূর্ণ তথা দৃষ্টান্তমূলক পরিস্থিতির মোকাবেলায় ঘটিত সাংগঠনিক এবং ঐক্যপ্রক্রিয়ার যথাযথ মূল্যায়নপূর্বক মাতৃভাষা ভিত্তিক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার ব্যতিক্রমী গৌরবময় অর্জনের বিষয়টিকে পৃথিবীর সকল ভাষাভাষীর কাছে দৃষ্টান্তমূলক এবং অনুকরণীয় বলে বিবেচিত হয়েছে। ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদ কর্তৃক সর্বসম্মত মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ ঝুঁকির মুখোমুখী যেকোন মাতৃভাষা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ‘একুশের চেতনা’ সর্বোৎকৃষ্ট অনুঘটক হিসেবে সকল ভাষাভাষীর মধ্যে সবচাইতে উৎসাহব্যঞ্জক ও কার্যকরী ভূমিকা রেখে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। এই ধারণার ভিত্তিতে দুই শতাধিক ভাষার সহস্রাধিক ভাষাভাষীর সাথে একান্ত আলোচনা এবং মতামত গ্রহণ, এবং তার উপর বিশ্লেষণ ভিত্তিক গবেষণায় একুশের চেতনা’র বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের দার্শনিক কৌশল প্রণীত হয়। এমএলসি মুভমেন্টের প্রণীত এই দার্শনিক কৌশলে ইউনেস্কো কর্তৃক মহান একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গ্রহণকে পৃথিবীর সকল ভাষা সুরক্ষায় সকল ভাষাভাষীর কাছে বাস্তবানুগভাবে উৎসাহব্যঞ্জক, প্রায়োগিক, কার্যকরী এবং গতিশীল করার সমন্বিত উপায় হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে।
মাতৃভাষা অবক্ষয়ের ধারা একটি বৈশ্বিক ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক চিহ্নিত। যার দীর্ঘসুরী ফলশ্রুতি মানব সভ্যতা, শিক্ষা ও সমাজ বিবর্তনের বিষয়ে সম্যক ধারনা এবং গবেষণার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বিশেষ সমস্যা সৃষ্টি করার বিষয়ে কোন মতান্তর নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই অনিবার্য সমস্যার প্রতিরোধক হিসেবে একুশের চেতনা’র বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের দার্শনিক কৌশলে বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা অবক্ষয়ে ভয়াবহতার ঝুঁকি এড়াতে বা ভয়াবহতার ধারাকে সহনশীল পর্যায়ে ধরে রাখার ক্ষেত্রে সকল ভাষাভাষীদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি হিসেবে সারা বছরব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টিকেন্দ্রিক কার্যক্রমের প্রক্রিয়া অবলম্বনের দিকনির্দেশনা চিত্রিত হয়েছে। ইউনেস্কোর পৌরহিত্যে সারাবিশ্বে পরিচালিত এই দার্শনিক কৌশলে একুশের সূতিকাগার বাংলাদেশ সরকারকে ইউনেস্কোর সহযোগী/সহায়ক রাষ্ট্র হিসেবে এবং একুশের চেতনা’র উত্তরাধিকারি বাংগালিদেরকে প্রণীত কৌশল সঞ্চালনার ভূমিকায় দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে মহান একুশের অধিষ্ঠান, বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিটিউটের প্রতিষ্ঠা, এবং তার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিটিউটকে ইউনেস্কোর দ্বিতীয় ক্যাটাগরির মানে উন্নীতকরণের ধারাবাহিকতায় একুশের চেতনা’র বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের দার্শনিক কৌশলের বাস্তবায়নের রূপরেখা চিত্রিত।
বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের সোপানে সারা বছর জুড়ে বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাভাষা আন্দোলনের ধারায় পৃথিবীর সকল ভাষাভাষীকে নিজ মাতৃভাষা অবক্ষয়রোধে মাতৃভাষা রক্ষার শপথে(একুশের চেতনায়) উজ্জীবিত করে স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাচ্ছন্দ এবং স্বাভাবিক সাবলীলতায় নিজের অনুভুতিকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নিজ নিজ মাতৃভাষা ব্যবহারে উদ্ভুদ্ধ করার সাধারণ সামাজিক কৌশল হিসেবে একুশের চেতনা’র বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতার দার্শনিক রূপরেখা সংকলিত। বিশ্বের সকল ভাষা, তথা সকল ভাষাভাষীর জন্য প্রণীত এই দর্শনের উপযোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রায়োগিক বাস্তবতা প্রদর্শনে নির্ণীত হয়েছে এমএলসি মুভমেন্টের সাংগঠনিক ভিত্তিঃ ১। প্রধান প্রধান শহরে মনুমেন্টাল প্রচারণা; ২। লাইব্রেরিতে ‘একুশে কর্নার’ প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি; এবং ৩। সকল সদস্য রাষ্ট্রকর্তৃক সাধারণ রাষ্ট্রীয় নীতিমালা গঠন ভিত্তিক সাধারণ গণসংযোগ তথা গণসম্পৃক্ততা কেন্দ্রিক বৈশ্বিক সাংগঠনিক কার্যক্রম। এই বিশ্বব্যাপ্ত কৌশলী পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই সিডনীর এসফিল্ড হেরিটেজ পার্কে পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ প্রতিষ্ঠা; বাংলাদেশ এবং অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনের অধীনে ‘একুশে কর্নার’ এর বাস্তবায়ন, এবং অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল ও বিভিন্ন স্টেট পার্লামেন্টে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নে সর্বসম্মত মোশন পাশের উপর্যুপরি সফল দৃষ্টান্ত বিশ্বব্যাপী একুশের চেতনা’র বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতার দার্শনিক কৌশল বাস্তবায়নের যথার্থতা এবং উপযোগ্যতা প্রমান করে। উপরোল্লিখিত অর্জিত সফলতাসমূহ ইউনেস্কোর দৃষ্টি আকর্ষণসহ প্রশংসা অর্জন, ইউনেস্কোর উদ্যোগে স্কাইপ মিটিং এর মাধ্যমে পারস্পরিক আলোচনা অনুষ্ঠান, এবং স্কাইপ মিটিং এর আলোচনার প্রেক্ষিতে এমএলসি মুভমেন্টের কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিটিউটের(ইউনেস্কোর দ্বিতীয় ক্যাটাগরি প্রতিষ্ঠান)কার্যক্রমের সাথে একযোগে কাজ করার সুপারিশ প্রণীত এই কৌশলের বৈশ্বিক উপযোগ্যতা এবং বাস্তবায়নের সমূহ সম্ভাবনার প্রাতিষ্ঠানিক ইংগিত। কৌশলসমূহ ইউনেস্কোর পৃষ্টপোষকতা এবং বাংলাদেশ সরকারের পৌরহিত্যে বিশ্বব্যাপী সকল প্রাবাসি/অভিবাসি বাঙালিদের সম্মিলিত এবং সমন্বিত সহযোগিতায় সকল ইউএন সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের গৃহীত নীতিমালা অনুসরণে সকল ভাষাভাষীদের সমন্বয়ে কিভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব তার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ছকের মাধ্যমে চিত্রিত হয়েছে। এককথায়, প্রণীত এই কৌশলের চিত্রিত ছকে আন্তর্জাতিকভাবে মাতৃভাষাসমূহের ভয়াবহ অবক্ষয়ের গতি নিয়ন্ত্রণের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের গৃহীত সিদ্ধান্ত সকল ভাষাভাষীর ক্ষেত্রে কার্যকরীভাবে বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাপী ইউনেস্কোর পৃষ্টপোষকতার পাশাপাশি একুশের চেতনা’র সঠিক বার্তা সম্প্রচার নিশ্চিত করার কৌশল হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক সহযোগিতা এবং বাংগালিদের অনিবার্য অংশগ্রহণ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে ববেচিত হয়েছে। (চলবে)
পরবর্তী লেখাঃ
একুশের চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন
বাস্তবায়নের রূপরেখা-৪
(প্রায়োগিক ছক)
Nirmal Paul
নির্মল পাল; ইমেইলঃ nirmalpaul@optusnet.com.au; প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপারশনঃ এমএলসি মুভমেন্ট ইনটারন্যাশন্যাল ইনক; প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকারী দলনেতাঃ পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”; প্রকাশিত গ্রন্থঃ “বিশ্বায়নে শহীদ মিনার”; বৈশ্বিক দর্শনঃ “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”, (স্থানীয় বর্ণমালা সংরক্ষণ কেন্দ্র)
Related Articles
On democratic autocracy
The concepts of democracy and autocracy are apparently contradictory. Democracy is a system of government where people elect their representatives
Parliamentary Constituencies for Non-resident Bangladeshis
Remittance is the largest source of foreign income that contributes more than 10 percent of the GDP in Bangladesh today.
বীরপ্রতীক ডাব্লু এস ওডারল্যান্ডের জন্মদিন আজ
ইতিহাস আর ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে কত কথা কত ঝগড়া আমাদের। সব কিন্তু দলগত। আসলে যে ইতিহাস আমাদের জানা উচিত আমাদের