মেলবোর্নের চিঠি ১৫
[পূর্ব প্রকাশিত মেলবোর্নের চিঠি]
মেলবোর্নের চিঠি ১৫ লেখার শুরুতেই পাঠকদের কাছে আমার ব্যাক্তিগত কিছু দায়ের কথা বলেই নিতে চাইবো ছোট করে। আসলে অনিচ্ছাতেই একটা লম্বা বিরতি নেয়া হয়ে গেছে। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত!
এমন না যে লিখছিনা, লিখছি, প্রতিদিনই কিছু না কিছু। মেলবোর্নের চিঠিতেই শুধু ফিরতে পারছিলামনা…
পারছিলামনা এর দুইটা কারণ শেয়ার করে মনকে দায়মুক্ত করে মূল লেখায় আসছি। একটু মানসিক অস্থিরতায় ভুগছি বিগত প্রায় মাস ৬/৭ ধরে। এছাড়া মূল কারণ, যারা আগের চিঠিগুলো পড়েছেন তাঁরা জানেন মেলবোর্ণের চিঠিতে আমি শুরু করেছি সেই পরবাস জীবনের শুরু থেকে। প্রবাস জীবনের শুরুর গল্প, আমার ১০ বছরের প্রবাস জীবনের ছোট ছোট অভিজ্ঞতা এবং যে পরিবর্তনগুলো আমাকে নানানভাবে ছুঁয়ে গেছে সেই গল্প।
স্বাভাবিকভাবেই লিখতে বসে আমাকে চোখ বুজে চলে যেতে হয় সেই সময়টায়, যেখানে করেছি শেষ। আমি যখন যেটা নিয়ে লিখছি, চেষ্টা করি, সেই সময়টাকেই তুলে আনতে… এই জার্নিটা আমি ভীষণ উপভোগ করেই লিখতে চাই। সেটা দুই দুইয়ে না মেলাতে পারলে ফেরা হয়না, ফেরা যায়না আসলে…
আজকের মত ভুমিকা শেষ… আসি মূল প্রসঙ্গে!!!
বলেছি আগেও আমি অস্ট্রেলিয়াতে পা রেখেছি জুলাই ২০০৯ এ। শুরুতেই ছিলাম সিডনী মাস দেড়েক। প্রবাস জীবণের শুরুর পাঠ ওখান থেকেই নেয়া বলা যায়।
২০০৯ এর আগে যারা বাংলাদেশ ছেড়ে এসেছেন তাঁরা আজ এই লেখা পড়ার আগেই একটু চোখ বুজে আপনার ফেলে আসা বাংলাদেশকে মনে করার চেষ্টা করে দেখুন তো মনে করতে পারেন কিনা কেমন ছিল সেই বাংলাদেশ!!!
আমি মূলত আজ আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আবহের কথা বলছি। বিশেষ করে বাইরে আমাদের মানুষের আচার আচরণ পোশাক আশাক কেমন ছিলো মনে পড়ে কি?
আমি বাংলাদেশ ছেড়ে সদ্য অস্ট্রেলিয়া পা রাখা এক মানুষ তখন। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে তার আগে স্বল্প সময়ের জন্যে ভারত, থাইল্যান্ড আর মালয়েশিয়া ছাড়া আর কোন দেশ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সেখানে এই দেশে চলে এসেছি একবারে, অস্ট্রেলিয়ার মত একটা ট্রুলি মাল্টিকালচারাল সভ্য দেশে… অনেককিছুই আমাকে একের পর এক মুগ্ধ করেছে, ভাবিয়েছে এবং বিস্মিত করেছে!!!
একদম প্রথমদিকে, সিডনীতে আমার চাকুরীর সুবাদে প্রচুর বাংলাদেশী ভাই বোন পরিচিত পেয়েছি। ফেসবুকের জন্যে অনেকের সাথেই যোগাযোগ হয়ে উঠছিলো। স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই তাঁদের বাসায় দাওয়াত দিতে চাইছিলো, সবমিলে সবার কাছে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠছিলনা যদিও দূরত্বের জন্যে।
একদিন পরিচিত এক বড় ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার সুযোগ এলো। রাতের খাবার খাব বলে। সন্ধ্যার দিকেই গেলাম। বাসায় ঢুঁকেই একটু অবাক হলাম। একটু যেন রাখঢাক করে আমাকে একদম ভিতরের রুমে চলে যেতে হল। পুরুষরা সব আলাদা… না এটা অস্বাভাবিক না।
তবে অবাক হলাম কিছু সময় পর, যত মহিলা এলেন, সবাই নিজেদের যতবেশী আবৃত করা যায়, ছোট মেয়েরাসহ। অন্দর মহল মেয়েদের, বাইরের দিকে বসার ঘরেই সব ছেলে পুরুষ। সেই ভাই যখন খাবার নিতে এলেন, খাবারগুলো এমনভাবে গুছিয়ে মাঝামাঝি রাখা হলো, এবং অন্য কোন মহিলা সেখানে এলেননা যখন খাবার নিতে এলেন উনি। মানে বিষয়টা ঘটলো সচেতনভাবে যা আমার চোখ এড়ালোনা।
না কেউ আবার ভেবে বসবেননা এমন একটা বিষয় নিয়ে লিখছি আমার সমস্যা কি। আমি মানুষের ব্যাক্তিগত বিশ্বাস অবিশ্বাসে ভীষণরকম বিশ্বাসী একজন মানুষ, শ্রদ্ধাশীলও।
আমি আসলে বাংলাদেশ থেকে এসে, এমনভাবে মেইনটেইন করা বাংলাদেশী কিছু পরিবারকে মিট করবো এটাই আমার কাছে অবাক বিষয় ছিল। মানে এমনভাবে যে করা যায়, আমি যে লাইফ স্টাইল ছেড়ে এসেছি সদ্য বাংলাদেশ থেকে এবং আসে পাশে দেখে এসেছি এমনটা আমার মাথায় ছিলোনা তখন। আমি ভেবেছি এমন হয়তো শুধু সৌদি বা অন্যকোনা দেশেই সম্ভব বা হয়ে আসছে।
আমি একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে যতোটা ভদ্রস্ত হয়ে থাকা যায়, আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি কারণ একটা কিশোরী মেয়েও আমার দিকে খুব অন্যরকম এক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে অনেক প্রশ্ন… আমি ভিতর থেকে টের পাচ্ছি যেন।
তখনও আমার মাথায় ঘুরছে বেগম রোকেয়া। যা যা পড়েছি তার নানান দৃশ্যপট… হঠাৎ করে এমন একটা সন্ধ্যা আমাকে ভাবালো। আমি অনেককিছুই ভাবছিলাম সেখানে আসা ভদ্রমহিলাদের নিয়ে। এমনভাবে জীবন যাপণ করা কেমন তাঁদের জীবন দর্শন, অন্যদের নিয়েই কী ভাবনা… কিন্তু এই মুহূর্তেই জানার তো নেই উপায়।
তবে, যে বিষয়টা লক্ষণীয়, যে মহিলারা এখানে এমন পারছে তাঁদের প্রায় কারোরই সংসারের অর্থনৈতিক কোনরকম দৃশ্যমান চাপ নেই। তাঁদের স্বামীরা সবাই পেশায় এমন কিছু যাঁদের এই অস্ট্রেলিয়ায় রীতিমত উন্নত আয়ের মানুষদের মাঝে ফেলা যায়। জীবন তাঁদের রেখেছে অনেকটাই নির্ভার এবং তাঁরা পারছে জীবনকে একটা অন্যরকম ছকে ফেলে নিজেদের মত করেই নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে যাপন করতে।
না এই বিষয়টি কেন তুলে আনছি… তা আরো বিস্তারীত বলতেই হবে।
কিছু মিশ্র অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো।
একটা ছোট ঘটনা বলি, একবার এক দাওয়াতে গেছি, মহিলারা সব একটা আলাদা ঘরে বসেছে। নুতন আসা এক আপা, অনেকের মত কিছু মাস না যেতেই আচার আচরণে অতিরিক্ত ধার্মিক হয়ে উঠেছেন। উনি শুরুতেই হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান সবার সাথে সুন্দরভাবে মিশেছেন আমি নিজেই দেখছি। পেয়েছেন কাছে থাকা এমন অনেকের সাহায্য। তাঁর দুই ছেলেমেয়েকেও দিয়েছেন মিশতে। কিন্তু হঠাৎ অজানা কারণে ছেলেমেয়েদের আরো বেশী ধর্মীয় আচার আচরণ শেখাবেন বলেই হয়তো, তাদেরকেও চোখের সামনে বদলে দিলেন।
মেয়েদের বলছেন, এই আন্টিদের সালাম দিয়েছো? ছোট মেয়েরা নিষ্পাপ হাসি দিয়ে ওড়না মুখে চেপে অন্যেদিকে ভোঁ দৌড়, সেই ভদ্রমহিলা, সক্কলের সামনেই বলছেন, দেখেছেন অবস্থা, বিশেষ ধর্মের (যাঁদের বাসায় বসে আছেন) নাম নিয়ে বলছেন, তাদের সাথে মিশে মিশে তার মেয়েরা সালাম দিতে ভুলে গেছে… আমাদের কারো কারো তখন ‘’ধরণী হও দ্বিধা, যাই ঢুকে’’ !!!
এরপরের সময়ে ছোট খাট আরো অনেক খন্ড চিত্র সামনে আসে। যে পরিবর্তনগুলো মানুষ হিসেবে, বাংলাদেশী হিসেবে অনেকবার অনেক জায়গায় নিজের অবস্থান নিয়ে তীব্র সংকটে ফেলেছে আমায়। সেগুলো নিয়ে ফিরবো বেঁচে থাকলে আগামী চিঠিতে।
শুভ কামনা এবং শুকরিয়া যে আপনি পড়লেন সময় নিয়ে আজকের চিঠি!!!
[পূর্ব প্রকাশিত মেলবোর্নের চিঠি]
নাদিরা সুলতানা নদী
কলামিস্ট/সংস্কৃতি কর্মী
উপস্থাপক, রেডিও বাংলা মেলবোর্ন
সহকারী সম্পাদক, প্রশান্তিকা
Related Articles
প্রবাসে শেকড়ের সন্ধান
মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়ার সবচেয়ে বড় সার্থকতা বোধহয় অন্য মানুষদের ভালোবাসা অর্জন। আমরা যেমন আমাদের পরবর্তি প্রজন্মকে ভালোবাসি আবার একইভাবে
বিদ্যুৎ চাই, তবে প্রাণের সুন্দরবনের বিনিময়ে না
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে চলতি বিতর্কে অনেক উপকার দিয়েছে। অনেক কিছু জেনেছি শিখেছি এবং এখনও জানছি-শিখছি। যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে
চন্ডিকা হাথুরু সিংহে
ফজলুল বারী, নেপিয়ার থেকে নিউজিল্যান্ডের শেষ দুই ম্যাচের পারফরমেন্সের কারনে লেগ স্পিনার তানভীর হায়দার যেন এখন জাতীয় ভিলেন! দলের সিনিয়র