Breaking News

স্বপ্ন-বিধায়ক (অন্তরা ২)

স্বপ্ন-বিধায়ক (অন্তরা ২)

সাধারনত অপরিচিত নাম্বারের ফোন ধরেনা, অপরিচিত ফোনগুলো মাঝে মধ্যেই খুবই যন্ত্রনাদায়ক হয়, একবার এক ফোন ধরেছিল এরকম সৌদি আরব থেকে জনৈক আলম তার বউ মরিয়মকে খোঁজে । এর পরে ওই লোক প্রতিদিন রাত তিনটায় ফোন দিল টানা দুই সপ্তাহ, নির্যাস পাগল হয়ে গিয়েছিল প্রায় এটা বোঝাতে যে এই নাম্বারে মরিয়ম থাকে না। কি মনে করে ফোন ওঠায় নির্যাস,

“- হ্যালো
– হ্যালো
– হাই, কেমন আছ?
– জি ভালো, কে বলছেন ?
– বলত কে?
– চিনতে পারছিনা…
– উহু বলবোনা..তোমাকে বের করতে হবে….
– আমি তো নাম বলব না, দেখি তুমি পর কিনা
– কে? সাফিনাজ? এতদিন পরে?
– এইটা কে? তোমার গার্লফ্রেন্ড নাকি?
– যা ব্বাবা, আমি তো গেস করতে পারছিনা, একটু হেল্প করা যায় ?
– নাহ যায় না … হি হি…
– হুম বুঝতে পেরেছি তুমি…
– আমার নাম তুমি? হি হি….
– নাহ, তুমি সুনয়না… দেখেছ পেরেছি
– জ্বি পেরেছেন, মেয়েদের নম্বর দিয়ে বেড়ান, না পারলে চলবে কেমনে ?
– না মানে ইয়ে, তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, তুমিই প্রথম যাকে আমি আমার নাম্বার দিয়েছি….
– তাই নাকি? কেনো?

থতমত খেয়ে যায় নির্যাস, এই মেয়ে তো ভালো ত্যাদড়, দেখলে তো মনে হয় শান্তিনিকেতনের সব শান্তি একাই দখল করে বসে আছে

– কেন?
– মানে আমাকেই কেনো দিলে?
– তোমাকে দিতে ইচ্ছে হলো তাই…
– মানে কি ? যাকে ইচ্ছে হবে তাকেই নাম্বার দিতে হবে? আবার বলে ইচ্ছে হলে ফোন কোরো … তুমি তো জিনিস একটা…
– না মানে আমার তোমাকে দেখে মনে হয়েছিলো তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগবে তাই দিয়েছি….
– তো এখন কেমন লাগছে?
– হা হা হা…. তুমিতো পুরাই কার্টুন, থরলি এনজয়িং ইট…
– কার্টুন? আমি কার্টুন? তোমার সাহসতো কম না….
– হা হা হা….
– হাসতেছো কেন !!! আমি কি হাসির কিছু বলেছি? হাসলা কেন …
– হা হা হা “

পাগলের মতো হাসে নির্যাস, এই ওদের শুরু…. এর পর খুব দ্রুতই ভালো বন্ধু হয়ে যায়, প্রতিদিনই কথা হয় । শুধু বন্ধু না, এক এক দিন কথা না হলে অস্বস্তি লাগতে থাকে, ‘রেস্টলেসনেস’ , ‘লাস্টিং’, ‘লঙ্গিং’ -এই সবগুলো শব্দের আক্ষরিক অর্থ বোঝা শুরু করে। সত্যি কথা বলতে ওদের দুজনের মধ্যে একদম কোনো মিল নেই, এই জন্যই প্রতিটি বিষয়ে কথা বলতে বোধহয় এত ভালো লাগে। অপেক্ষা নামক বস্তুটা খুবই অসহ্য ছিল নির্যাসের কাছে।একে অপরের জন্য অপেক্ষা কেমন যেন অতি প্রিয় হয়ে গেলো, কি করে হলো, কেমন করে হলো জানেনা নির্যাস। সব প্রশ্নের উত্তর সব প্রশ্নের উত্তর যে খুঁজতে নেই।

কালকে একটা ঐতিহাসিক রায় হতে যাচ্ছে , সেই ছোটোবেলা থেকে এই রাজাকারগুলোর উপরে রাগ, বাবার কাছে যুদ্ধের গল্প শুনত তন্ময় হয়ে, মা বলেন, ” তুই বাবার কোলে উঠার জন্য পাগল হয়ে থাকতি বাবা অফিস থেকে ফিরলেই | বাবা ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার দাবার খেয়ে টিভির সামনে বসলেই হলো, তুই বাবার কোলে লাফ দিয়ে উঠে বলতি বাবা যুদ্ধের গল্প বলো। গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতিস, সকালে উঠে বলতি বাবা আমার না তিনটা পুলিশ ছিলো ওরা, আর আমি মিলে গুলি করে সব পাকিস্তানি মেরে ফেলেছি। বাবা, আমি বড় হলে আমাকে বন্দুক কিনে দিবা ? আমি রাজাকার মারব…” মা হেসে হেসে বলেন। আজ শুধু পুরনো স্মৃতি মাথায় আসছে, কারনটা ঠিক খুঁজে পেলোনা নির্যাস।

চোখে যত রাজ্যের ঘুম কিন্তু মন চলছে দুরন্ত গতিতে, নাহ মনকে শান্ত করতে হবে, কি করা যায়? একটা স্যুদিং কোনো ইনস্ট্রুমেন্টাল শুনতে পারলে মন্দ হতো না। সিডির কালেকশন হাতড়ে খুঁজে পায় বেস্ট অব জেসন বেকারের রেকর্ডটা। খুব যত্ন করে বানানো, রেইনবো এর কবির ভাইকে অনেক জ্বালিয়ে সিডিটা বানিয়েছিলো। ছেড়ে দিল সিডিটা। গিটার ইনস্ট্রুমেন্টালের একটা আলাদা আবেদন আছে, নিজে গিটার বাঁজায় বলেই হয়ত, ভেসে আসে বেকারের ‘রিভার অফ লঙ্গিং’ …..

বেকারকে এখনকার টুটিফ্রুটি জেনারেশন চেনে না।এই লোকের জীবনটা অদ্ভূত, ৮/৯ বছরেই বাবা/মা, বন্ধু-বান্ধব সবাই বুঝে যান যে বেকার গিটারে একজন চাইল্ড প্রডিজি, ক্লাসিকাল পিয়ানো থেকে বাখ, পানিনি যখন গিটারে তোলা শুরু করলো তখন সবাই অবাক হয়ে যেত। ১৬ বয়সে আমেরিকার টপ ব্যান্ডগুলোর সাথে প্রফেসনালি বাজানো শুরু করে, নিজের সোলো রেকর্ডিং তো করছিলই , হঠাৎ আঘাত আসে এক দুর্লভ নার্ভের রোগের, শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে, শ্লথ হয়ে আসে বাজানোর স্পিড, আস্তে আস্তে মাত্র ২৬ বছর বয়সে নড়াচড়ার ক্ষমতা হারায় জেসন। ওর প্রেয়সী সেরেনা আর বাবা মা সবসময় পাশে ছিলেন, ডাক্তাররা বলেছিলেন বেশিদিন (১২ মাস ) বাঁচবে না ও , কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ও বেঁচে রইলো, শরীরের আর কোনো কিছু নাড়াতে না পারলেও শুধু চোখ নাড়াতে পারতো। ওর বাবা একটা কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্য নিয়ে চোখের নড়াচড়ার একটা ভাষা বের করে ফেললেন, যা দিয়ে জেসন সবার সাথে ভাবের আদানপ্রদান করতে শুরু করলো এবং শুধু তাই না অর মাথার ভেতর যে সুরগুলো খেলা করত প্রফেশনাল মিউজিশিয়ান দিয়ে কম্পোজ করা শুরু করে দিলো, এই লোক চিকিৎসাশাস্ত্রের সব ভবিষ্যতবাণী মিথ্যা প্রমান করে বেঁচে আছে এখনো। সিডি প্লেয়ারে বেকারের মাস্টার পিসগুলো একে একে বাঁজতে থাকে ব্ল্যাক স্টেলিয়ন, এয়ার, সেরেনা, রেইন, এন্ড অব দ্যা বিগিনিং …..নিদ্রাদেবীর আঁচলে ঠাঁই নেয় নির্যাস।

সকালে উঠেই ক্লাস ধরতে দৌড়ায়। ইউনিভার্সিটিতেই ছিলো, ফেইসবুক থেকে খবর পায় নরপিশাচটার রায় হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ৩৪৪ টা মানুষ খুন করে তার সাজা হয়েছে, শুওরটা আবার আদালত থেকে বের হয়ে দেখায় ভিক্টরি সাইন, ছবিটা ফেসবুকে দেখা মাত্র নির্যাসের রক্ত ফুটতে লাগলো, কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না, বেলা গড়াতেই ওর মত সবাই ফুঁসছিল, আবীর, শান্তনু, তানিম, নির্যাস সব জিগরি দোস্ত, ঠিক করলো টিএসসি যাবে, বিপ্লব ভাই, এমরান ভাই উনাদের সাথে দেখা করে কথা বলবে কি করা যায়- সুনয়না ফোন করে এই সময়,

“- তুমি কোথায়?
– ফ্যাকাল্টিতে-তুমি কই?
– আমি ডাসের সামনে, তোমার না আমাকে নিয়ে সুতপা আপুর বাসায় যাবার কথা, উনার নোটগুলা লাগবে, পরীক্ষার কথা খেয়াল আছে?
– ধুর তোমার পরীক্ষা, রায় শুনস?
– কিসের রায়?
– আরে ধুর, কাদের মোল্লার রায়, শুওরের বাচ্চাকে যাবজ্জীবন দিসে…..
– তো? সাজা তো হইসে, তাহলে প্রবলেম কি? এমন টোন নিয়া কথা বলতেসো যেন তোমার যাবজ্জীবন হইসে…হি হি..
– আমি টিএসসি আসতেসি, বড়ভাইদের সাথে কথা বলতে হবে, শালার ভি সাইন দেখে মাথায় রক্ত উঠে গেসে, এরে ফাঁসি দিলোনা? ঘোড়ার আন্ডার জাজমেন্ট হইসে।
– আচ্ছা তুমি আস, তোমাকে একটা ঠান্ডা লাস্যি খাওয়াবো, মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে। আমি ওয়েট করছি। ”

টিএসসি গিয়ে সুনয়নার চেহারাটা দেখা মাত্র মনটা ভালো হয়ে গেলো, বিপ্লব ভাইকে খুঁজতে হলো না বেশি, রহমানের চা এর দোকানে এমরান ভাই উনাকে একসাথে পাওয়া গেল, বললেন কাছাকাছি থাকতে উনারা আলাপ করে ঠিক করছেন কি করা যায়, ছাত্র ইউনিয়ন, আওয়ামী লীগের কিছু বড় ভাইকেও দেখল নির্যাস।
সুনয়না বলল
– কি করবে?
– জানিনা ……..
– জানিনা মানে কি?
– জানিনা মানে জানিনা, দেখি বড় ভাইরা কি করে…
– আমি কি করব?
– কি করবা মানে? আচ্ছা সত্য করে বলত তোমার মেজাজ খারাপ হয় নাই?
– হইসে … কিন্তু মেজাজ খারাপ করে কি রায় চেঞ্জ করতে পারব?
– উই হ্যাভ তো প্রটেস্ট ….
– প্রটেস্ট? কিভাবে? ধুর এই সবে কোনো কাজ হয় নাই হবেও না…. আর তুমি কি করবা? মিছিল? …. তোমার এত্তো এনারজি কই থেকে আসে? ঘরের খেয়ে খালি বনের মোষ তাড়াও, সামনে পরীক্ষা কোনো খবর আছে? ফাইনালটা কে দিবে, তুমি না তোমার এই অতি বিপ্লবী ভাইজানেরা ?
– কি যে বল… পরীক্ষার কথা চিন্তার টাইম নাই, মাই ব্লাড ইস বয়্লিং, কিছু একটা করতেই হবে ছবিটা বার বার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে….তুমি বুজতেসো না….
– বুঝতে চাচ্ছিও না…. ফালতু…

ডাসের সামনের ভাস্কর্যটির সামনে বসে আছে দুইজন, সুনয়না একটা সিংগারা আর একটা লাস্যি নিয়ে সামনে রেখে বলে ” খাও, সকালে নাস্তা করে বের হয়েছিলে ?, আমি জানি খাওনি, এখন ভদ্র বাচ্চার মতো সিংগারা আর এই লাস্যিটা খেয়ে নাও ঝটপট। তোমার সাথে এর পর ঝগড়া করবো।”

নির্যাস নিজের খেয়ালে ব্যস্ত, আনমনে একটা চুমুক দেয়, আসলেও সকালে কিছু না খেয়েই বের হয়ে গেছে বাসা থেকে, এখন বুঝতে পারে ক্ষুধা লেগেছে, গোগ্রাসে সিঙ্গারায় কামড় বসায়। দু’কামড় খেতেই একটা লবঙ্গ পরে দাঁতে, ওর ভাগ্যটাই খারাপ, গরম মশলা সহ্য করতে পারেনা, ওর পাতেই পরে সব চেয়ে বেশি, বাসায় আর কারো পাতে চুল পাওয়া যায় না, ও পাবেই। একবার হোস্টেলের লাঞ্চে ডালের মধ্যে পেয়েছিল তেলাপোকার বাচ্চা, নিজেকে একটু অসহায় লাগে। বলে ” ধুর, আজকে কিছুই ঠিকমত হচ্ছে না, এই দেখো লবঙ্গ, খেতেও দিবেনা। ” সুনয়না খিল খিল করে হেসে দেয়, নির্যাসের বুকের ভেতরে কেমন একটা চাঁপা ব্যাথা টের পায়, হাসলে কাউকে এত্ত সুন্দর লাগাটা ঠিক না, ভাগ্য ভালো লবঙ্গটা দাঁতে কেটেছিল, না হলে এই গোপন সুখ পাওয়া হতো না, মেয়েটাকে এই আকুলতা বুঝতে দেয়া যাবে না। নির্যাস কৃত্রিম বিরক্তি ঝুলিয়ে বলে, ” অন্যের দুঃখে হাসতে হয় না। ” সুনয়না আরো জোরে হেসে ওঠে, নির্যাস চোখ ঘুরিয়ে রোকেয়া হলের দিকে তাকায়।

ছাত্র ইউনিয়নের কিছু মেয়ে জটলা বেঁধে চিৎকার করছে। কিছুটা দূরে বলে ঠিক মত শুনতে পাচ্ছে না কিছুই, শুধু একটু পরপর ‘রাজাকার’ আর ‘মানি না, মানব না’ শব্দগুলো কানে ভেসে আসছে।পুরো ইউনিভার্সিটি জুড়েই কেমন একটা থমথমে ভাব, যেন কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই, যেকোনো সময় কিছু একটা ঘটে যাবে, সামনে পিছনে ডানে বামে সব দিকের আড্ডার বিষয় ওই একটাই। কুখ্যাত জারজটার যাবজ্জীবন আর ভি সাইন, নির্যাসের মাথার ভেতরটা কেমন দপদপ করছে, দু’তিন রাত ঠিকমত না ঘুমানোর ফল- আজকে আবার এই ঘটনা, হঠাৎ কেমন নিস্তেজ হয়ে আসে সারা শরীর, সামনে ঘাসের লনটাতে সটান শুয়ে পরে,কাঁধের ব্যাগটা মাথার নিচে দেয়।
“কি হয়েছে? শুয়ে পরলা কেনো?….”আরে কি ব্যাপার? কথার জবাব দিচ্ছনা কেন?একটু রাতে ঘুমালেও তো পারো, নাহ, ভাবের পাগল গান গায়, কবিতা লিখে… হোয়েন আর ইউ গ্রোইন আপ?”

নির্যাস পাশ ফিরে সুনয়নার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, কিছু বলেনা, শুধু তাকিয়ে থাকে, কিছু বলতে পারেনা, শুধু বুকের ভেতরে আবার সেই ব্যথাটা টের পায় । হঠাৎ দেখে এমরান ভাই লম্বা লম্বা পা ফেলে তার লম্বা লম্বা কোকড়া চুল ঝাকিয়ে একদঙ্গল ছেলে মেয়েকে নিয়ে ডাসের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, নির্যাসকে দেখে হাতের ইশারা করে আসতে বললেন, উঠে দাড়ায় নির্যাস, বসে থাকা সুনয়নার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।

 

(চলবে)



Place your ads here!

Related Articles

২০১৪ সাল হউক , মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের, দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর বৎসর

১.আসলে মেকআপ দিয়ে বাহ্যিক অবস্থা সাময়িকভাবে ঢেকে রাখা যায় , প্রকৃত সত্য সাময়িকভাবে দৃশ্যের আড়ালে রাখা যায় । কিন্তু সব

Abracadabra

CONFLICTS and crises are sometimes shadowed by celebrations. Pahela Baishakh was celebrated with much fervour and enthusiasm in Dhaka and

'ব্লগার' নিহত? – লুৎফর রহমান রিটন

ব্লগিং কোনো পেশা নয়। ব্লগার কোনো পরিচয় নয়। ব্লগিং করে কেউ টাকা পায় না। ব্লগ লিখে আয়-রোজগার হয় না। নানান

No comments

Write a comment
No Comments Yet! You can be first to comment this post!

Write a Comment