পাহাড়ে আহারে!
বিজয় দা’কে যখন এইবার ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের বাৎসরিক বনভোজনের দায়িত্ব দেয়া হল তখনই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম এইবারের ভ্রমণ হতে যাচ্ছে আমাদের জন্য স্মরণীয় এবং স্মৃতিবহুল কারণ উনার মত গোছানো এবং পরিপাটি মানুষ আমাদের বন্ধুমহলে দ্বিতীয়টি নেই। বিজয় দা, রুপা বৌদি এবং উনাদের মেয়ে এলভিরা আর ছেলে রেনোর আগেই একদিন যেয়ে জায়গাটা দেখে আসলেন এবং আমাদের কাছ থেকে জায়গাটার সৌন্দর্যের কথা লুকিয়ে রাখলেন। আমি গুগুল ম্যাপে যেয়ে নওরা শোগ্রাউন্ড লিখে সার্চ দিয়ে যে জায়গাটা পেলাম সেটা একটা বিশাল খেলার মাঠ যার তিনদিকে বন কিন্তু আশেপাশে বাচ্চাদের কোন খেলার জায়গা নেই। তাই স্বভাবতই আমি একটু উদ্বিগ্ন বোধ করছিলাম বাচ্চারা সারাদিন সময় কাটাবে কি করে? পাশে একটা নদী দেখে বিজয় দা’কে মেসেজ দিলাম নদীতে ঝাপাঝাপি করা যাবে কি না। উত্তরে উনি বললেন করা যাবে তবে সেটা করতে হলে আপনাকে নদীর বেশ খানিকটা উজানে যেতে হবে কিন্তু সেটা আমাদের বনভোজনের জায়গা থেকে বেশ কিছুটা দূরে। এই উত্তর শুনে মনেমনে আমি আরো দমে গেলাম।
অবশেষে নির্দিষ্ট দিনে আমরা ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের বনভোজনের বাসে চড়ে বসলাম। মিন্টো থেকে নওরা প্রায় দু’ঘন্টার বাস ভ্রমণ তবে আপনি যদি সিটি থেকে যেতে চান তাহলে প্রায় ঘন্টা তিনেক লাগবে। একঘণ্টা পর আমরা লেক ইলাওয়ারাতে বিরতি নিলাম। এবং সকালের হালকা নাস্তা সেরে নিলাম। ইতোমধ্যেই বাচ্চারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেলাধুলো শুরু করে দিল। লেক ইলাওয়ারা জায়গাটাও অপার সৌন্দর্যের আধার তাই আমরা তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম পরে কোন একসময় আমরা এখানে বেড়াতে আসবো। এরপর আবারো বাস চলতে শুরু করলো। আরো প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর আমরা নওরা শোগ্রাউন্ডে উপস্থিত হলাম। বাস থেকে নেমে যায়গাটা দেখে তখনও বুঝতে পারিনি আমাদের জন্য আসলে কতবড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে। বিজয় দা মাইকে সবাইকে ব্রিফ করলেন এখানে কি কি আছে। উনি বললেন আমাদের পিছনে মানে আমরা যেদিক দিয়ে এসেছি সেদিকে বেনস ওয়াক নামে বুশওয়াক আছে।
অস্ট্রেলিয়াতে বেশিরভাগ বনকেই বুশ বলা হয় বনের মধ্যে বুশ নামে একধরণের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ জন্মানোর কারণে। উনি বললেন আর আমাদের সামনেই আছে মেইন গেট সেখানে আপনারা ফটোসেশন করতে পারেন। আমরা এডভেঞ্চার প্রিয় তিন পরিবার আমি আর আমার গিন্নি সাথে আমাদের দুই ছেলেমেয়ে তাহিয়া ও রায়ান, আমার মেয়ের বান্ধবী জেইনা আর তার বোন জাহিয়া সাথে ওদের বাবা মা ফাহিমা এবং সোহেল, পুলক ভাই এবং ইলা ভাবি আর তাদের দু ছেলেমেয়ে অবনী এবং অর্ক আর আলিশা এবং সুবাহ তার বাবা মাকে ফেলে আমাদের সাথে বেড়িয়ে পড়লো আর আমরা সাথে থাকাতে উনারাও নিশ্চিন্ত হলেন। এলভিরা যেহেতু এর আগে এসে জায়গাটা রেকি করে গেছে তাই ওর কাধে দায়িত্ব পড়লো আমাদেরকে গাইড করার।
হ্যাংগিং রকের সামনে এসে শাওয়ালহেভেন নদীর দৃশ্যটা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। আমরা দুচোখ ভরে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিলাম কিন্তু এলভিরা তারা দিচ্ছিল আমাদের তাড়াতাড়ি শুরু করা উচিৎ। সেখানকার দিক নির্দেশনা দেখে আমরা বড়রা একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম কোন দিকে যাবো। তখন বাচ্চারা বলল আমরা আগে দেখে আসি ঠিক রাস্তা হলে তোমাদের ডেকে নিয়ে যাবো। ওরা কিছুদূর যেয়েই আলিশার ফোন থেকে কল দিয়ে জানালো ওদের যাওয়ার পথটাই ঠিক আছে. তাই আমরাও ওদেরকে অনুসরণ করলাম। এরপর আমরা এগিয়ে চললাম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। শুরুতেই অনেকটা ঘুরপথে নিচে নামতে হয়। সেই পথটা এতটাই খাড়া যে ভুল করে পা ফসকে গেলে আর রক্ষা নাই। তাই আমরা সাবধানে পা টিপেটিপে এগিয়ে চললাম। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে চলেছে নওরা ক্রিক। তার উপরেই রয়েছে কাঠের পাটাতনের একটা ঝুলন্ত সেতু। আমরা সেতুর উপরে চড়ে সেটাকে দোল দিয়ে ভয় পাওয়ার মেকি অভিনয় করে পার হয়ে গেলাম। ক্রিকের ঠিক অপর পাশেই মোটামুটি সমতল জায়গা তাই এডভেঞ্চার প্রিয় আমরা ফিরে এসে পাহাড়ের পাদদেশ ধরে এগোনোটাকেই বেছে নিলাম। আর আমাদের গাইড এলভিরাও সেটাতেই সায় দিল। অত:পর আমাদের প্রায় তিনঘণ্টার ভ্রমণ শুরু হয়ে গেল।
পাহাড়ের গায়ে সারিসারি উচু গাছ তার ফাক দিয়ে পাহাড়ের জবুথুবু পাথর গুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে গাছের পাতা দুলে এক বিচিত্র ধরণের শব্দ হচ্ছে যেন পাথর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাছেদের নৃত্য উপভোগ করছে। অন্যপাশে নওরা ক্রিকের কাকচক্ষু জল। তার কিনারে ছোটছোট লাজুক কাকড়ারা ঘর বানিয়েছে। আমাদের দেখলেই টুপ করে তাদের গর্তে ঢুকে পড়ছে। ক্রিকের পানিতে ছোটছোট মাছ সাতার কেটে বেড়াচ্ছে এবং পানি স্বচ্ছ হওয়াতে আমরা সেটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। মাছ দেখে ইলা ভাবি বললেন এরপরে আমরা সবাই আবারো এখানে বেড়াতে আসবো এবং বড়শি নিয়ে এসে মাছ ধরবো।
একটু পরে পরেই ক্রিকের পাড়ের গাছগুলো কাত হয়ে ক্রিকের পানির দিকে হেলে পড়েছে। পুলক ভাই সেই গাছ বেয়ে পানির উপরে যেয়ে আমাদের সাহস বাড়িয়ে দিলেন তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এরপর কোন কাছ পেলেই আমরা চড়ে বসবো। বলতে বলতে পেয়ে গেলাম যুতসই একটা। সেখানে আমি, সোহেল আর পুলক ভাই চড়ে বসলাম। অবশ্য বাচ্চারাও হইচই শুরু করে দিল চড়ার জন্য কিন্তু পিছলায়ে পানিতে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি বলে আমরা তাদেরকে নিরস্ত্র করলাম। মাঝেমধ্যেই পাহাড়ের দুএকটা অনেক বড় পাথরের চাই পানির মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমরা সেখানেও চড়ে বসছিলাম দলবল নিয়ে। এছাড়াও স্থলেই অনেক বড় বড় পাথর পেয়ে সেগুলোতেই চড়ে বসা হচ্ছিল বিশেষকরে যুগলরা উঠে টাইটানিক সিনেমার জ্যাক এবং রোজের ভঙ্গিমায় ছবি তুলছিল।
আমি আর রায়ান সবার শেষে যাচ্ছিলাম কারণ রায়ান প্রত্যেকটা বস্তু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে এগোচ্ছিল আর আমাকেও ওর সাথে সংগ দিতে হচ্ছিল। হঠাৎ দেখি মাথার উপর দিয়ে একটা অনেক মোটা লতা এগাছ থেকে ওগাছে গেছে। দেখেই আমি বনের রাজা টারজানের ভুমিকায় ঝুলে পড়লাম। আমার ঝুলে পড়া দেখে বাকিরা হৈহৈ করে চলে আসলো। তখন একেএকে পুলক ভাই আর ছোটবড় সব বাচ্চায় একবার করে ঝুলে পড়ার আনন্দ নিল এবং তারা তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো “দিস ইজ দ্য বেস্ট পার্ট”।
আমরা আরো সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। কারণ আমাদের যাওয়ার পথের পাশের নির্দেশিকা বলছিল সামনেই ক্রিক পারাপারের বড় পাথর। আমরা আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না পাথর দিয়ে কিভাবে মোটামুটি প্রশস্ত এই নদীটা পার হওয়া যাবে। আরো বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর এলভিরা ফিরে এসে জানালো সামনে রাস্তা শেষ হয়ে গেছে। আমরা যেয়ে দেখলাম আসলেই রাস্তা শেষ হয়ে গেছে কিন্তু একটা অনেক বড় পাথরের পাশ দিয়ে একজনের চলার মত রাস্তা নিচে নেমে গেছে। আমরা সে পথ ধরে এগোনোর দেখলাম বেশ কয়েকটা পাথর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নদীটার এপাশ থেকে অপর পাশ পর্যন্ত চলে গেছে। সেটা দিয়েই আমাদের নদী পার হতে হবে সবাইকে সামনে দিয়ে আমি থেকে গেলাম পিছনে নদী পারাপারের ছবি তোলার জন্য। সবাই নদী পার হচ্ছে আর প্রত্যেকের ছায়া কাকচক্ষু স্বচ্ছ জলে পড়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করছে। এই দৃশ্য শুধুমাত্র সামনাসামনি দেখলেই তার সৌন্দর্য অনুভব করা সম্ভব। ভাষায় এর সৌন্দর্য প্রকাশ করা দুরহ ব্যাপার।
নদী পার হয়ে অপর পাশে মোটামুটি সমতল জায়গা। এই পথেই দেখা হয়ে গেল দিশা ভাবি এবং নীলা ভাবী আর দিশা ভাবীর মেয়ে আলিশার সাথে। উনারা সেতু পার হয়ে অপর পাশ দিয়ে হেটে এসেছেন। যেহেতু এই পুরো পথটা ইউ আকৃতির তাই উনাদের সাথে দেখা হয়ে গেছে। সেতু পার হবার আলিশা দিশা ভাবি আর নীলা ভাবীর সাথে যোগ দিয়েছিল। উনারা ইউয়ের অন্য পাশে চলে গেলেন কিন্তু আলিশা আমাদের সাথে থেকে গেল। এই সমতল জায়গাটাও অনেক সুন্দর। সামান্য কিছুদূর সমতল জায়গার পর আস্তেআস্তে জায়গাটা উঁচু হয়ে আবার পাহাড়ে রূপ নিয়েছে। দেখে মনেহল এই জায়গাটা ছোটবেলায় পড়া মালভূমির বাস্তব রূপ। আমরা হেটেহেটে সমতল জায়গাটা পার হয়ে আবার সেতু পাড়ি দিয়ে উঁচু ঢাল বেয়ে উপরে ওঠা শুরু করলাম। উপরে উঠতে যেয়ে সবাই হাপিয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু কারো চোখেমুখে কোন ক্লান্তি দেখলাম না। সবার মুখেই এক ধরণের দিগ্বিজয়ীর অভিব্যক্তি বিশেষকরে বাচ্চারা বলাবলি করছিল এটা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় এডভেঞ্চার ছিল। শুনে খুবই ভালো লাগলো এবং আমরা বড়রা পরিকল্পনা করে ফেললাম এই জায়গাটাতে আবার বেড়াতে আসার। আর আমরা সবাই খুবই মিস করছিলাম আমাদেরই মত এডভেঞ্চার প্রিয় আরো একজন মানুষকে যিনি অসুস্থ্যতার কারণে আমাদের সাথে আসতে পারেন নাই তিনি হচ্ছেন আমাদের রুপা বৌদি। যিনি পুরো অভিযানে আমাদের সাথে না থেকেও আমাদের সাথে ছিলেন।
আপনিও চাইলে যেকোন ছুটির দিনে আপনার বাচ্চাদের নিয়ে এই এডভেঞ্চারে চলে যেতে পারেন। তবে দুইটা তথ্য আপনাকে মনে রাখতে হবে। প্রথমটা হল পায়ে জুতা বা কেডস পরে গেলে পাহাড়ে চলাচল করতে সুবিধা হবে আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে ওখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক বেশ দুর্বল। তাই সবাই খুব কাছাকাছি থাকলে যোগাযোগটা সহজ হবে।
Md Yaqub Ali
আমি মোঃ ইয়াকুব আলী। দাদি নামটা রেখেছিলেন। দাদির প্রজ্ঞা দেখে আমি মুগ্ধ। উনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এই ছেলে বড় হয়ে বেকুবি করবে তাই এমন নাম রেখেছিলেন হয়তোবা। যাইহোক, আমি একজন ডিগ্রিধারী রাজমিস্ত্রি। উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে অস্ট্রেলিয়াতে আমার আগমন ২০১৫ সালের মার্চে। আগে থেকেই ফেসবুকে আঁকিবুকি করতাম। ব্যক্তিজীবনে আমি দুইটা জীবের জনক। একটা হচ্ছে পাখি প্রকৃতির, নাম তার টুনটুনি, বয়স আট বছর। আর একজন হচ্ছে বিচ্ছু শ্রেণীর, নাম হচ্ছে কুদ্দুস, বয়স দুই বছর। গিন্নী ডিগ্রিধারী কবিরাজ। এই নিয়ে আমাদের সংসার। আমি বলি টম এন্ড জেরির সংসার যেখানে একজন মাত্র টম (আমার গিন্নী) আর তিনজন আছে জেরি।
Related Articles
নানা রূপে সিডনি অলিম্পিক পার্ক বৈশাখী মেলা
সিডনিতে এখন শরত, তবুও অনুষ্ঠিত হলো বাংলা নব বর্ষের প্রানের উত্সব বৈশাখী মেলা, গত ২৬ এপ্রিল অলিম্পিক পার্ক এর অ্যাথলেটিক
Request for BAAC Membership Fee
Dear All, Thank you very much for your continuous support!! After all, “we’re proud of what we’ve been able to
সাখাওয়াৎ আলম চৌধুরীর গল্প
” একটু পানি খাওয়ান তো!” আমি তার দিকে না তাকিয়েই বললাম,” ছোট বোতল নাকি বড় বোতল?” ” আরে বোতলের না!