“লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার” – একুশের চেতনা’র বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিক দর্শন
“লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার” – একুশের চেতনা’র বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিক দর্শন – (৩য় পর্ব- “একুশে কর্নার পোস্টার”)
নির্মল পাল: আধুনিক বিশ্বায়নের ধারায় নতুন নতুন প্রযুক্তি বা পণ্যের উদ্ভাবন এবং প্রতিযোগী পরিবেশে টিকে থাকার জন্য তার গুনগতমানের উপযোগ্যতা অক্ষুন্ন রাখার পাশাপাশি তা নির্ধারিত গ্রাহকের কাছে সরাসরি পৌঁছিয়ে দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আকর্ষণীয় প্রচার উন্নত প্রযুক্তি ও পণ্যের বাজারজাতকরণ এবং তা সাধারণের নাগালে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে গণসংযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তথ্যনির্ভর কৌশলী প্রচারণা কোন পণ্যকে সহজেই সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ, তথা ব্যবহারে উৎসাহিত করতে সমর্থ হয়। মাতৃভাষা প্রতিটি মানুষ তথা ভাষাভাষীর জন্যই অত্যন্ত আবেগ এবং সংবেদনশীল একটি বিষয় হলেও বিশ্বব্যাপী তার ভয়াবহ অবক্ষয়ের তথ্য প্রয়োজনীয় প্রচারণার অভাবে সাধারণ ভাষাভাষীর কাছে অজ্ঞাত, নিজের অজান্তেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগুষ্ঠির মাতৃভাষাগুলি হারিয়ে যাচ্ছে, অধিক প্রচলিত বা প্রযুক্তি নির্ভর ভাষার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষাভাষী ছাড়া এই তথ্য অন্যদের কাছে তেমন কোন গুরুত্ব বহন করে না, অথবা বিশ্বায়নের ধারার সাথে তাল মিলাতে আধুনিক বিশ্বের মানুষ নিজের অজান্তেই নিজের মাতৃভাষা ব্যবহারের চেয়ে বহুল ব্যবহারিক ভাষা ব্যবহারে বেশী অভ্যস্ত। মাতৃত্ব ও সন্তানের মধ্যস্থিত ভালবাসা-আহ্লাদের মতই মাতৃভাষা প্রকৃতিস্থ স্বাচ্ছন্দতা, মানসিক তৃপ্তিতে অনুভূত এবং সাবলীল প্রকাশের একটি সহজাত স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ধারা হলেও এর গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা স্বাভাবিক চলমান জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রতিফলিত নয়। ফলে মাতৃভাষা সমূহের ভয়াবহ অবক্ষয়ের বিষয়টি সাধারণ ভাষাভাষীর কাছে দ্রুত গোচরীভূত করার পাশাপাশি অবক্ষয়ের কারনে সৃষ্ট সম্ভাব্য সমস্যাগুলি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, তথা তাবৎ বিশ্ব সভ্যতার ক্ষেত্রে কতটুকু ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে, এবং সম্ভাব্য ক্ষতিকারক অবস্থা থেকে উত্তরণে করনীয় কৌশলাদি সম্পর্কে সকল ভাষাভাষীকে সঠিকভাবে জানানো প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রচার মাধ্যম, সকল ধরনের ডিজিটালাইজড প্রযুক্তির ব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে মাতৃভাষা সমূহের এই ভয়াবহ অবস্থার তথ্য ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষাভাষীদের কাছে যত দ্রুত পৌঁছে দেয়া যায় আগামী দিনের শিক্ষা-সভ্যতার সজীবতা সমতা রক্ষার জন্য তাই হবে মঙ্গলকর। যাতে সকল ভাষাভাষীর কাছেই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন এবং সংশ্লিষ্ট মাতৃভাষা সংরক্ষনে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া সহজতর হয়। লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” দর্শনের প্রস্তাবনায় “একুশে কর্নার পোস্টার” প্রতিটি লাইব্রেরীতে একটি স্থায়ী সার্বক্ষণিক প্রচার মাধ্যম। লাইব্রেরী ব্যবহারকারী সাধারন মানুষের সহজতর দৃষ্টিআকর্ষণ পূর্বক একুশে কর্নারের উপস্থিতির সাথে পরিচিতি ও প্রয়োজনীয় সংযোগ স্থাপন, এবং পোস্টারের বৈশ্বিক আবেদন, “কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ” এর প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষে প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে “একুশে কর্নার পোস্টার” বিশেষ অর্থবহ ও আকর্ষণীয় করে প্রণীত হয়েছে। এই পোস্টারে প্রস্ফুটিত আবেগ জড়িত তথ্যাদি একুশের চেতনায় বিশ্বব্যাপী সকল মাতৃভাষা রক্ষার তাগিদ এবং উপায় নিরূপণে সংশ্লিষ্ট সকলকে উৎসাহিত করবে। সারা বিশ্বের সকল লাইব্রেরীতে বাস্তবায়িত একুশে কর্নার এর উপস্থিতি একুশে কর্নার পোস্টারের মাধ্যমে সাধারণের গোচরীভূত হবে, এবং নিজ নিজ মাতৃভাষা রক্ষায় আগ্রহী করে তুলবে। বিশ্বব্যাপী লাইব্রেরী সমুহে একুশে কর্নারের সফল বাস্তবায়ন বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনকে সময়ের আবর্তে সকল ভাষাভাষীর কাছে জনপ্রিয় করে তুলবে।
প্রাথমিক ভাবে “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার পোস্টার” এর দর্শন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের প্রচারণার সার্বজনীন মাধ্যম হিসেবে প্রণীত বার্তা, “কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ” কে যেকোন মাতৃভাষা সুরক্ষার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বব্যাপী এক এবং অভিন্ন বৈশ্বিক বার্তা হিসেবে পরিচিতি লাভের লক্ষ্যে প্রণীত প্রচার মাধ্যম। পরবর্তীতে ব্যাপক ও বিস্তারিত গবেষণা এবং বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর উপযোগ্যতার নিরিখে একুশে কর্নার পোস্টারের নকশা চূড়ান্ত করা হয়।
“লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার পোস্টার”
[ছবি]
বিভিন্ন অর্থবহ রঙে চিত্রিত আকর্ষণীয় এই পোস্টারে বাংলার মহান একুশের আবেগ এবং ভাবগাম্ভীর্যতার পাশাপাশি একুশের চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতার চূড়ান্ত অর্জনের প্রতিচ্ছবিকে বিশ্বের সকল অবক্ষয়মান ভাষাসমুহ রক্ষার অনুপ্রেরণা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারির অধিষ্ঠানের সাথে সংগতি রেখে বিশ্বমানচিত্রের উপর বিভিন্ন ভাষার বর্ণমালা মুদ্রিত একুশের শোকাহত প্রচলিত প্রতীক “কালো ব্যাচ” পোস্টারের মুখ্যতথ্যের ভিত্তি হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। বিশ্বমানচিত্রের উপর কালো ব্যাচ একদিকে বিশ্বব্যাপী যেমন একুশের প্রতীকী উপস্থাপনা অন্যদিকে মাতৃভাষা সমূহের অবক্ষয়ের ফলে বিপন্ন বিশ্ব শিক্ষাসভ্যতাকে বোঝানো হয়েছে। পোস্টারের পাদদেশে সবুজের উপর রক্তিম পদচিহ্ন একুশের রক্তাত্ম স্মৃতির স্বাক্ষরসহ পৃথিবীর সকল ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষা ভয়াবহ সংকট তথা প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণের বৈশ্বিক সমন্বিত সংকল্পের প্রতিচ্ছবি। যে সংকল্পে ব্রতী হয়ে বিশ্ববাসী বিশ্বব্যাপী সকলকে “কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ” বৈশ্বিক বার্তায় নিজ নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণের তাগিদ দেওয়ার মাধ্যমে সকলকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের ডাক দিয়ে যাচ্ছে। কালো ব্যাচের মধ্যস্থিত বৃত্তাকার অংশে বিশ্বের সকল দেশের জাতীয় পতাকার সমন্বিত সন্নিবেশণের মাধ্যমে বৃত্তায়িত অংশকে মাতৃভাষা অবক্ষয়ে সমস্যা জর্জরিত বিশ্ব মানচিত্র(গোলক)হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইংরেজি একুশে(21-টুয়েন্টি ফার্স্ট)র পাশাপাশি বাংলা বর্ণমালার একুশ(২১)’কে সকল ভাষাভাষীর কাছে পরিচিত করার লক্ষ্যে বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষার সমন্বয় করে পোস্টারে দ্বৈতভাষায় একুশকে উপস্থাপন করার মাধ্যমে পোস্টারের কেন্দ্রে “একুশে কর্নার” নামটি বড় হরফে চিত্রিত হয়েছে। যার ফলে মহান একুশের ঐতিহাসিক ভিত্তি বাংলা ভাষাকে বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর কাছে সম্মানজনক ভাষা হিসেবে উন্নিত করার প্রয়াস রয়েছে। পোস্টারের “কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ” এর আবেদন, সন্নিবেশিত তথ্য এবং চিত্রিত বিষয়ের পর্যায়ক্রমিক ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে লাইব্রেরী সেবার সুযোগ গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখিতে পতিত ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষা রক্ষার ব্যবস্থা হিসেবে “একুশে কর্নার” এ স্থানীয় সকল বর্ণমালাসহ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে উৎসাহিত হবে। নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চার প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব অনুধাবন করবে। এই প্রক্রিয়ায় ভাষা রক্ষার গণসংযোগ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে সংশ্লিষ্ট সকল ভাষাভাষীরা স্বাচ্ছন্দে নিজনিজ ভাষা অবক্ষয়রোধে সমর্থ হবে, এবং ঝুঁকিপূর্ণ মাতৃভাষাসমূহ অবক্ষয়ের ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে সাধারণের স্বাভাবিকভাবে ভাষা চর্চায় ফিরে আসতে সাহায্য করবে। পোস্টারের উপরাংশে পাহাড়ের গায়ে চিত্রিত উদয়মান রক্তিম সূর্য, পেন্সিল বই নিয়ে উচ্ছ্বসিত মানুষের ছবির মাধ্যমে “একুশে কর্নার” বাস্তবায়নের ফলে আগত ভবিষ্যতে সকল ভাষাভাষীদের সম্ভাব্য ভয়াবহমুক্ত ভাষা চর্চার সোনালী সকালের সামাজিক অবস্থার ছবি চিত্রিত হয়েছে।
দ্রষ্টব্যঃ [আকর্ষণীয় এই বৈশ্বিক পোস্টারটি শ্রী নির্মল পালের দার্শনিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে শ্রী শুভাশিস মজুমদারের মাল্টিমিডিয়ায় চিত্রিত]
(চলবে)
Nirmal Paul
নির্মল পাল; ইমেইলঃ nirmalpaul@optusnet.com.au; প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপারশনঃ এমএলসি মুভমেন্ট ইনটারন্যাশন্যাল ইনক; প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকারী দলনেতাঃ পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”; প্রকাশিত গ্রন্থঃ “বিশ্বায়নে শহীদ মিনার”; বৈশ্বিক দর্শনঃ “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”, (স্থানীয় বর্ণমালা সংরক্ষণ কেন্দ্র)
Related Articles
অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী – ক্যানবেরা’র যত কথা
ক্যানবেরা অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী। অনেকেই এখনো মনে করে থাকেন সিডনী বা মেলবোর্ন হয়ত বা এই দেশের রাজধানী। সে যাই হোক আমি
Why should Begum Khaleda and Sheikh Hasina talk to each other?
A series of articles have appeared in the newspapers recently on the proposed dialogue face- to-face between the two former
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ এবং একুশে’র বিশ্বায়ন (দ্বিতীয় পর্ব)
প্রেক্ষাপটঃ “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এবং “একুশে’র বিশ্বায়ন” (দ্বিতীয় পর্ব) সিডনীবাসী বাঙালিরা(বিশেষ করে অভিবাসী বাংলাদেশী বাঙালিরা) অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও যত্নের
My heartfelt thanks for publishing the article