না ঘুমানোর দল

না ঘুমানোর দল

বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাথে চানখার পুল আর স্টার হোটেলের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাতজেগে পড়াশুনার পর সস্তায় পেট পুজোর জন্য এই দুইটা জায়গার কোন বিকল্প ছিল না ভাবী আমলা, প্রকৌশলী এবং ডাক্তারদের কাছে। চানখার পুল ছিল অনেকটা বাসার রান্নাঘরের মত। যেকোনো সময় যেয়ে যেমন তেমন একটা কিছু খেয়ে পেট ঠান্ডা রাখা তবে চানখার পুলেও নিরব হোটেল এবং সোহাগের মত কিছু এক্সক্লুসিভ রেস্তোরা ছিল। আর স্টারে আমরা যেতাম বিশেষ কোনদিন পালন করার জন্য যেমন টিউশনির প্রথম বেতন বা কারো জন্মদিন ইত্যাদি। তাই অত্র এলাকায় পড়াশুনা করেছে আর চানখার পুল এবং স্টারে একদিনের জন্যও খেতে যায় নাই এমন ছাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না।

নিউ ষ্টার কাবাবে বন্ধুদের আড্ডা

বুয়েটের আমাদের ব্যাচের বেশির ভাগ বন্ধুই এখন আমরা অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাস করছি। তাই সপ্তাহান্তে আমরা নিজেরা একবারের জন্য হলেও এক জায়গায় হওয়ার চেষ্টা করি। বাস্তবতার কষাঘাতে প্রায়শই সেটা সফল হয় না কিন্তু তবুও আমরা চেষ্টা করে যায় মাসে বা তিন মাসে তা নাহলে অন্ততপক্ষে ছয় মাসে একবারের জন্য হলেও একটা পুনর্মিলনী করার। আর তার জন্য শুক্রবার রাতই আমাদেরই প্রথম পছন্দ। শুক্রবার সবাই কাজ শেষ করে একটু কম ব্যস্ত থাকে অন্য দিনের তুলনায় তাই এই দিনটিকে আমরা বেছে নেই। রাত দশটার পর থেকে আগের থেকে নির্দিষ্ট করা রেস্তোরার সামনে সিডনির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা ভিড় করতে শুরু করি। মাঝেমধ্যে অবশ্য শেষ মুহুর্তে যেয়ে স্থান বদলে যায়।

আড্ডার অন্যতম অনুষঙ্গ কফি

মজার ব্যাপার হচ্ছে এখন পর্যন্ত আমাদের যতগুলো পুনর্মিলনী হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই হয়েছে অবার্নের নিউ স্টার কাবাব রেস্তোরাতে। এখানে আমি যতবারই যাই আমার ততবারই পুরোনো ঢাকার স্টার হোটেলের কথা মনেপড়ে যাই। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানে আমরা ঢাকার স্টারের মতই নান এবং সাথে কাবাব খাই। তবে ঢাকার স্টারের বোরহানির জায়গায় এখানে একটা বোতলজাত পানীয় পাওয়া যায় তার নাম আয়রান। এখানেও ঢাকার স্টারের মতই শুরুতে সালাদ দিয়ে যায় এবং মুল খাবার আসার আগেই আমরা সালাদ সাবাড় করে দিই। তারপর খাবার আসার সাথেসাথেই যে যার প্রয়োজনমত নিয়ে নেয়। আর সাথে চলে একজন অন্যজনকে পচানো এবং এই পচানোর তীর যেকোনো সময় দিক বদল করে যে কাউকে পচাতে পারে।

কফি শপের বাইরে দাঁড়িয়েও চলে আড্ডা

এভাবে চলতে চলতে একসময় আমাদের খাবার শেষ হয়ে আসে। কিন্তু আমাদের আড্ডা আর শেষ হয় না। তখন আমরা চলে যায় অবার্ন ম্যাকডোনাল্ডে কফি খাওয়ার জন্য। তারপর সেখানে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আবার আমাদের আড্ডা চলতে থাকে। এভাবে চলতে চলতে কখন যে মাঝরাত পেরিয়ে ভোররাত চলে আসে আমাদের খেয়ালই থাকে না। যখন খেয়াল হয় যে বাসায় ফিরতে হবে তখন আমরা টেবিল ছেড়ে বাইরে চলে আসি। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের বিদায় নেয়ার পর্বটা হয় সবচেয়ে দীর্ঘ। বাইরে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিয়ে আমরা আবারো ঘন্টা পার করে দিই। তারপরও মন ভরে না যেন। তবুও আমাদেরকে একসময় বাসার রাস্তা ধরতেই হয়।

লাকেম্বার ফুড ফেস্টিভ্যাল

ইতোমধ্যেই আমাদের অর্ধাঙ্গিনীরা মিলেও একটা গ্রুপ তৈরি করে ফেলেছে। তারাও আমাদের মত করে বেশ কয়েকবার আড্ডা দেয়া এবং মুভি দেখে ফেলেছে। তবে তাদের আয়োজনমালার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে লাকেম্বাতে ফুড ফেস্টিভ্যালে যোগদান। ভাবিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে ঐকমত্য হয়ে আমাদের জানিয়েছে যে ফুড ফেস্টিভ্যালে যাবে। তারপর আমরা বাচ্চাকাচ্চাসহ সবাই মিলে সেটা রুপ নিয়েছিল একটা পারিবারিক পুনর্মিলনীতে ।

উটের বার্গারের অপেক্ষায়

লাকেম্বাকে বলা হয় সিডনির বাংলাদেশ পল্লী। এখানে আসলেই আপনি ঢাকার চানখার পুলের সেই পরিবেশের কিছুটা হলেও ছোয়া পাবেন। এখানে বাংলাদেশি মুদির দোকান থেকে শুরু করে চটপটির দোকান এবং বাংলাদেশি রেস্তোরাও রয়েছে। আর রমজান মাস আসলেই এখানে শুরু হয় মাসব্যাপী খাবাবের মেলা। একেবারে সন্ধ্যা থেকে শুরু করে সেহরি পর্যন্ত চলে খাবারের বিকিকিনি। এখানে যেসব খাবার পাওয়া যায় সেগুলো বিভিন্ন রেস্তোরাতে অন্য সময়ও পাওয়া যায় কিন্তু সেইভাবে লক্ষ্য করে খাওয়া হয় না। রমজান মাস আসলেই সবাই বন্ধুবান্ধব পরিবার পরিজন নিয়ে এসে সেই খাবারের স্বাদ নিতে কেউ ভুল করে না। একটা নির্দিষ্ট দিনে আবার হেল্ডন স্ট্রিটের একাংশ বন্ধ করে দিয়ে আলাদাভাবে ফুড ফেস্টিভ্যাল পালন করা হয়।

সাহলাব একটা অদ্ভুত পানীয়

ভাবিরা এইবার আমাদের পারিবারিক পুনর্মিলনীর জন্য সেই দিনটি বেছে নিয়েছিলেন। তারপর একেএকে আমরা সবাই একত্রিত হয়ে ফুড ফেস্টিভ্যালে ঢুকে পড়লাম। প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে বাচ্চাকাচ্চারাও এসেছিল এইবার। তাদের আনন্দ দেখে মনেহচ্ছিল এখন যেন মাঝরাত না সবে সন্ধ্যে হয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে খেলাধুলো শুরু করে দিল। আসলেই বাচ্চাদের আলাদাভাবে কোন খেলনার দরকার হয় না। তারা পরিবেশ অনুযায়ী একএকটা খেলা আবিষ্কার করে ফেলে। আমরা বড়রা লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম উটের বার্গারের জন্য। উটের বার্গারের সামনে বিশাল লাইন দেখে শুরুতে ঘাবড়ে গেলেও লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম আমরা। তারপর আধাঘণ্টার উপরে লাইনে দাঁড়িয়ে বার্গার নিয়ে বিজয়ীর ভংগিতে ফিরে আসলাম। বার্গারটা সবাই খুব পছন্দ করল বিশেষকরে বাচ্চারা বেশ খানিকটা করে খেয়ে ফেললো।

ফুড ফেস্টিভ্যালের ক্ষুদে ড্রামার

বার্গারের দোকানের পাশেই বাংলাদেশের ঘোলের মত করে কিছু একটা বানাচ্ছে দেখে আমার খুব খেতে লোভ হল। আমি উদ্যোগী হয়ে দোকানিকে যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম খাবারটার নাম কি? দোকানি কন্ঠে মধু ঢেলে বলল সাহলাব। উপাদান কি কি জিজ্ঞেস করাতে দোকানি বলল শুধু দুধ আর সাথে সামান্য মসলা। কফি কাপের মত দুরকমের পাত্রে সেই খাবার বেচা হচ্ছে। ছোট কাপ চার ডলার আর বড় কাপ পাচ ডলার। আমি পরীক্ষামূলকভাবে ছোট দুই কাপ নিয়ে নিলাম। তারপর সেটা খেতে যেয়ে বুঝলাম আমার এত আগ্রহ সত্ত্বেও কেন সবাই নিষ্পৃহ ছিল। কারণ ভাবিরা বললেন ভাইয়া খাবারটা দুধের ফেনার মত না। আমি বললাম জি তবে একটু গাঢ় এই যা।

নতুন প্রজন্মের আড্ডা

এরপর কেনা হল কাক নামের বাংলাদেশের ময়দার চাপড়া সদৃশ একটা খাবার। তবে চাপড়ার সাথে এটার তফাৎ হচ্ছে এটাতে মাঝখানে চিজ দেয়া থাকে। এটা অর্ধেক পরিমাণ খেতে পারলেই মোটামুটি আপনার পেট ভরে যাবে। তারপর কেনা হল নিউটেলা। তারপর সবাই মিলে ভাগাভাগি করে সেটাও খাওয়া হল। এই পুরো সময়টাতেই আমরা স্থির হয়ে কোথাও না দাঁড়িয়ে  হাটার উপর ছিলাম। পুরো জায়গাটাকে রঙিন কাপরের টুকরো দিয়ে সাজানো হয়েছে খুবই সুন্দর করে। মাথার উপরে সেই ঝালর মনেকরিয়ে দিচ্ছে আজ একটা বিশেষ দিন। আর নিচে রাস্তায় শতশত মানুষ গিজগিজ করছে। তাই শীতের মধ্যেও বেশ গরম অনুভূত হচ্ছে।

নতুন প্রজন্মের আড্ডা

এর মধ্যেই এক কিশোরকে দেখলাম হাতে একটা ড্রাম নিয়ে তার ইচ্ছেমত বাজিয়ে যাচ্ছে। আমার খুবই ইচ্ছে করছিল ওর কাছে থেকে ড্রামটা নিয়ে কিচ্ছুক্ষণ বাজায় কিন্তু কাধের উপর ছেলে ঘুমিয়ে পড়াতে আর সেটা সম্ভব হল না। তবে সেই কিশোরের ছবি তুলে নিলাম। ছবি তোলার কথা বলতেই সে অনেক খুশি হয়ে পোজ দিয়ে দিল। আমি বললাম বাজনা খুব ভালো হচ্ছে সেটা শুনে আবারো লাজুক হাসি দিল।

ফুড ফেস্টিভ্যাল থেকে বের হয়ে আমরা খুশবু রেস্তোরাতে যেয়ে বসলাম। তারপর সবার জন্য চায়ের অর্ডার দিয়ে দেয়া হল। চা আসার বিরতিতে বাচ্চারা আবারো কাপ, চামচ, টেবিল, চেয়ার নিয়ে খেলায় মেতে উঠলো। চা আসার পর আমরা চা শেষ করতে করতে আবারো আড্ডাতে মেতে উঠলাম। তারপর চা শেষকরে আবার আমরা যে যার বাসার পথে রওয়ানা দিয়ে দিলাম।

Md Yaqub Ali

Md Yaqub Ali

আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।


Place your ads here!

Related Articles

Indian envoy’s avoidable remarks

Most people in Bangladesh are surprised to note that an experienced and well-seasoned diplomat, such as India’s High Commissioner to

Trade Investment Cooperation Framework Agreement (TICFA) with the US Bangladesh

Bangladesh seeks trade and investment from the US and other countries. Most economists say that investment up to 34% of

An excellent Iftar party hosted by Bangladesh-Australia Association, Canberra

On Sunday 6th September 2009, the Bangladesh-Australia Association, Canberra organised its annual Iftar party at the Canberra Islamic Centre (CIC)

3 comments

Write a comment
  1. Istiak
    Istiak 1 June, 2018, 19:20

    লেখককে ধন্যবাদ, লেখাটা পরে ছোট কালের আড্ডার কথা মনে পড়লো.

    Reply this comment
    • Md Yaqub Ali
      Md Yaqub Ali 4 June, 2018, 13:50

      ছোটবেলাকার মধুর স্মৃতিই আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনে চলার চালিকাশক্তি।

      Reply this comment
  2. Selina
    Selina 6 November, 2019, 15:57

    Nice article..Please keep writing.

    Reply this comment

Write a Comment