জীবন থেকে নেয়া – ১: আড্ডার হালচাল

জীবন থেকে নেয়া – ১: আড্ডার হালচাল

জাতি হিসেবে আমাদের সুনাম আছে। অতি আবেগে বেগ আছে। কাঁধে কাঁধ ধরিয়া তুলিয়া ধরবার জো যেমন আছে, পরশ্রীকাতর হয়ে তেমনি পেছনে টেনে ধরার লোকেরও অভাব নেই।

ঠাট্টাছলে আড্ডা বা গল্পে রসিকতা করে অনেকেই স্বজাতিকে ‘ছিদ্রান্বেষী জাতি’ বলতেও কার্পন্য করে না। এরজন্য অবশ্য যৌক্তিক কারনও আছে। অন্যের ভালো কিছু দেখলে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। সামান্য ভুলে ছিদ্র খুঁজে বেড়াই। ছিদ্র না পাইলে নিজেরাই ছিদ্র করে নিই। গল্পে আসর উত্তপ্ত হয়ে উঠে। আলোচ্য বিষয় রাজনৈতিক সামাজিক ধর্মীয় অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক নানান বিষয়। জ্ঞানের সবটুকু ডিকশনারী উন্মুক্ত করে সকল অঙ্গনে বিচরন করেন আলোচকগণ। তর্কে মধ্য রাত, আড্ডা জমে উঠে। কখনো নিছক বিনোদন নির্ভর হয়ে উঠে এসব আড্ডা, কখনো বা মন কষাকষি। বলে রাখা ভালো, এমনটা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে!

ব্যক্তি বিশেষ কথা বলার ঢং আচরন অন্যকে সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি ফুটে উঠে। কেউ মনযোগী শ্রোতা, কেউ ননস্টপ বক্তা। কেউবা গাঁ-এ মানে না আপনা মোড়ল টাইপ। আবার কেউ কেউ বুঝেও না বোঝার ভান করে, দেখেও দেখে না, শুনেও শুনে না। এরা অপেক্ষাকৃত নীরহ, নিরাপদ বন্ধুত্ব রক্ষার্থে অন্ধ-বধির-কালা রুপ ধারন করে। দু’একজন উত্তপ্ত আলোচনায় উস্কে দিয়ে মুখে কুলুপ আটেঁন, আগুনে ঘি ঢালতেই তারা পারদর্শী। কেউ চঞ্চল ধরনের হয়, কেউ খুব প্রাণখোলা, কেউবা খুব চাপা স্বভাবের হয়। কাছের মানুষদের ছাড়া সহজে অন্য কারো সাথে মিশতে পারে না। ভিন্ন পরিবেশ ভিন্ন জীবনযাত্রার কারণে মানুষের স্বভাবের এমন নানা বৈসাদৃশ্য তৈরি হয়। বারো রকমের মানুষের মিলনে যাপিত জীবন।

জীবন এবং যাপন সত্যিই ঝঞ্ঝাটের। আনন্দেরও বটে! সমাজে, রাজনীতিতে নিয়ত সংকট। সেই আড্ডা শুধুমাত্র পুরুষকেন্দ্রিক হয় না। রমনীকূল ঘিরেও জমজমাট হয়ে উঠে এসব আড্ডাস্থল। পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাঙালি আছে, দু’ঘর মিলে আড্ডার আসর জমবে না, তা কল্পনাতীত! এক্ষেত্রে প্রবাসে বাঙালিয়ানার চিত্র একটু ভিন্ন। কর্মবিরতি নেই এতটুকু। ঘরে-বাইরের প্রচন্ড ব্যস্ত সময় পার করে সবাই। সকল ব্যস্ততা ছাপিয়ে বাঙালিয়ানার সুখ খোঁজতেই উইক্যান্ডে জমে উঠে আড্ডা। উৎসবমুখর হয়ে উঠে বাড়ির ব্যাকইয়ার্ড, পার্ক কিংবা রেঁস্তোরা।

এই তো গত সপ্তাহে একটা প্রোগ্রামে গেলাম পরিচিত এক ভাবী অন্য এক ভাবীকে দেখা মাত্রই বলে উঠলেন, কতদিন পর দেখা! বাসার সব খাবার কি আপনি একাই খেয়ে ফেলেন নাকি! বলেই খটখট করে হেসে উঠলেন। কথাটা তিক্ত ঝাঁঝালো মনে হলো। আমার দূর্ভাগ্য আমিও একই টেবিলে বসা ছিলাম। প্রশ্নকারীকে আগুন্তুক ভাবী পাল্টা উত্তর দিলেন আপনি কম খান কেন, আপনার হাজব্যান্ডের কি ইনকাম কম!? উপযুক্ত যুত্সই উত্তর। মনে মনে সাব্বাশ দিলাম উত্তরদাতাকে। কথার কি ছিরি! এ যেন ছিদ্র খুঁজে না পেয়ে নিজেই ছিদ্র করে নেয়ার মত অবস্থা! কিংবা তুলনামূলকভাবে সুস্বাস্হ্যের অধিকারী হওয়ায় নিজেকে তুলে ধরার সুযোগ পেয়ে গেলেন জৈনক ভাবী। ক্ষুদ্র ছিদ্রটি আঙুল প্রবেশ করাইয়া তদপেক্ষা বড়সড়ো গর্ত খোঁজার চেষ্টা করা!

কাউকে ছোট করতে পারিলে, হেয় করতে পারাটাই যেন এক প্রকার বিমলানন্দ।

এ আনন্দে আমরা দ্রবীভূত হই কদাচিৎ, সুযোগসন্ধানী তা দেখে বগল বাজাইয়া নিজেদের আখের গুছিয়ে নেন। সরলদের নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নাই।

মেয়েলী আড্ডার আরো কিছু কমন বিষয় চিকন-মোটা, কালো-ফর্সা, লম্বা-বেঁটে, সুন্দরী-অসুন্দরী, বিবাহিতা- অবিবাহিতা, কে কি জব করে, কত দামী শাড়ি গয়না পড়ে, হাজব্যান্ড থেকে শুরু করে শ্বশুড়ালয়ের হাঁড়ি পাতিল সব বিষয় যেন আড্ডার রসদ! থেমে নেই শ্বশুড়ীনিন্দাও।

তথাকথিত নারীবাদীদের কেউ হয়তো আমার এ লেখা পড়ে বিগড়ে যেতে পার। মুখ হাড়ি হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ‘মেয়েদের আড্ডা আর মেয়েলি আড্ডা’ শব্দ দু’টোর মাঝে ঝামেলা বাঁধিয়ে বসে গুটিকয়েকজন। ফাঁক বুঝে টিপ্পনী,গসিপ-গীবত আর শাড়ি-গয়না-রান্নাবাটির গল্পই হচ্ছে মেয়েলি আড্ডার প্রান। আর ছেলেদের আড্ডা মানেই আলপিন থেকে এরোপ্লেন। আমি বলছি না যে পুরুষেরা ধোয়া তুলসী পাতা। তাদের আড্ডায় ও দেখা যায় সহস্র ফাঁপা কথার ঝুরি, সুযোগ পেলে কেউ কেউ রাজা-উজির মারতেও ভুলেন না, অহরহ সবজান্তা সেজে দুনিয়ার তাবড় বিষয়ে মতামত জাহির করায় বিরাম নেই। এতসব খুঁত নিয়েও পুরুষদের বিচরন থাকে বৈশ্বিক বিষয়ে। গল্প-উপন্যাস-সিনেমায় সব বিষয় তাদের নখদর্পণে। আরো একটি বিষয় সুস্পষ্ট ঘরের বউটি যে তার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি, মুখরোচক আলাপচারিতায় তার সেই অধিকারবোধ ক্ষুণ্ণ হতে পারে, এবং বউয়ের ইজ্জত যাবে, সম্ভবত এই ভাবনাটা তাদের মনে জন্ম থেকেই পাকাপাকি ভাবে গেঁথে থাকে। যা মেয়েদের কেউ কেউ সেটা বেমালুম ভুলে যায়।

বন্ধুত্বের রোজনামচায় সেটাই তো চিরাচরিত চরিত্র বাঙালিদের!

অফিসে বা কর্মক্ষেত্রে মেয়েলি আড্ডার রুপ সামান্য ভিন্ন। একজন মেয়েই অন্য মেয়ে সহকর্মী সম্পর্কে নিন্দা করছে। বসকে জড়িয়ে নোংরা কথা বলছে। অহেতুক সন্দেহ করছে পুরুষ সহকর্মীকে ঘিরে। অফিসে কার সঙ্গে কে রঙিন সম্পর্ক গজিয়ে উঠেছে, কে কে পরকীয়ায় মাতোয়ারা নানান কিছু। টপিক হিসাবে নিজের বরটিও থাকছে কদাচিৎ। তবে খানিকটা যেন ত্রিশঙ্কু হয়ে। কোনও দিন তার শ্রাদ্ধ চলছে তো, কোনও দিন পতিদেবের প্রেমে শ্রীমতী হাবুডুবু!

আড্ডা সব সময়ই টক ঝাল মিষ্টি। আড্ডা হয়ে উঠুক নিটোল বিনোদন নির্ভর। পারস্পরিক মূল্যবোধে প্রানচঞ্চলময়।

সামাজিকীকরণের প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার। শ্রদ্ধাবোধ, আচরণ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিক্ষা ইত্যাদির ভিত্তি তৈরী করে দেয় পরিবার। প্রতিটি পরিবারই একেকটি প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে সে যা শিখবে, সারাজীবন সে তাই করবে। ব্যক্তির আচরনই নির্ধারণ করে দিবে কোথাকার পানি কোথায় গড়িয়েছে !

এসব কোন হতাশার গল্প নয়। সমাজের একটি চিত্রনাট্ট্য মাত্র!

একাত্তরে ‘ঢাল নাই, তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার’ এই বাঙালী জাতি কি এক দুর্নিবার চেতনায় একতাবদ্ধ হয়েছিল বলেই বাংলাদেশী হিসেবে আজ আমরা স্বাধীন জাতি। আমরাই পারি নিজেকে শুধরে নিতে। ভাইয়ের জন্য ভাই, বন্ধুর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেl

মানুষের জয় হোক। মনুষ্যত্ব প্রাধান্য পাক।

হ্যাপী রহমান
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
১২.০৮.২০১৭ইং



Place your ads here!

Related Articles

Canberra Ramadan 2023 (1444H) Starts Thursday 23rd March

Salamu Alaikum WRT, WBT (Peace be on you). The Imams Council of the ACT announces the start of Holy Ramadan

Whether or How Far the Management Tools are Applicable in Education?

(Part One) Preamble : In the recent decades revolutionary changes have taken place in industries and business houses due to

Travel to US and Europe – Tipping an American Culture

It was Airbus A380 that we flew on the first leg of our journey from Sydney to Los Angeles (LA).

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment