বা‌জেট ও কিছু ভাবনা

বা‌জেট ও কিছু ভাবনা

প্রবাস জীবন, প্রায় তিন বছর হতে চল্ল। মানুষ যেমন প্রিয়জনের কাছ থেকে দুরে গেলে বেশি কষ্ট পায়, দেশ থেকে দুরে থাকলেও সেই একই অনূভ’তি। দেশে জাতীয় সংগীত শুনে কখনও কেঁদেছি বলে মনে পড়ে না। এই প্রবাসে, কোথাও জাতীয় সংগীত বেজে উঠলে, চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ে। বিশেষ করে, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে/ আমি নয়ন জলে ভাসি’ এই লাইনটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে আর সহ¯্র ঢেউ এসে যেন আছড়ে পড়ে চোখের কোলে। যাইহোক, আমার মত অনেকেরই হয়ত এমনটা হয়ে থাকে। নানা কারণে দেশের চেহারা মলিন থেকে মলিনতর। শতশত ইস্যু, কোনটা রেখে, কোনটা ধরবেন!

সম্প্রতি, মানণীয় অর্থমন্ত্রী ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন। অর্থমন্ত্রীর মতে, এ যাবৎ পেশ করা বাজেটের মধ্যে, এটা নাকি, সর্ব বৃহৎ ও সর্বোতকৃষ্ট (ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ১৭ জুন ২০১৭)। উনার এই দাবী নিঃসন্দেহে আশাজাগানিয়া। তবে, দেশের জনগণ যারা দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করেন, কিংবা দরিদ্রসীমার কিছুটা ওপরে বা কাছাকাছি বসবাস করেন তারা, বাজেট বড় হইল না সর্বোতকৃষ্ট হইলো সে বিষয়ে খুব একটা খোজ খবর রাখেন না। জিডিপি বিষয়ে তাদের ধারণা অনেকটা এরকম যে, এটা খায় না মাথায় দেয়! গোছের। তারা কেবল বোঝেন, চালের দাম, আটার দাম বাড়ল না কমল। তেলের দাম বাড়বে না কমবে। বাজেটের মাপকাঠি তাদের কাছে খুবই সাধারণ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের মূল্যের উঠানামার মধ্যে আটকে আছে এখনও। বাংলাদেশে চালের উৎপাদন ও ভোগে ঘাটতি রয়েছে। ইতোমধ্যে, মোটা চালের মূল্য বেড়ে কেজিতে ৪৮ টাকা হয়েছে যা ২০১৬ সালে ছিল ৩৮ টাকা। রোজার মাস এবং আসন্ন ঈদ উপলক্ষে চালের মূল্যের উর্দ্ধগতি। এছাড়া বন্যার কারণে ফসল ডুবি হওয়ায়, সরকারকে রপ্তানী নির্ভর হতে হয়েছে। যদিও প্রতিবছর চালের ঘাটতি লক্ষনীয়। এক পরিসংখ্যানে (চালের মিলের হিসাব অনুসারে) দেখা যায় ২০১৩-১৪ সালে ৩৪৩৯০ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয় যেখানে ৩৪৯০০ হাজার মেট্রিক টন চাল ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ ৬১০ মেট্রিক টন চালের ঘাটতি দেখা দেয় (ফরেন এগ্রিকালচারাল সার্ভিস, জুন ২০১৭)।  অন্যদিকে, ২০১৭-১৮ সালে ৩৪,৭০০ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয় কিন্তু ৩৫,০০০ হাজার মেট্রিক টন চাল ভোগ করা হয় (ফরেন এগ্রিকালচারাল সার্ভিস, জুন ২০১৭)। ঘাটতি চাল সরকার ভারত, ভিয়েতনামসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানী করে। যাইহোক, মাছে-ভাতে বাঙ্গালীর মাছ কেনার সামর্থ কমে আসছে অনেকটাই। শুধু চাল ঘরে থাকলে মরিচ দিয়েও তারা ভাত খেতে পারে, যদিও মরিচের দাম খুব একটা কম নয়।

বাজার ব্যবস্থাপনায় আমরা অতিশয় দূর্বল। নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। ফলে, দামের অনাচার বহুকালের। সেইসাথে মূল্যস্ফীতি, জিনিষপত্রের মূল্য বৃদ্ধিতে অন্যতম ভ’মিকা রাখে। প্রায়ই লোকে-মুখে শোনা যায় আগেই ভাল ছিলাম কারণ সবকিছুর দাম কম ছিল, মানুষ কম ছিল। যতদিন সামনে এগুচ্ছে ততই জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়ছে। যে হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে সে হারে আয় বৃদ্ধি না হওয়ায় মূল্য বৃদ্ধির বোঝার ভার সইতে পারা মুশকিল নি¤œবিত্ত মানুষের পক্ষে। আমরা দেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তি হিসেবে রুপান্তরিত করতে পারি নাই। ফলে, বেকার জনসংখ্যা আমাদের কাছে অন্যতম বোঝা। স্থানীয়ভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের যে নীতিমালা ও বিনিয়োগ দরকার তার আলোকপাত বাজেটে নেই বললেই চলে। অন্যদিকে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রতিবছর বাজেট বৃদ্ধি প্রকারান্তে এটাই প্রমাণ করে যে, দেশে দরিদ্রের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। যদিও উক্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী বাস্তবায়নে সুশাসনের অভাব ভিষণভাবে পরিলক্ষিত।

রাস্তাঘাট উন্নয়ন বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন অবশ্যই জরুরি কিন্তু তা কেবল রাজধানী বা রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ উন্নয়নের লক্ষ্যে হওয়া উচিত নয়। খোদ রাজধানীতে বছরের পর বছর রাস্তা ভাঙ্গা ও মেরামতের কাজ চলতে থাকে। অনেক জেলা শহরের রাস্তা এখনও ভাঙ্গা, মেরামতের কোন উদ্যোগ নেয়া হয় না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবকাঠামোর দিকে নজর দেয়া জরুরি। যোগাযোগ বিষয়ে জনজীবনের দূর্ভোগ নিয়ে টেলিভিশন, সংবাদপত্রেও বছরের পর বছর সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। এতে কর্তৃপক্ষের কোন মাথাব্যথা বা দায়বদ্ধতা আছে বলে মনে হয় না। নাগরিক অধিকার এর বিষয়টা কোনভাবেই আমলে নেয়া হয় না। কেবল ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের গ্রাম ও তার বাড়ির আশপাশের রাস্তা নির্মাণে স্থানীয় বাজেটের বেশিরভাগ অর্থ যাতে বরাদ্দ যাতে না থাকে সে বিষয়ে কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

বাজেটে সাধারণ মানুষের অশগ্রহণ না থাকলেও, এর প্রভাব তাদের জীবনে ষোলআনা। দেশ অনেক এগিয়েছে কিন্তু মানুষের আশা-আকাঙ্খাগুলো আর এগুতে পারে নি। উন্নয়নের সুফল মুষ্টিমেয় মানুষ ভোগ করে। অন্যদিকে, বেশির ভাগ মানুষের জীবন যে তিমিরে ছিল, সেখানেই আটকে রয়। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচেষ্ঠায় তৃণমূল পর্যায়ে বাজেটে জনগণের অংশগ্রহণের সচেতনতার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা খুব একটা সফলতা অর্জন করছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। বাজেট অনেকটা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়।

২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য-আয়ের দেশে পরিণত হবে এমনটাই বলা হচ্ছে, কিন্তু প্রতিটি নাগরিক যাতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অংশীদার হতে পারে তার প্রক্রিয়া কি শুরু হয়েছে? আমরাতো জানি না! জনগণের উন্নয়নে জনগণকে পাশে রাখতে হবে, তথ্য জানাতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার উদাহরণ তৈরি করা জরুরি। একটি মধ্য-আয়ের দেশের নির্দেশক কেবল মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি নয়। মানব উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন গুণগত শিক্ষা, মৌলিক স্বাস্থ্য সেবা, বৈষম্য, লিঙ্গ-সমতা, মানবাধিকার, আইনের শাসন নিশ্চিত করা জরুরি। সেই সাথে জনজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা থাকতে হবে।


Tags assigned to this article:
বাজেট

Place your ads here!

Related Articles

Bangladesh exports to Australia accelerating

Bangladesh exports to Australia in recent years have been impressive. The total value of exports in Australian currency increased from

রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া প্রকাশে বুদ্ধিমান হোন

ফজলুল বারী: শেষ দফার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াতেও কোন রোহিঙ্গা শরণার্থী তাদের দেশে ফেরত যায়নি। অথবা ফেরত যেতে তাদের রাজি করানো যায়নি।

Significance of President Pranab Kumar Mukherjee’s first foreign visit to Dhaka

President Pranab Mukherjee is scheduled to arrive in Dhaka on 4th March for a three-day visit to Bangladesh at the

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment