পরবাসে মায়ের ঘ্রাণ
সিডনি সিটির একটা পাঁচতারা হোটেলে চাকরি করি। হোটেলের চারদিকে স্বচ্ছ কাচের জানালা। উত্তর দিকে দেখা যায় পার্ক হায়াত, হারবার ব্রিজ, অপেরা হাউস আর নদীর বুকে ছোট-বড় অসংখ্য জাহাজের আসা-যাওয়া। অস্থির জলে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে গাঙচিলের বিহার। ব্যস্ততার ফাঁকে হঠাৎ সেদিকে চোখ পড়তেই দৃষ্টি হিম হয়ে আসে। স্নিগ্ধ সুন্দর পাখিগুলো যেন শান্তির মতো। মনটা কেমন করে ওঠে। কাকে যেন মনে পড়ে। যেখানে একদিন অনেক আদর ছিল। ছিল ওই নীল দিগন্ত আকাশের মতো ভালোবাসা।
দক্ষিণ দিকে তাকাতেই সবকিছু ছাপিয়ে বেশি চোখে পড়ে সিডনি বিমানবন্দর। ছোট-বড় অসংখ্য বিমানের ওঠা-নামা। উড়ন্ত বিমানগুলো ছোট হতে হতে একসময় হেঁয়ালি মনের মতো ওই দিগন্তে হারিয়ে যায়। ঠিক তখনই খুব বেশি মনে পড়ে দেশের কথা। ফেলে আসা ওই মায়াবী সুন্দর দিনগুলোর কথা। বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাওয়া সর্পিল মেঠো পথ। শীতের সকালে দুর্বা ঘাসের ওপর সূর্য কণার হাসি। বাড়ির পাশের সরষে ফুলে মৌমাছির মাখামাখি। মৃদু বাতাসে সরষে ফুলের সে কী সুবাস। আজ সবই স্মৃতি হয়ে ভাসে। তাই দক্ষিণ দিকে যখনই যাই, ইচ্ছে করেই বিমানবন্দরের দিকে তাকাই না। কষ্টে বুকটা কেমন করে ওঠে। অনেকক্ষণ মনটা আর সহজ হয় না।
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় হোটেল এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, শতভাগ ওক্যুপাইড থাকে। কাজের চাপে দিশেহারা। টানা ষোলো দিন ধরে সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করে চলেছি। একটা দিন ছুটির জন্য শরীরটা দোহাই দিচ্ছে। অথচ কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েকবার অনুরোধ করেও কোনো সাড়া পাচ্ছি না। এসব শোনার সময়ই যেন কারও নেই। গ্রীষ্মের এই ছুটির সময়টা ভালো করে খেটে কিছু ডলার জমাতে না পারলে পরবর্তী সেমিস্টারগুলোয় টিউশন ফি নিয়েও পড়তে হয় বিপদে। ওদিকে দেশে মা–বাবা, আত্মীয়স্বজনকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করতে হয়। পাহাড়ের মতো ঋণের বোঝা। ভরসা একটাই, নিরন্তর খাটতে থাকলে একদিন হয়তো কুলের নাগাল পাবই।
তিন বন্ধু মিলে একটা দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটে থাকি। ওরা দুজন এক রুম নিয়ে থাকে। একসঙ্গে রান্না করে। খায়। এর মধ্যে আমি থাকি এক রুম নিয়ে। আর আমার সবকিছু আলাদা। তাই ভাড়া বেশি। খরচ কমাতে শেয়ার রুমে থাকতে চেষ্টা করেও পারিনি। ঘুমাতে পারি না। অসহ্য লাগে। একা এক রুমে থাকার স্বাধীনতাই আলাদা। যখন ইচ্ছে হয় দরজা বন্ধ করে সারা রাত পড়ি। কখনো আবার সারা দিন ঘুমাই। শেয়ার রুমে এসব অসম্ভব। কারণ, নিয়ম মেনে চলতে পারি না। মাথায় কোনো চাপও নিতে পারি না। ইচ্ছে হলে খাই, না হলে খাই না। যেদিকে খুশি চলে যাই। যতক্ষণ ইচ্ছা সাগরপাড়ে বসে থাকি। জীবনানন্দের কবিতা পড়ি। কখনো গান শুনি। নিজের মনটাকে সময় দিই। নইলে ভালো লাগে না। বাসার দেয়ালে টানানো রুটিন মেনে নির্ধারিত দিনে বাজারে যাওয়া, রান্না করা। আমার এসব হওয়ার নয়। চেষ্টা করেও জীবনটাকে ওই সব সোশ্যাল নিয়মের ভেতর আনতে পারি না।
প্রতিদিনই রাতে ঘুমানোর আগে মোবাইলে সকাল ছয়টায় অ্যালার্ম সেট করে ঘুমাই। গত রাতে ডিনার শেষে ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে ল্যাপটপে পত্রিকা পড়ছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল ছিল না। ঘুম থেকে জেগে দেখি সকাল ছয়টা পঞ্চাশ বাজে। কী সর্বনাশা কাল! যা হোক, সঙ্গে সঙ্গে টেক্সট করে ম্যানেজারকে জানাই যে আজ আমার এক ঘণ্টা দেরি হবে। কোনো রিপ্লাইও আসেনি। হোটেলে এসে দেখি, আজ নাকি অডিট হবে। হেড অফিসের বড় কর্তারা আসবেন। সবাই যে যার মতো দৌড়াচ্ছেন। রীতিমতো পাগলা ঘোড়ার তাণ্ডব যেন চলছে হোটেলজুড়ে।
শুরু হলো পুরোদমে কাজ। এদিক-ওদিক তাকানোর ফুরসত নেই। এভাবেই চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। হঠাৎ একসময় দেখি, পা দুটো আর চেষ্টা করেও সামনে নিতে পারছি না। হাত দুটোও কাঁপতে শুরু করেছে। যে জিনিসটাই হাতে নিচ্ছি, কেবল পড়ে যাচ্ছে। দৃষ্টিও আর স্বাভাবিক নেই। একটা জিনিসকে ছায়ার মতো যেন দুটো দেখছি। করিডরের একপ্রান্তে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি বেলা সাড়ে তিনটা বাজে। কী হলো আমার? হঠাৎ শরীরটা এমন লাগছে কেন? তখনই মনে পড়ল, এ কী, আমি তো এখনো নাশতাই করিনি।
পাশ দিয়ে এক কলিগ যাচ্ছিল। ক্যানটিনে আজ খাবার কী কী আছে জানতে চাইলে বলল, আজ তো রোববার। ক্যানটিন দুপুর বারোটায় বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর আমার দিকে বার দুই তাকিয়ে বলল, তুমি কি অসুস্থ?
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চান্দপুর হাইস্কুল
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চান্দপুর হাইস্কুল
বললাম, না। তেমন কিছু না। আমাকে এক বোতল পানি দিতে পারো, প্লিজ।
সঙ্গে সঙ্গেই সে পানি এনে দিল। আস্তে আস্তে পানিটুকু খেয়ে দেখি, সে তখনো আমার পাশে দাঁড়িয়ে। বললাম, আমি ভালো হয়ে যাব। তবে আরও কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে হবে।
—ঠিক আছে। কোনো দরকার পড়লে আমাকে ডেকো। আমি এ ফ্লোরেই আছি।
আচ্ছা ডাকব। হেড অফিসের লোকজন কি চলে গেছে?
—হ্যাঁ। মিনিট দশ হয় ওরা সবাই চলে গেছে।
বুকে যেন প্রাণ ফিরে এল। তবে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছি না। ঠিক এ সময় মনের অজান্তেই হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল সিডনি বিমানবন্দরের দিকে।
বৈকালিক তির্যক আলোয় উজ্জ্বল বিমানগুলো রানওয়ে থেকে উড়ে দূর দেশের উদ্দেশে মিলিয়ে যাচ্ছে। ফেলে আসা দিনগুলোর নানান স্মৃতির ভেতর মেঘাচ্ছন্ন আকাশে হঠাৎ চাঁদ উঁকি দেওয়ার মতো মনে পড়ল একটা দিনের কথা।
তখন আমি বিএসএস ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে আছি। হেড স্যারের অনুরোধে স্থানীয় হাইস্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করতে হয়েছিল। সেদিন দশম শ্রেণিতে ইংলিশ সেকেন্ড পেপার ক্লাস নিচ্ছি। তখন দুপুর প্রায় বারোটা। হঠাৎ শিশুকণ্ঠে ডাক, কাকা!
চোখ ফিরিয়ে দেখি, শ্রেণিকক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির ছয়-সাত বছর বয়সী আমার এক ভাতিজা।
সাকিম, কী হলো, তুমি এখানে!
—কাকা, দাদু কানতেছে। আপনেরে এখন বাড়ি যাইতে কইছে।
আমি অবাক হয়ে সাকিমের দিকে চেয়ে আছি। মা আজ ভোরেই পাশের এলাকায় আমার এক ফুফুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। এতক্ষণে হয়তো বাড়ি ফিরেছেন। তবে কান্নাকাটি কেন?
—কাকা, আপনি নাশতা না কইরা স্কুলে আসছেন। দাদু বাড়ি এসে শুনেই কান্না শুরু করছে। আমারে বলছে আপনেরে নিয়া বাড়ি যেতে।
হ্যাঁ। তাই তো। ভাবি তখন বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত। আমি নীরবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। কিছু খাওয়ার কথা একেবারেই ভুলে গেছি। ক্লাসটা শেষ করে হেড সারকে ঘটনাটা বললাম।
স্যার হাসতে হাসতে বললেন, ও আচ্ছা। তুমি সকালে নাশতা না করেই স্কুলে চলে এসেছ। মায়ের ছোট ছেলে বুঝি কখনো আর বড় হয় না। তাই না?
মনে মনে ভাবি, আচ্ছা আমি এমন কেন? আমার এই বেখেয়ালির জন্য ওদিকে মা কষ্ট পাচ্ছেন। চোখ তুলে দেখি, স্যার আমার দিকে তাকিয়ে তখনো মৃদু হাসছেন। এরপর বললেন, এই যে মায়ের ছোট ছেলে। যাও। বাড়ি গিয়ে খেয়ে এসো।
আসার পথে সাকিম বলল, কাকা, দাদু কেঁদে কেঁদে বলছে, দাদু মরে গেলে আপনের অবস্থা কী হবে? কে দেখবে আপনাকে? আরও কত কথা।
বাড়িতে এসে দেখি, মা আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে আসতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপা কান্নায় বেশ কিছুক্ষণ আর কথাই বলতে পারলেন না। খাওয়া শেষে আবার যখন স্কুলের উদ্দেশে বের হই, আঙিনায় এসে মা আপন মনেই বললেন, আহা, আমার এই ছেলের কী হবে উপায়?
সেদিন মায়ের পাশে বসে ওই খাওয়ার কথা আজ কেন এত মনে পড়ছে? সেদিন শ্রেণিকক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে সাকিম যখন বলেছিল, তখনই খেয়াল হয়। এখনো নাশতা করা হয়নি আমার। তবে আজ? আজ এই ক্লান্ত বিকেলে আমার শরীর চিৎকার করে জানান দিচ্ছে, আজ কিছুই খাওয়া হয়নি।
সেবার কলেজের গেটে দেখা হয় শান্তা, নিপু আর হ্যাপির সঙ্গে। আজও কেমন মনে পড়ে। আমাকে দেখেই শান্তা বলল, কীরে, ক্লাসে দেখলাম না যে। কোত্থেকে এলি?
আর বলিস না। মা খুব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি করে এলাম। আপা আছে সঙ্গে।
হ্যাপি বলল, এখন তুই কোথায় যাচ্ছিস?
বাড়িতে যাচ্ছি। খাবার আনতে।
আচ্ছা রাখ। খাবার নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। এখন হাসপাতালে চল।
যাওয়ার পথে নিপু বলল, আমার কাছে একবক্স নুডলস আছে। তুই খেয়ে নে।
কী বলিস এসব। তোর লাঞ্চ আমি খাব কেন?
আরে নে খা। যা বলি শোন। আমি বাসায় গিয়ে খাব।
হাসপাতালে মা চার দিন ছিলেন। বন্ধুরা মাকে অনেক সেবা-যত্ন করেছে। কত ধরনের খাবার। কত লোকজন। এসব দেখেই যেন মা সুস্থ হয়ে ওঠেন।
অস্ট্রেলিয়া আসার দিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের হাত ধরে দোয়া চাই। মা শুধু নির্বাক চেয়েই রইলেন। সিঁড়ি পর্যন্ত এসে আবার ফিরে দেখি, মা অঝোরে কাঁদছেন।
এমন আরও কত কী যে মনে পড়ছে। ঠিক তখনই দৃশ্যের ভেতর কী এক অদৃশ্য ইঙ্গিত যেন ভাষাহীন ব্যাপ্তিতে বলে যায়, আহা রে অবুঝ ছেলে। এই পরবাসে অসংখ্য নারীর মাঝে কেউ তোমার মা নয়। খালাম্মা, ফুফু কিংবা মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে খেতে দেওয়া বড় বোন নয়। মাকে হাসপাতালে রেখে বাসায় খাবার আনতে যাওয়ার পথে কলেজ গেটে দেখা হওয়া ওই বান্ধবীও নয়। এই পরবাসে ক্যারিয়ার আর ডলারের স্তূপের ভেতর তুমি কারও নও। এখানে কারও অনুভূতিতেই তুমি আর ওইভাবে বিরাজিত নও। তোমার এ বেখেয়ালি জীবন নিয়ে কেউ ভাবে না এখানে। তুমি এখানে শুধুই পরবাসী।
Related Articles
সুপার ফুড ও কালোজিরা কাহিনী
দিলরুবা শাহানা: সুপার ফুড নামে নয় তবে বড়দের মতে দারুন উপকারী খাবার অনেক আগেও ছিল । ছোটদেরকে অনেক কষ্ট করে
BAAWA ACP 2017 – আনন্দধারা
আমাদের ছোট্ট এ জীবনে বিভিন্ন রকম ব্যস্ততায় ভরা সময় গুলির মাঝে সুখ আনন্দ উপভোগের সুযোগ কতটা তা আর বলার অপেখ্খা
মায়ের দোয়া
ভাত খেতে বসেছি। আম্মা জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই এতো শুকাইছস ক্যামনে?’ আমি বললাম, ‘টের পান কিছু? প্রত্যেক দিন কয় কিলোমিটার সাইকেল