স্মৃতিতে ছাত্র নেতা খন্দকার ফারুক

স্মৃতিতে ছাত্র নেতা খন্দকার ফারুক

আজকাল প্রায়ই পরিচিত জনের চলে যাবার খবর পাই। বার্ধক্য বা দীর্ঘ রোগ ভোগের পরে মৃত্যু সংবাদ পেলে অতটা বিচলিত বোধ করি না। কিন্তু অপরিণত বয়সে অকস্মাৎ কেউ মারা গেছেন শুনলে মুষড়ে পড়ি। নিজের ডাক আসার আশংকায় আনমনা হই। খন্দকার মোহাম্মদ ফারুকের মৃত্যু সংবাদ আমার কাছে অপ্রত্যাশীত এবং মর্মাহত হবার মত ঘটনা। চলে যাবার পরে সাধারনের কাছে ফারুক কতটা প্রিয়জন ছিল, সেটা অনুভব করতে পারি। সে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র হলেও নিজস্ব পরিমন্ডলের বাইরে এক বিশাল অঙ্গনে ব্যাপক জানাশোনা ছিল। ভিন্ন মতধারার তথা ভিন্ন রাজনৈতিক মতের অনুসারীদের মাঝেও তার সেই জনপ্রিয়তা বিস্তৃত ছিল।

ফারুকের সাথে আমার প্রথম দেখা মধুর কেণ্টিনে। মুক্তিযুদ্ধ উত্তর এক স্বপ্নসম্ভাবনাময় সময়ে। সেই সম্ভাবনাময়ের আলোকরশ্মি পনেরই আগস্ট এক ফুৎকারে মিলিয়ে গেল এবং আমরা এক অদ্ভূত আধাঁরে পতিত হলাম। ফারুক এবং আমাদের প্রজন্ম সেই স্বপ্নসম্ভাবনাময় সময়ের পরে অন্ধকারে ক্রান্তিকাল অতিক্রমের সংগ্রামে ছিলাম এক সাথে। পনেরই আগস্টে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যার পরে নেতৃবৃন্দ আত্মগোপনে। ছাত্র রাজনীতি বা জাতীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে নিরাপদ দূরত্বে আছেন সবাই। দেশ ক্রমশ চলে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রুদের দখলে। এমনি এক দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছিল বেশ কিছু সাহসী তরুণ। তাদের মাঝে ফারুক ছিল প্রথম সারিতে।

১৯৭৩-৭৫ এ আমি ছিলাম ঢাকা নগর ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক। ফলে যে কোন মিছিল-মিটিং-আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠনে কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা ছিল আমার দায়িত্ব। এই সময়ে ফারুক, সিলভিসহ অনেক নতুন মুখ সামনে এগিয়ে আসাতে আমরা বেশ উৎসাহ পাই।

লম্বা-পাতলা গড়নের ছিপছিপে তরুণ, দেখতে শারীরিকভাবে দুর্বল দেখালেও সে ছিল নিরলস পরিশ্রমী এক শানিত কর্মী। সকালবেলা মধুতে ছিল আমাদের নিয়মিত বৈঠক, আবার বিকেলবেলা নেতৃস্থানীয় কর্মীদের নিয়ে পরামর্শ সভা। রাজপথের যে কোন লড়াকু কর্মসূচীতে ফারুক ছিল খুবই উৎসাহী এক কর্মী। সেই সময়ে পরিস্থিতির চাহিদা বুঝে আমারা বেশ কিছু ঝটিকা-জঙ্গী মিছিলের কর্মসূচী পালন করেছি যা নেতৃত্বহীন জনগণের মাঝে নতুন করে আশা জাগিয়েছিল। এই চরম ঝুঁকিপূর্ণ মিছিলগুলোতে প্রথম বর্ষের ছাত্র হয়েও ফারুক ছিল মধ্যমনি। নিজেদের কর্মীদের পাশাপাশি ছাত্রলীগ কর্মীদের সক্রিয় করতে ওর ভূমিকা ছিল। ছাত্রলীগের অনেক নেতৃস্থানীয় সক্রিয় নেতা পনেরই আগস্টের পরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে । তাদের কেউ কেউ আবার দেশ ছাড়লেন, কেউ কেউ যোগ দিলেন প্রতিপক্ষের সাথে।

পরিচয় হবার পরে জানতে পারি আমাদের সূর্য দা’(কর্ণেল), কামাল ভাই হলেন ফারুকের বড়ভাই। সূর্য দা’ছিলেন আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের ভীষণ সাহসী এক সক্রিয় নেতা, লড়াকু কর্মীদের আইডল। ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে মধুতে গেলেই আমরা তাঁকে ঘিরে বসতাম। ওনার সাড়া জাগানো কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম। ৭১ এর পরে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৫ আগস্টের পরের একটা ঘটনা বেশ মনে পড়ে।

তখন ছাত্র-জনতাকে জাগাতে ভ্যানে মাইক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনানো হতো। এটা করতে গিয়ে অনেকে গ্রেপ্তার নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তো একদিন রিক্সায় এরকম ভাষণ বাজানোর সময়ে দেখি একটা সামরিক টহল জীপ এলো, সূর্য দা কমব্যট ইউনিফরম পরে বসে আছেন , তিনি জীপ থেকে নেমে এলেন – সবাই ভীত সস্ত্রস্থ। সবাইকে অবাক করে দিয়ে রিক্সাকে ঐ মোড়ে একঘন্টা অবস্থান করে ভাষণ বাজাতে হুকুম দিলেন এবং নিজে শুনতে চান বলে জানালেন। তখন সামরিক শাসন চলছিল, তা সত্বেও সূর্য দা কৌশলে নিজের রাগ ঝাড়লেন এবং রাজপথে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ শুনিয়ে ছাত্র-জনতাকে উদ্বুদ্ধ করলেন। তাঁর এই সাহসী পদক্ষেপ যেমন অবাক করেছিল তেমনি উৎসাহীত করেছিল। ফারুকের অপর ভাই, অ্যাডভোকেট কামাল ভাই ছিলেন ন্যাপ নেতা। ওনার সাথে স্বাধীনতার আগে ন্যাপের রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছি। ফারুক ছিল এমনই এক রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য।

ফারুকের সাথেও নানা বিষয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করেছি। পরামর্শ করেছি। এইসব আড্ডার স্থান ছিল পাবলিক লাইব্রেরী চত্ত্বর। এটা জানতাম যে তার পরামর্শ আমাদের জন্য মূল্যবান। দীর্ঘ সময় এক সঙ্গে কাজ করেছি। একই কমিটিতে আমরা কাজ করেছি। আমি যখন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তখন সহ সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আমাকে দারুন সহযোগিতা করেছে। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি ফারুক সব সময় তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করতে আগ্রহী ছিল। ফলে খুব সহজেই সে সাধারণ ছাত্রদের নেতা হয়ে উঠেছিল। সকলের অফুরন্ত ভালবাসা পেয়েছিল। ফারুক এর লড়াকুপনার সাথে সাথে আরেকটি বৈশিষ্ট্য আমাকে মুগ্ধ করতো – আর তা ছিল ওর সরল জীবনযাপন। যা তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করতও, যা ছিল অন্যদের চাইতে ভিন্ন। তথাকথিত নেতা হয়ে অসৎ পথে অর্থ উপার্জন না করে, নিতান্ত নিজের চেস্টায় ব্যবসায় যে সাফল্য অর্জন করে গেছে সেটাও আমাদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

অনেক পরে জানতে পারি ফারুক আমার স্ত্রী নীলুর ঘনিষ্ট আত্মীয়। আবার ওর স্ত্রী সাকিও আমাদেরই ঘনিষ্ট রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। যখনই দেশে গিয়েছি চেষ্টা করেছি ফারুক ও তার পরিবারের সাথে দেখা করতে। সাকির পরিবার আমাদের অত্যন্ত আপনজন। ওর বড় বোন দিলরুবা , বোন সেলিনা , অঞ্জন এর সাথে ছাত্র ইউনিয়ন করেছি। বহুবার তাদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশা করেছি। একটি বিপ্লবী পরিবার বললে অত্যুক্তি হবে না। ফারুক একজন তেমনি সাহসী সহকর্মীকে তার বউ বা সঙ্গি হিসেবে পেয়েছিল। ওদের প্রতি ছিল্ আমার বিশেষ টান। ফারুক এর ভায়রা মঞ্জুর মোরশেদ আমার অনেক পুরনো বন্ধু আজ মেলবোর্ন থেকে যখন ফারুকের এই সংবাদটি জানালো তখন আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে ফারুক আমাদের মাঝে নেই। এমনি করে আরো অনেকেই আমাদের মাঝ থেকে চলে যাবে, আমি ও আমরাও চলে যাবো; রয়ে যাবে যাবে স্ম্বতি। আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারবো আমরা আমাদের তরুণ সময় নিয়োজিত করেছি মানব কল্যাণে, মানুষের সুন্দর জীবনের জন্য। ফারুক ছিল সাহসী, সতত সৃজনশীল কর্মঠ, দায়িত্বশীল বাবা ,স্বামী ও কমরেড। ছাত্র আন্দোলন শেষ করে আকরাম ভাই সহ চির বঞ্চিত ক্ষেত মজুরদের নিয়ে গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে বেরিয়েছে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। সেখানেও ছিল্ তার ঐকান্তিক চেষ্টা। শহরের চাকচিক্য ছেড়ে সে সময় এমন উদ্যোগ ছিল তরুনদের জন্য উৎসাহের। এক সসময় সংস্কারের নামে আমাদের রাজনীতিকে বিভক্ত করা হলো, বলা হলো যা করেছি ভুল করেছি। আমাদের আদর্শ – মূল্যবোধ থেকে সড়ে গিয়ে অনেকে নাম লেখালেন ভিন্ন রাজনীতিতে। এ সময় আমাদের অনেকেই হতাশ হয়ে ভিন্ন স্রোতে গা ভাসালাম , কেউবা হারিয়ে গেলাম আবার কেউবা হলাম প্রবাসী। খন্দকার ফারুক এর মত কমরেড বন্ধু রা আমাদের জাগিয়ে রাখবে আমাদের সাহসী হতে , জেগে উঠতে। ফারুক এর পরিবারের প্রতি লাল সালাম আর বিশেষ করে তার বিপ্লবী সঙ্গী আমার প্রিয় বোন বিপ্লবী মানুষের প্রতি সদা শ্রদ্ধাশীল প্রিয় সাকিকে।

প্রাত্তন সাধারন সম্পাদক ছাত্র ইউনিয়ন
kamrulk@gmail.com


Place your ads here!

Related Articles

শহীদ বুদ্ধিজীবিদের স্মরণ

শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তার স্থানীয় দোসর- রাজাকার, আলবদর, আলশামস এর নৃশংসতার বর্ণনা পড়ে এবং শুনে মন যত

প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনের থেমিস ভাস্কর্য

দেশের প্রশাসন ব্যবস্থার প্রতি বর্তমান প্রধান বিচারপতির অসন্তোষ দীর্ঘদিনের । আড়ালে আবডালে নয়, প্রধান বিচারপতি প্রায়ই প্রকাশ্যে বলছেন যে প্রশাসনের

মেলবোর্নের চিঠি – ৬

এয়ারপোর্ট আসলে শুধু একটা স্থান না, যেন অনুভবের সাত রঙের আধার। যেখানে মানুষ খুব কাছ থেকে দেখতে পারে, অনুভব করতে

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment