প্রেক্ষাপটঃ “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এবং “একুশে’র বিশ্বায়ন” (তৃতীয় পর্ব)

প্রেক্ষাপটঃ “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এবং “একুশে’র বিশ্বায়ন”  (তৃতীয় পর্ব)

এসফিল্ড হ্যারিটেজ পার্কে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” নির্মাণের প্রস্তাবিত নির্ধারিত স্থান থেকে প্রায় একশ’ মিটারের মধ্যে মাতৃভাষা সংরক্ষণ বিষয়ক ব্যতিক্রমী স্টল এবং বিষয়বস্তু কার্নিভ্যাল ফেস্টিভালে আগত স্থানীয় বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে কৌতূহল ছিল লক্ষণীয়। বিশেষ করে পার্কের আশেপাশে বসবাসকারী এবং নিয়মিত পার্ক ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এবং গঠনমূলক পরামর্শ স্মৃতিসৌধ এর নকশা চূড়ান্তকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। স্মৃতিসৌধ এর আকার, আকৃতি, পার্কে অবস্থিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মনুমেন্টের সাথে সংগতি রক্ষা, নির্মাণে ব্যবহৃত উপাদান এবং আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বিভিন্ন বর্ণমালা প্রদর্শন ব্যবস্থার সন্নিবেশন করার মত বহুবিধ প্রস্তাবের মধ্যে সাধারন মানুষের আগ্রহ এবং মাতৃভাষা সংরক্ষণে প্রস্তাবিত স্মৃতিসৌধের প্রয়োজনীয়তা এবং উপযোগ্যতা প্রমানিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার আন্দোলনে শহীদ মিনারের অনুপ্রেরণার সাথে সামাঞ্জস্য বজায় রেখে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবক্ষয়মান মাতৃভাষাসমূহ সংরক্ষণে, “কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ” বার্তাটি বেগমান করার লক্ষ্যকে জোরালো করে স্মৃতিসৌধের নকশা চূড়ান্ত করা সহজতর হয়। বিশ্বায়নের পাশাপাশি দ্রুত অবক্ষয়মান মাতৃভাষা রক্ষার যুৎসই কৌশল হিসেবে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে সারা বছরব্যাপী গণসম্পৃক্তকরনে উদ্ভুদ্ধকরার সুযোগ-সুবিধা বিধানে বিরামহীন(২৪/৭)বার্তা হিসেবে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ’র স্থাপত্য উপস্থিতি এভাবে বর্ণিত হয়ঃ(সম্মুখ)“হে ছয়’শকোটি বিশ্ববাসী(ভিত্তি-১) উনিশ‘শ বায়ান্নের একুশের(ভিত্তি-২) মাতৃভাষা বাংলা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা, আত্মত্যাগী শহীদদের আত্মার প্রতি সম্মান (আমার ভাইয়ের… গানের কথা), এবং স্মৃতিতে নির্মিত শহীদ মিনার(শহীদ মিনারের ছবি)এর চেতনাদীপ্ত শপথে ‘কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ’(খোদাইকৃত বর্ণমালা)বার্তায় তোমরা(গ্লোব)নিজ-নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণে উজ্জীবিত হও, এবং অন্য ভাষাভাষীকে উৎসাহিত কর”।(স্মৃতিসৌধের পিছনঃপ্রামানিক তথ্যাদি)একুশের ঐতিহাসিক তথ্য, একুশের ভাষা শহীদদের নাম এবং এবিষয়ে ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের তথ্যাদি । নকশা’র পরিমাপ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের (২০০৬)পৃথিবীর জনসংখ্যার অনুপাতে অর্থাৎ সকল ভাষাভাষী ছয়’শ কৌটি মানুষকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ছয় সংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে(অনুপাতে)বিন্যস্ত হয়েছে।

“কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ” বার্তায় অবক্ষয়মান ভাষা সংরক্ষণে ইউনেস্কোর সদস্যভুক্ত সকল দেশকে সহজতর উপায়ে উজ্জীবিত করা, তথা অন্তর্ভুক্ত করার কৌশল হিসেবে নকশার গ্লোবে অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের মানচিত্রের অবস্থানকে সামনে রেখে গ্লোবটি স্থাপন করা হয়েছে। বৈশ্বিক বার্তা ‘কন্সারভ ইউর মাদার ল্যাংগুয়েজ’ ঘেরা এই গ্লোব স্থাপনার মাধ্যমে মাতৃভাষা সংরক্ষণে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের মানচিত্রের সম্মুখে অবস্থান বাংলাদেশকে মাতৃভাষা সংরক্ষণ আন্দোলনের গণসম্পৃক্ততার ‘সূতিকাগার’, এবং অস্ট্রেলিয়ার (এসফিল্ড পার্ক)মানচিত্রের সম্মুখে অবস্থানকে অস্ট্রেলিয়ার বহুজাতিক সমাজব্যবস্থা থেকে বিশ্বগণসচেতনতা সৃষ্টি কার্যক্রম ‘শুরুর ভিত্তি’ হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। মাতৃভাষা সংরক্ষণের মনুমেন্টাল প্রচারণার কৌশলী এই বৈশ্বিক মহাযাত্রায় স্মৃতিসৌধের মুলবেদী হিসেবে প্রাচীনকালে অক্ষরজ্ঞানের হাতেখড়ির মাধ্যম স্লেট পাথরের ব্যবহার, এবং স্মৃতিসৌধের স্থাপত্যে অস্ট্রেলিয়ার অংশীদারিত্ব স্থায়ীভাবে নিশ্চিত হওয়ার লক্ষ্যে স্লেট পাথরটি অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। এসফিল্ড পার্কটি হ্যারিটেজ পার্ক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুবাদে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মনুমেন্টসহ আরও কিছু ঐতিহ্যপূর্ণ ঐতিহাসিক স্বাক্ষর বহন করার কারনে এই পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” পৃথিবীর সকল ভাষাভাষী ছয়‘শ কৌটি মানুষের সকলের অধিকার নিশ্চিত করার মাদ্যমে বৈশ্বিক মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। একুশের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উত্তরণের সুবাদে আমাদের মহান শহীদ মিনারের দার্শনিক উপাদান এবং একুশের চেতনা “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এর নকশা ও স্থাপত্য অলংকরণের মাধ্যমে সকল ভাষাভাষীর কাছেই স্থায়ী আসনে উত্তীর্ণ হওয়ার পথ সুগম হয়েছে।

প্রতিবছর ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে বিলীনমুখী বিপর্যস্ত মাতৃভাষাগুলি সুরক্ষার প্রয়োজনের প্রচ্ছন্ন বার্তাকে সকল ভাষাভাষীর কাছে কৌশলে পৌঁছে দেয়া, এবং সকল ভাষাভাষীকে এই দিবস উদযাপনের মাধ্যমে মাতৃভাষা চর্চায় আগ্রহী করার স্থিত স্থাপত্য হিসেবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধের পরিকল্পনা বাংলার শহীদ মিনারেরই আন্তর্জাতিক সংস্করণ, এবং সংকটাপন্ন সকল ভাষা অবক্ষয়ের বাস্তব কারনসমূহ বিবেচনা প্রসূত। নকশায় মহান একুশের চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে অবক্ষয়মান স্থানীয় ভাষাসমূহ সংরক্ষনে প্রতিটি মাতৃভাষার পাঁচটি বর্ণমালা (পাঁচটি মহাদেশে বিস্তৃত) স্মৃতিসৌধের বক্ষ্যে খোদাইকরণের মাধ্যমে প্রত্যেকটি ভাষার অনিবার্য সংরক্ষণের প্রতীকী ইংগিত বহন করে। স্থানীয় মাতৃভাষা সংরক্ষণের এই প্রতীকী প্রক্রিয়ায় উৎসাহিত করার উদাহরন হিসেবে একুশের ভিত্তি বাংলা ভাষার বর্ণমালার অবস্থান প্রথম রাখা হয়েছে; অর্থাৎ পৃথিবীর যেকোন স্থানে নির্মিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধের ক্ষেত্রেই এই অবস্থান বাংলা’র স্থায়ী আবস্থান। একইভাবে আধুনিক বিশ্বায়নের যুগের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত ভাষার তাল মিলিয়ে সর্বক্ষেত্রে সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা ইংরেজিকে স্থায়ীভাবে দ্বিতীয়স্থানে অবস্থান, এবং নির্মিতব্য এলাকাস্থ প্রধান আদিভাষার অবস্থানকে তৃতীয়স্থানে স্থায়ী রেখে অন্যান্য ভাষাসমূহের অবস্থান নির্ধারিত করা হয়েছে। সংকটাপন্ন মাতৃভাষাসমূহ সংরক্ষণে বিশ্বব্যাপী মনুমেন্টাল প্রচারণা এবং ভাষাসমূহের প্রতীকী সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল হিসেবে সকল ভাষাভাষীদের অংশগ্রহণে উৎসাহযোগান নিশ্চিতকরণের জন্য লাইব্রেরী সিস্টেমে “একুশে কর্নার” প্রতিষ্ঠার দার্শনিক বিষয় সংকলিত হয়েছে। “একুশে কর্নার”এ স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত ভাষাসমূহের বর্ণমালা বা বর্ণমালা সংক্রান্ত উপাদানসমূহ সংরক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি এবং প্রচলিত লাইব্রেরী সেবা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হবে।

স্মৃতিসৌধের চূড়ান্ত নকশায় মহান শহীদ মিনারকে বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা সংরক্ষণে গণসচেতনতা সৃষ্টির দৃষ্টান্ত হিসেবে মূল বেদীর বক্ষে “শহীদ মিনার” খোদাই করা হয়েছে, যা দ্বিতীয় সংস্করনের মডেলে দ্বিতীয় ভিত্তি(১৯৫২)’র উপরে খোদাই করার সিদ্ধান্ত ছিল। তাছাড়াও পৃথিবীর প্রথম স্মৃতিসৌধ হিসেবে এবং ইউনেস্কোর মাতৃভাষা রক্ষার সহায়ক মুখ্য স্থাপত্য বিবেচনায় স্মৃতিসৌধের মূলবেদীর অবস্থান স্মৃতিসৌধের ভিত্তির পেছনের দিকের পরিবর্তে কেন্দ্রস্থলে স্থানান্তরিত করা হয়। অধিকিন্তু মডেলের দ্বিতীয় সংস্করণে উপস্থাপিত তথ্যাদি অধিকতর অর্থবহ এবং অন্যান্য ভাষাভাষীর কাছে গ্রহণযোগ্য করার কথা বিবেচনায় তথ্যাদি সংক্ষেপ করে (অনুবাদের পরিবর্তে ভাবার্থ)চূড়ান্ত অবস্থানে বিন্যস্ত হয়। স্থানীয় কাউন্সিলের কাউন্সিলর, কর্মকর্তাসহ সকল ভাষাভাষী এবং সংশ্লিষ্ট সকল একুশ প্রেমীদের সমন্বিত মতামতের ভিত্তিতে অনুমোদিত হয় পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”এর চূড়ান্ত নকশা। মহান একুশের চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের স্বাপ্নিক কৌশল বাস্তবায়নের দ্বার খুলে যায়- বাংলার মহান শহীদ মিনারের বৈশ্বিক প্রতিচ্ছবি, “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এর প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।(চলবে)

Nirmal Paul

Nirmal Paul

নির্মল পাল; ইমেইলঃ nirmalpaul@optusnet.com.au; প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারপারশনঃ এমএলসি মুভমেন্ট ইনটারন্যাশন্যাল ইনক; প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নকারী দলনেতাঃ পৃথিবীর প্রথম “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”; প্রকাশিত গ্রন্থঃ “বিশ্বায়নে শহীদ মিনার”; বৈশ্বিক দর্শনঃ “লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার”, (স্থানীয় বর্ণমালা সংরক্ষণ কেন্দ্র)


Place your ads here!

Related Articles

ধন্যবাদ বাংলাদেশের আত্বত্যাগী জনগন ও নির্বাচন কমিশনকে

লিখেছেন এডেলইড থেকে, আরশাদ হোসেন ভূঁইয়া please click attached below pdf files for details

The Institution of Engineers, Bangladesh (IEB) Australia Chapter

Date: 21 August 2018 Dear all Bangladesh Engineers, The Institution of Engineers, Bangladesh (IEB) Australia Chapter has made a decision

ধলেশ্বরী-২

আমাদের ছোট নদী চলে বাকে বাকে বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে………… আমর ছেলেটা যখন এদেশটা আসলো তখন সবে হাটা

1 comment

Write a comment
  1. Nirmal Paul
    Nirmal Paul 10 May, 2018, 15:48

    Dear Editor my heartfelt thanks for publishing the article

    Reply this comment

Write a Comment