বাঙালি ঐতিহ্যের বার্তা ও সংস্কৃতির প্রতীক প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা’র অনন্য সাক্ষী হয়ে রইল সিডনির এএনজেড স্টেডিয়াম
হ্যাপি রহমান: কিছু কিছু উৎসব আছে, যেগুলো বাঙালী সংস্কৃতিকে ধরে রাখে সকল জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে। সে রকমই নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক একটা উৎসব হল বর্ষ বরন। বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন হচ্ছে বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসব। ফলে এ উৎসবের জৌলুস ও ঔজ্জ্বল্য আমাদের জাতিগত মর্যাদারই প্রতীক।
দীর্ঘ ২৫ বছরের যাত্রাপথে সিডনি বৈশাখী মেলা আজ এক অনন্য মহীরুহে পরিণত হয়েছে, সেই স্বপ্ন যাত্রা সফল করেছে বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল, অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে এই মেলার আয়োজন করে আসছে সংগঠনটি। নানান সংস্কৃতির আবহে সংগঠনটির ধারাবাহিক কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বদেশিয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনে সম্প্রীতির সেতু গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
বর্ষপরিক্রমায় পয়লা বৈশাখ পৃথিবীতে আসবেই। কালবৈশাখীর আনাগোনা থাকুক বা না থাকুক, প্রকৃতিপ্রেমিক বাঙালির জন্য বৈশাখের আগমনী বার্তা গেঁথে চলে হৃদয় কম্পনের নিবিড় গল্প।মেয়েদের পরনে থাকে সাদা-লাল শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ আর ছেলেদের পাঞ্জাবি। উদ্দেশ্য – বাংলা বর্ষ বরনের মধ্য দিয়ে বৈশাখী মেলার উৎসবের আনন্দে বাঙালির সংস্কৃতিকে তুলে ধরা।
ব্যস্ত শহরে অনেক কর্মব্যস্ততা। ভৌগলিক দূরত্বকে ছাপিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ব্যস্ত জীবনে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও এর ব্যতিক্রম নন।প্রবাসের হাজারো কর্মব্যস্ততা প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে সারা বছর জুড়ে মুখিয়ে থাকে বৈশাখী মেলার জন্য। কমিউনিটির উৎসবকে ঘিরে এখানকার স্থানীয় সরকার ঘোষিত কোনো ছুটি থাকে না, তাই এপ্রিলের কোনো এক ছুটির দিনে সিডনিতে বৈশাখী মেলা বসে।এই ধারাবাহিকতায় গত ১৩.০৫.২০১৭ইং শনিবার এবারও সিডনিতে উদযাপিত হয়েছে বৈশাখী মেলা। মেলা উদযাপিত হয়েছে এএনজেড স্টেডিয়াম, অলিম্পিক পার্কে। এটি সিডনির সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল ভেন্যু, যার দর্শক ধারণক্ষমতা প্রায় ৮৩ হাজার। প্রায় সারা বছরই ভেন্যু’টিতে কোন না কোন উৎসব/কনসার্ট বা শো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে অলিম্পিক পার্কের বিভিন্ন স্টেডিয়ামগুলোতে।অস্ট্রেলিয়া মূলত খ্রিষ্টান প্রধান দেশ, এ সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ‘ইস্টার’। আর এই ইস্টার কে ঘিরে অস্ট্রেলিয়ানরা মাস ব্যাপী নানান উৎসব/ শো’য়ের আয়োজন করে থাকে। সব’চে বড় ও ব্যাপক পরিসরে ইস্টার শো অনুষ্ঠিত হয় অলিম্পিক পার্কের স্টেডিয়ামগুলোতে।যথারীতি এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি।ভেন্যু সংকটের কারনে তাই এবারের বৈশাখী মেলা এপ্রিলে করার পরিবর্তে মে মাসে করার সিদ্ধান্ত নেন মেলার আয়োজক কমিটি।
সকাল থেকে রাত অবধি এ মেলার আয়োজন করা হয়েছিল। দিনের শুরুতে সিডনির নীল আকাশে ঝকঝকে রোদ ছিল। দুপুর ১২ টায় মঙ্গল শোভা যাত্রার মধ্য দিয়ে মেলা শুরু হয়। তুলনামূলকভাবে দুপুরের দিকে লোকসমাগম কিছুটা কম হলেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলে মেলায় আগতদের আনাগোনা। উল্লেখ্য,পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণের দিন যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে,অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালিরাও এ বছর যুক্ত হল এ শোভা যাত্রায়।বাংলাদেশের আদলে মঙ্গল শোভাযাত্রা সিডনিতে এই প্রথম।আড়ম্বরপূর্ণভাবে বহুলোকের একত্রে আনন্দ মিছিল মানেই শোভা যাত্রা। চিত্র, মুখোশ আর প্রতীকে নানান রঙ ও তুলির আঁচড়ে তুলে ধরা হয় বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিক ৷ গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে মুখোশ, ঘোড়া, কুলোয় আঁকা আল্পনা তৈরিতে সাহায্য করছে চট্টগ্রামের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা।বাঙালি ঐতিহ্যের বার্তা ও সংস্কৃতির প্রতীক প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা’র অনন্য সাক্ষী হয়ে রইল সিডনির এএনজেড স্টেডিয়াম।
দুপুর থেকেই আধখোলা স্টলে ক্রেতারা জিনিসপত্র দেখছিলেন। মেলায় দোকানিদের হাঁকডাক সেইসঙ্গে দরদাম-কেনাকাটা সব মিলেই যেন ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে চলছিল বিরক্তিহীন মধুর সম্পর্ক। শাড়ি, সালোয়ার, কামিজ, জুয়েলারি, কসমেটিক, বই, সিডি, ক্রোকারিজ এবং বাংলাদেশি বিভিন্ন খাবার, পিঠার দোকান ছিল। মেয়েদের শাড়ি, সালোয়ার, কামিজ, জুয়েলারি, কসমেটিকের দোকানগুলোতে ছিল উপচে পরা ভিড়। পাশাপাশি খাবারের দোকানেও।
অস্ট্রেলিয়াতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার, বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল, অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি শেখ শামীমুল হক, সংগঠনটির অন্যান্য কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রতিনিধি, বিরোধীদলীয় প্রধান, রাজ্য সরকার, স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যক্তিত্বসহ অনেকেই এ মেলায় যোগ দেন।
বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়াতে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে কৃতি ও গুণীজনকে উক্ত সংগঠনটি ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড’ দিয়ে আসছে প্রতি বছর। শিশু চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এ বছর এই পদকটি দেওয়া হয়েছে সিডনির চিলড্রেন হসপিটালকে।এটি অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার একটি হসপিটাল। সংগঠনটির সভাপতি শেখ শামিমুল হক – জানান টিকিট বিক্রির টাকা দিয়ে সব ধরনের খরচ ছাড়াও বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে তারা অনুদান দিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য, সংগঠনটি প্রথম অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু কাউন্সিলের প্রথম সভাপতি প্রয়াত গাজী রুহুল হক উজ্জ্বলকে। পরে শিক্ষায় অধ্যাপক আজাদ, সিডনি অলিম্পিক পার্ক অথোরিটি, ভারতীয় বাঙালি চিকিৎসক বিশ্বনাথ, অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চিলড্রেন ফার্স্ট ফাউন্ডেশনসহ উল্লেখযোগ্য কৃতি ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে।ভারতীয় বাঙালি চিকিৎসক বিশ্বনাথ ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাবস্থায় রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধে আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাশুশ্রুষা করেন। এর কিছুদিন পরে তিনি অভিবাসী ভিসায় অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে চলে আসেন এবং পরে বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন। আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চিলড্রেন ফার্স্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের বেশ কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতার পাশাপাশি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা মাথা জোড়া লাগানো শিশু কৃষ্ণা ও তৃষ্ণার চিকিৎসার ব্যয় বহন করেছিল।
আয়োজকদের মতে – ভারত ও বাংলাদেশের বাইরে সবচেয়ে বড় বাঙালি সমাবেশ এই বৈশাখী মেলা !
অস্ট্রেলিয়ার বাঙালি কমিউনিটির বৃহত্তম উৎসবের আয়োজক হিসেবে নিজেদের দাবী করেন তাঁরা। বিগত দিনের ধারাবাহিকতায় তাঁরা অনুমান করছেন প্রবাসী বাংলাদেশিসহ স্থানীয় অন্যান্য কমিউনিটির প্রায় ২০ হাজার লোকের সমাবেশ ঘটেছিল সিডনির এই মেলায়।সমাজ-সংস্কৃতি কেন্দ্রিক ঐতিহ্যময় এই বৈশাখ হাজার তারার বাতি জ্বালিয়ে দেয় আমাদের বাঙালিপনায়। এ উৎসবকে ঘিরে ও একে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিতেও বর্ধিত মাত্রার কার্যকর অবদান যুক্ত করা সম্ভব। তাদের এ ধরনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসব ও অর্থনীতি একই সঙ্গে সমান পৃষ্ঠপোষকতা পেতে পারে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চের জন্য মাঠের মধ্য স্থানটিকেই নির্বাচন করা হয়েছে।ছিল বাংলাদেশি গান,নাচ, কবিতা আবৃত্তির আসর আর সমসাময়িক বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে ফ্যাশন শো।স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন পথ প্রোডাকশন প্রযোজিত থিয়েটেরিক্যাল ড্রামা ‘অ্যাই এম দ্যা ফাদার’ মঞ্চ নাটকে অংশ গ্রহণ করেন স্থানীয় বাংলাদেশী শিল্পীবৃন্দ l নাটকটি রচিত হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু’-কে ঘিরে। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেন বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম মেধাবী নায়ক আরেফিন শুভ। পুরুনু দিনের বাংলা ছায়াছবির গান গেয়ে শ্রোতা-দর্শকদের হৃদয়ে ঝড় তুলেছেন বাংলাদেশের নন্দিত জনপ্রিয় গায়ক এন্ড্রু কিশোর।
সবশেষে প্রতি বছর চোখ ধাঁধানো ব্যয়বহুল আতসবাজির আয়োজন করা হতো। এ বার মেলার আনন্দে ভিন্ন মাত্রা যোগ করতেই আয়োজন করা হয়েছিল মনোমুগ্ধকর রঙ বেরঙের আলো-আঁধারের খেলা, দৃষ্টিনন্দন লেজার শো’র।
খোলা আকাশের নিচে দর্শক গ্যালারিতে বাঙালির বৈশাখের আনন্দ সংগীতের মূর্ছনা আমন্ত্রিত অতিথিদেরকে মুগ্ধ করেছিলো সেদিন।বছর জুড়ে মুখিয়ে থাকা প্রবাসী বাঙালি, অনেক সংগঠক, সংস্কৃতি কর্মী ও দেশপ্রেমিকদের কাছে মনে হয়েছিলো, এইভাবে বাঙালির প্রাণের নব বর্ষ ও বৈশাখকে প্রাণের আলিঙ্গনে বেঁধে নিয়ে প্রবাসীরা হয়ে উঠবে পরস্পরের জন্য।সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে প্রতিবছরই উদযাপিত হবে বৈশাখ, বাঙালী সংস্কৃতির প্রাণ প্রবাহে প্রতিবছরই সঞ্চারণ ঘটিয়ে প্রাণ স্পন্দনের। মানুষের মেলবন্ধন রচনার দিক দর্শনও এই বাঙালীত্ব – যা যুগে যুগে কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে প্রশান্ত পাড়ের মানুষের মনে!
হ্যাপি রহমান, সিডনি-অস্ট্রেলিয়া, ১৬.০৫.২০১৭ইং
ফটোঃ সংগৃহীত
Related Articles
Environmental Citizen of the Year Award
Community volunteer Dr Swapan Paul was given the inaugural Environmental Citizen 2018 Award by the City of Parramatta council. This
ওদের কি দেশে ফেরা হবে না?
গত ডিসেম্বর মাসেই তঁার বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ছিল। আমাদের এক বন্ধুর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একজন অধ্যাপক বাংলাদেশ থেকে কিছু ছাত্রছাত্রীকে তঁার