আমি, বাবা আর আমার সরোদ

কিছু কথা লিখবো বলে ভাবছিলাম কিছুদিন ধরে , নিজেকে নিয়েই। আমার মিউজিক নিয়ে , আমার সরোদ নিয়ে। গত কিছুদিন ধরে বেশ ব্যস্ততা যাচ্ছে অ্যালবাম , গান , কম্পোসিশন , সরোদ নিয়ে। বিদেশ থেকেও দেশের সাথে যোগাযোগ রেখে দারুন ভাবে কাজ করছি আমি কিছু খুব ভালো মানুষদের সহযোগিতা পাচ্ছি বলে।
আজকে ভাবছি একটু অতীতে ফিরে যাই , কোথা থেকে আমার এসবের শুরু …..অনেকেই জানে , অনেকেই জানেনা।
তবে কম বেশি সবাই জানে আমি কোন সংগীত পরিবার থেকে এসেছি, যেখানে সবাই কথা বলতে শিখবার আগে গান করে , যন্ত্র ধরে , সুর নিয়ে থাকে। এমন একজন নেই আমাদের ১৭০ বছরের সংগীতের ইতিহাসের পরিবারে, যার গলাতে সুর নেই । আশ্চর্য্য লাগে শুনতে হয়তো , কিন্তু এটাই সত্যি। কিন্তু আমার শুরু টা কেমন ছিল ? আজ সরোদ বাজাচ্ছি , গান গাইছি , কম্পোজিশন করছি …এটা সবার কাছে স্বাভাবিক মনে হয় , কিন্তু আসলেই কি এতো সহজে সব হলো ?
আমার কথা বলবার আগে একটু বাবার কথা বলতে হবে । দাদু উস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেব খুব চাইতেন বাবা শুধু সুর নিয়ে থাকবেন না , বাবা দারুন ভাবে লেখা পড়া করবেন , চাকরি করবেন । বাবার দুই অগ্রজ উস্তাদ আবেদ হোসেন খান ও উস্তাদ বাহাদুর খান ততদিনে সংগীতকে ধ্যান জ্ঞান হিসেবে নিয়ে নিয়েছেন । বাবার তখন বছর ৬ বয়স । তাঁর দুই অগ্রজের বয়স ১২ আর ১০ । তখন কুমিল্লার বাড়িতে ওনারা থাকেন । প্রতি সন্ধ্যা তে দাদু সব ছেলেমেয়ে কে নিয়ে কণ্ঠ সাধনাতে বসতেন , ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু বাবা । বাবা কে পড়াশুনা নিয়েই থাকতে হতো । আবার রাতে যখন সবাই স্কুলের পড়া করত , তখন যদি ইলেকট্রিসিটি চলে যেত , তাহলে একটা মাত্র যে হারিকেনটা ছিল সেটা নিয়ে বাবা পড়াটা চালিয়েই যেতেন , আর দুই অগ্রজ সরোদ নিয়ে বসে যেতেন । এভাবে দাদু বাবার মধ্যে পড়াশুনাটা নেশার মতো ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন , যেটা আমাদের পরিবারে একদমই নতুন একটা ব্যপার ছিল ।
তো এই পড়াশুনার নেশাটা বাবার মাঝে এমন ভাবে ঢুকে গিয়েছিলো যে রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়তো , তখন বাবা বাড়ির ঠিক সামনের ল্যাম্প পোস্ট এর নিচে ফুটপাথে বসে বই পড়তেন ….যেসময়ে তাঁর অগ্রজ দুই দাদা যন্ত্র নিয়ে রেয়াজ করতেন ।
বাবা যখন পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন , তখন ওনাকে দেখতে দুরদুরান্ত থেকে লোকেরা এসেছিলেন , গ্রামের বাড়িতে ……
এই পড়াশুনা বাবা শেষ করেন ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৬০ সালে মাস্টার্স পাশ করে । আমাদের পরিবারের প্রথম গ্রাজুয়েট । চৌদ্দ গুষ্টিতে প্রথম গ্রাজুয়েট । এরপরে কর্ম জীবন । উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি জীবন শেষ করেন ২০০৬ সালে ….এর পুরো সময়টা সংগীত ছিল শখের বসে । বাবা একসময় ফিল্মে চেলো বাজিয়েছেন , রেডিও টিভি তে সুরবাহার বাজিয়েছেন ।
আর আমার মা ফওজিয়া ইয়াসমিন ৬০ এর দশকের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও ছেলেমেয়ের পড়াশুনার কারণে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়েছিলেন ।
এমন মা বাবার ছেলেমেয়ে হিসেবে আমরা যে সংগীত কে প্রফেশন হিসেবে নেবো না এটাই কি স্বাভাবিক না ? আমাদের বাড়িতে কখনোই গান বাজনার আসর বসেনি, কখনোই বাবাকে আমি রেয়াজ করতে দেখিনি , বরং দেখেছি সারাটা ক্ষন বই পড়তে আর লেখালেখি নিয়ে থাকতে ।
তাই আমাদের হাতে খড়ি হলো বইয়ের সাথেই , সংগীতের সাথে না ।
মা দরজা জানলা বন্ধ করে প্রতিদিন সকালে রেয়াজটা চালিয়ে যেতেন , তাই ওই ১ টা ঘন্টাই ছিল সংগীতের সাথে আমাদের পরিচয় । আমি তখন মার কোলে শুয়ে থাকতাম , যখন মা হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধতেন ।
আমি অনেক দিন পর্যন্ত জানতামই না আমাদের বাবার দিকে যে সংগীতে এতো মারাত্নক গভীরতা । বাবা মা কেউ এগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন না …কারণ পড়াটা ছিল খুব বেশি ইম্পরট্যান্ট ।
আরেকটা কথা বলি , আমাদের পারিবারিক টাইটেল হলো ‘খান’ , যেটা গত ৯ জেনেরেশন ধরে চলছে . অথচ আমার পরিষ্কার মনে আছে আমি যখন স্কুলে admission নেই তখন আমার নাম ছিল তানিম হায়াত , আমার বড় বোন রীনাত ফওজিয়া আর আমার বড় ভাই তারিফ হায়াত । আমাদের নামে খান ছিল না, কারণ বাবা বলেছিলেন, “ওদের নামে ‘খান’ থাকবে না । এভাবে পারিবারিক সংগীতের আবহ থেকে বেরিয়ে আসবে ওরা আর ওদের পরবর্তী জেনারেশন আর হয়তো জানবার দরকারই হবে না যে সংগীত তাদের পূর্বপুরুষের একমাত্র প্রফেশন ছিল” ।
জানিনা বাবার এই অভিমান কেন ছিল …..
যাহোক , শেষ পর্যন্ত ‘খান ‘ এলো , আমি ক্লাস ফোর-এ পড়ার সময়ে , ততদিনে আমার বড় ভাই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরী – তার নামে খান লাগলো ১৪ বছর বয়সে গিয়ে ।
আর আমার বড় বোন ‘খান’ ছাড়াই থেকে গেলেন সারাজীবন ।
কিন্তু এতো কিছুর পরেও রক্তের ধারা কি আটকে রাখা যায় ? না , এখনো আমার কথা না । আমার বোনের কথা । কখন যে লুকিয়ে লুকিয়ে সেতার বাজানো শুরু করেছে , আমার কেউ জানতামই না , মা বাবা তো নয়ই । আপু তখন ক্লাস টেনে । আপুর ইন্টারেস্টের কাছে হার মেনে নিলেন বাবা মা। আমার বোনের সেতারে হাতে খড়ি হয়ে গেলো আমাদের জ্যাঠাতো ভাই উস্তাদ শাহাদত হোসেন খানের কাছে । পরবর্তীতে দীর্ঘ দিন তালিম নেন আমাদের ফুফাতো ভাই উস্তাদ খুরশিদ খানের কাছে । এসবের শুরু ১৯৮২ সালে । তখন আমার মধ্যে সংগীতের কিছুই নেই । জোর করে কিছু দিন তবলা শিখলাম ১৯৮৯ এ । সেটা ছাড়তেও সময় লাগলো না । এরপর ১৯৯১ থেকে গিটার শেখা শুরু করলাম , bass গিটার শিখলাম । গলা দিয়ে ফাঁটা বাঁশের মতো আওয়াজ বের হতো , তাই দিয়ে চিৎকার করে গান গাইবার চেষ্টা করতাম । শুদ্ধ সংগীতের ধারে কাছেও নেই আমি ….তান কি , বিস্তার কি , গৎ কি , তেহাই কি কিছুই জানিনা ……
এর মাঝে ১৯৯৬ সালে বাড়ি বদলিয়ে আমাদের বড় জ্যাঠা উস্তাদ আবেদ হোসেন খান সাহেবের বাড়ির পাশে চলে আসলাম । একদম পাশাপাশি বাড়ি । জানলা দিয়ে কথা বলা যায় , এতো কাছে । প্রতিদিন রাতে জ্যাঠাতো দাদা উস্তাদ শাহাদত হোসেন খান রেয়াজ করতেন, আর আমি ভাবতাম ভালোই তো লাগে ! তখন আমি আমার দাদার সমস্ত শো এর যন্ত্রবাহক , একটা নেশা তৈরী হয়ে গিয়েছিলো সরোদ শুনতে শুনতে । এর মাঝে টিভি তে একটা প্রোগ্রাম এ পরিবারের সবাই গেলো । আমিও গেলাম । সবাই ক্লাসিকাল instrument বাজাচ্ছে আর আমি অর্কেস্ট্রা তে একুস্টিক গিটার বাজাচ্ছি । কোনো এক সময় আমার বোন কে বলতে শুনলাম ‘ওকে ক্লাসিকাল এ নিয়ে আসতে পারাটা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ” । এই কথাটা আমার মনে দারুন ভাবে গেঁথে যায় । আমার মনে হয়ে আমার মাঝে পরিবর্তনের শুরুটা এই সময়ে হয় ।
তারপর ১৯৯৯ সাল ……দাদা উস্তাদ শাহাদত হোসেন খানের একটা ছোট্ট সরোদ ছিল , বাচ্চাদের জন্য । আমি যদিও বাচ্চা না তখন – বয়স ২৩ । হাতে তুলে নিলাম সেই ছোট সরোদটা, বাজাতে চেষ্টা করলাম আর কিভাবে যেন সা রে গা মা পা ধা নি সা বাজিয়ে ফেললাম – সুরেই ! উস্তাদজি বললেন , “রাজিত , সরোদ তা ধরে ফেলো ….” সেই ছোট্ট সরোদ দিয়ে যাত্রা শুরু হলো । রাত হয়ে গেলে উস্তাদজী জানালা দিয়ে আমাকে বলতেন এটা বাজাও , ওটা বাজাও, এই পাল্টা বাজাও ওই পাল্টা বাজাও …আর আমিও মনপ্রাণ দিয়ে রেয়াজ করে যাচ্ছিলাম ।
কিন্তু না . আবার ভাটা । বাবার সরাসরি হস্তক্ষেপ । উস্তাদজীর সাথে সব প্রোগ্রাম-এ যাওয়া আর খালি রেওয়াজের ফলে ভার্সিটির রেজাল্ট খারাপ ……বাড়িতে মিটিং …..সব বন্ধ ……
তারপর তো পড়াশুনা শেষ করলাম 3.69 CGPA আউট অফ 4.০০ স্কেল -এ । রেজাল্ট বেশ ভালোই বলতে হবে । এরপর চাকরি তে জয়েন , লম্বা সময় অফিস, তারপর ২০০৩ এ Australia তে চলে আসা …..সব মিলিয়ে বিশাল একটা গ্যাপ । নতুন দেশে সব কিছু মানিয়ে নিয়ে সেটেল হতে হতে আরও ৫ টা বছর কোথা দিয়ে চলে গেলো । শেষ পর্যন্ত ২০০৮ এর মাঝামাঝি গিয়ে আবার ফিরতে পারলাম সরোদের দিকে । তারপরেও প্রতিদিন ১১ ঘন্টা করে অফিস করে সরোদের মিনিমাম একটা লেভেল মেইনটেইন করা আসলে কিন্তু এতটা সহজ না ।
সর্বসাকুল্যে ঠিক মতো সরোদ বাজাচ্ছি মাত্র ৯ বছর । ৪০ বছর সাধনা না করলে এসব ধ্রুপদী যন্ত্র বাজানো যায় না । আমার জীবনে প্রথম ৩৩ বছর হারিয়েই গেছে কিছুই না করে । তারপরেও আজকে আমি যতটুকু বাজাচ্ছি , তাতে আমি খুশি না হলেও একেবারে যে অতৃপ্ত এটা কিন্তু বলবো না । এতো অল্প বিদ্যা নিয়েই পরিবার এবং পরিবারের বাইরে বেশ কিছু মহীরুহের সাথে একসাথে পারফর্ম করবার সুযোগ যে পেয়েছি , সেটা আসলে ওনাদের আমার এই বুড়ো বয়সে সরোদ শিখবার প্রচেষ্টার ভালোবাসারই প্রতিফলন ।
আর বিদেশে থেকে ফুল টাইম প্রফেশনের পাশাপাশি আর দুটো ছেলেমেয়ে কে মানুষ করবার পাশাপাশি এভাবে সরোদ চালিয়ে যাওয়া চেষ্টাটুকু কিন্তু একদমই হত না আমার অর্ধাঙ্গিনী সুমির অভাবনীয় সহযোগিতা ছাড়া…
ওহ আরেকটা কথা , আমার বাবা মা আমাদের কে এমন ভাবে পড়াশুনা করিয়েছেন বলে আমরা তিন ভাইবোন চির কৃতজ্ঞ…..
Related Articles
প্রবাস জীবনঃ সংস্কৃতির চর্চা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক
আমি ২০০৪ সালের মাঝামাঝিতে চাকরী নিয়ে ক্যানবেরা আসি। প্রবাস জীবনে বাংলাদেশীদের সাংস্কৃতিক হালচালের সাথে পরিচয় বলতে যা বুঝায় তার সবটাই
টেলিভিশনে শুনি শুধু সহজ সহজ ভুল
ফজলুল বারী: দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর অনেক আলোচনা কান পেতে শুনি। অনেকে খুব ভালো, বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা করেন। চমৎকার চমৎকার ছেলেমেয়ে টিভি
বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর সাম্প্রতিক হামলা – ক্যানবেরায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি – বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর সাম্প্রতিক হামলা “বাংলাদেশ মাইনরিটি ভয়েস ক্যানবেরা” এবং “স্ট্যান্ড ফর রিলিজিয়াস মাইনরিটিস ইন বাংলাদেশ”-এর যৌথ