যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
ঝর্ণা ফুল কেউ চেনেন? দেখেছেন?
হাওর পাড়ে বেড়ে ওঠা যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে, নামে না চিনলেও ছবি দেখালেই চিনতে পারবে। এখানের প্রতিটি গ্রামের আনাচে কানাচে, গভীর হাওরের কান্দায় অথবা বিলের ধারে এই ফুলের অপূর্ব সমারোহ দেখা যায়। এরা অবহেলা অযত্নে জন্মে। সাধারণত পৌষের শুরুতেই ফুটে।
শৈশবে দেখে আসা এই ঝর্ণা ফুল আর কোথাও (এখন পর্যন্ত) চোখে পড়েনি।
এখানে ভরা বর্ষায় সারি সারি হিজল বরুণ করচ গাছ নির্বিঘ্নে পানির উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। কী অপরূপ! ভরা বর্ষার নিঝুম বিকালে হাওরের পানির সাথে এসব গাছেদের সখ্যতার সৌন্দর্য একবার দেখলে মনে লেগে থাববে আমৃত্যু। হিজল বরুণ করচ গাছেদের সাম্রাজ্যের এই বিস্তার হাওর পাড়ের কান্দায় অথবা বিলের ধারে কিংবা গ্রামগুলোর আশে পাশে। শুনেছি এদের অনেকের বয়স শত বছর বা তারও বেশি। শৈশবের এক জোড়া করচ গাছের স্মৃতি এখনও মনে লেগে আছে। জয়শ্রী থেকে ধর্মপাশা যাওয়ার পথে জয়শ্রী -কান্দাপাড়ার ঠিক মাঝামাঝি এক জোড়া করচ গাছ ছিল (এখনও হয়ত আছে)। ভরা বর্ষায় এদের পাশ দিয়ে কেরায়া নৌকায় (তখনও ইঞ্জন বোট চালু হয়নি ) যাওয়া আসার সময় বিস্ময়ে দেখতাম। খুব ভয়ও লাগতো। বিশাল জলরাশির মধ্যে একজোড়া গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ! কিছুতেই বুঝতে পারতাম না এরা এত গভীর পানিতে বাঁচে কীভাবে। আর শুধু কেনইবা মাত্র দুইটি গাছ এখানে? অন্য গাছেরা কোথায়?
আমাদের শৈশবে হাওরের বিলের ধারের কান্দায় চাঁদমালা, বুনো গোলাপ – এমন অনেক ফুল ফুটত। সব ফুলের নাম এখন আর মনে নেই। সিঙ্গারা-ফল গাছের পাতায় ঢেকে থাকত সারা বিল। সিঙ্গারা গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটত শাপলা আর বড় বড় পাতার পদ্ম। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য নিয়ে কী নীরবে পানির ওপরে ভাসত! একবার আমার আব্বার সাথে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। আমি তখন ক্লাস ফোর অথবা ফাইভ পড়ি। কার্তিক মাসের বিকেল হল টেটা আর কুচ দিয়ে মাছ ধরার সবচেয়ে ভাল সময়। বিকেলের সুনসান নীরবতায় মাছেরা খাবার খেতে বিলের পানির উপরের দিকে উঠে আসে। বিলের যেপাশে বেশি শাপলা আর পদ্ম ফুটে আছে আব্বা আমাকে সে পাশে আস্তে আস্তে নৌকা বাইতে বললেন। গোধূলি ঘনিয়ে এসেছে, পশ্চিমের আকাশের লালচে রঙ ক্ষীণ হচ্ছে, আব্বা নৌকার গলুইয়ে বসে কুচ হাতে অপলক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছেন। হাওরের নিস্তব্ধতায় সিঙ্গারা গাছ, শাপলা আর পদ্মের পাতা ও ফুলের গালিচা ভেদ করে আমি আস্তে আস্তে নৌকা চালাচ্ছি। পাতা আর ফুলের এই সৌন্দর্যের সাথে পশ্চিমাকাশের লালচে আলোর আভায় আব্বার মাছ ধরার দৃশ্যটি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্যগুলোর একটি|
হায় ! জীবনে এমন সুন্দর দৃশ্য আর কখনও হয়ত আসবে না।
আজ মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। শৈশবের কথা বেশি মনে পড়ছে। হাওর পাড়ের শৈশব! সেখানের ফড়িং-এর সৌন্দর্য, উড়াউড়ি চোখে ভাসছে। কত আগের দৃশ্য – প্রায় ২৮ বছর! বকের উড়াউড়িও দখল করে আছে শৈশবের অনেকগুলো সন্ধ্যা – কত রকমের বক! বড় বক। কানি বক। ধূসর বক। আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো আম গাছ ছিল। শীতের শুরু থেকেই সন্ধ্যা হলে বাড়ির পেছনের বড় আম গাছ ভরে উঠত বকের ঝাঁকে। কিছির মিছির ডাক। কেউ কখনও এদের মারত না। আমরা ছোটারাও কখনও একটি ঢিলও দিয়ে দেখিনি। আমাদের তখন জানাই ছিল শীতের এই দুই মাস এই গাছটি বকদের বাড়ি।
আমাদের ছেলেবেলায় হাওরের বিলে পানকৌড়ির রোদ পোহাত। হিজল বরুণ করচ গাছেদের পাতাহীন ডালে – দলবেঁধে বসত। বিলে মাছ ধরতে গিয়ে অথবা কেরায়া নৌকা বা ট্রলারে হাওরের মধ্যে দিয়ে ভাটির কোন আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার সময় পানকৌড়ির ডুব সাতারে মাছ ধরার দৃশ্য দেখার জন্য অধীর আগ্রহে থাকতাম। খুব উপভোগ করতাম ব্যাপারটি। খুব আনন্দ হত যখন দেখতাম পানকৌড়িটি ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ পরে একটি ছোট মাছ (বেশির ভাগ সময় পুটি মাছই পেত) দুই ঠোঁটের মধ্যে নিয়ে বিজয়ীর মত ভেসে উঠত।
হাওরের পানিতে হাঁসেদের ঝাঁক বেঁধে চলার দৃশ্যগুলো মনে হলেও নিজেকে খুব বঞ্চিত মনে হয়। সেখানে পাতিহাঁস, লেঞ্জাহাঁস, সরালিহাঁস সহ অনেক প্রজাতির হাঁস ঝাঁকে ঝাঁকে চলত। আমার ধারণা হাঁসেদের ঝাঁক বেঁধে চলার এমন দৃশ্য পৃথিবীর খুব কম জায়গায় দেখা যাবে।
ছোট বেলায় হাওরে অনেক পাখি দেখেছি। যখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন প্রথম কুড়া বা পালাসি কুড়া ঈগল দেখেছিলাম। টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। বিরাট এক খাঁচার মধ্যে আটকে রাখা হয়েছিল। রাজকীয় ভঙ্গিতে পালাসি কুড়া ঈগল সেখানে বসে ছিল। আত্মীয় বাড়ির একজন আমাকে বলেছিলেন এই কুড়া দেশে খুব পরিচিত। এর খুব নাম-ডাক। তখন তার কথার আগা মাথা কিছু না বুঝলেও ঈগলের বসার এবং তাকানোর রাজকীয় ভঙ্গিটি এখনও চোখে লেগে আছে। যখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি শনির হাওর এলাকায় হরিনাকান্দিতে আমাদের আরেক আত্মীয়ের বাড়িতে আরেকটি সেই বিখ্যাত পালাসি কুড়া ঈগলের দেখা পেয়েছিলাম। সেও এক দেখার মত পাখি ছিল ! অনেক পরে কলেজে পড়ার সময় বুঝেছিলাম, এই সেই পালাসি কুড়া ঈগল হাসন রাজার গানের কারণে যার নাম সবাই জানে।
হাওরে শঙ্খচিল দেখেছেন? তখন শীতকালে দেখা যেত। একবার নজরপুর থেকে হেঁটে হরিনাকান্দি যাচ্ছিলাম – মাঘ মাসের সকাল। শানির হাওরের মধ্য দিয়ে আলের মত রাস্তা। নজরপুর থেকে একটু সামনে গেলেই আলের রাস্তার শুরু। কাঁদাজল ভেঙে যেতে হত। এই রাস্তায় হরিনাকান্দি গিয়ে থেমেছে। মানুষের চলাচলের জন্য এই কাঁদাজলের পথেও দুইটি ছোট সাঁকো ছিল। এই সাঁকোগুলোতে বসে ছিল কয়েকটি খুব সুন্দর, চৌকস পাখি। যাদের বছরের অন্য সময় দেখা যায় না। আমি তখন শঙ্খচিল চিনতাম না। একজনকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল – এর নাম সংছিল। শীতের সময়ে হরিনাকান্দি যাওয়া আসার পথে অনেকবার দেখেছি – কখনও এই সাঁকোগুলোতে কখনও করচ গাছের ডালে কখনও স্লুইসগেইটের রেলিং-এ। অনেকদিন পরে কলেজে উঠে জানতে পারি এই সংছিলই আমাদের শঙ্খচিল।
হাওরের দুটি পাখির কথা খুব মনে পড়ে। একটি হলো কালেম পাখি। আরেকটি সুইচোরা পাখি। দুইটি পাখিই খুব সুন্দর দেখতে। বেগুনি রঙের পালকের জন্য কালেম পাখি খুব দৃষ্টি-কাড়া হয়। আর সুইচোরা পাখি ! যারা একবার দেখবে সারা জীবন মনে রাখবে। আমি যখন ছোট – কতইবা বয়স হবে – আট কি নয়। মাঘ মাসে যখন হাওরে বোরো ধান বপন শুরু হত তখন প্রায়ই ক্ষেতে যারা কাজ করছে তাদের জন্য খাবার নিয়ে যেতাম। বিলের ধারের কান্দায় আমি অনেক সুইচোরা পাখি দেখেছি। আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন দূর সম্পর্কের এক ভাই – রাইসুদ্দিন ভাই। তিনি প্রথম আমাকে চিনিয়েছিলেন বেগুনি পালকের কালেম পাখি। দল বেঁধে হাওরে এসে পড়ত। এখনও চোখে লেগে আছে সেই সৌন্দর্য। কান পাতলে এখনও শুনতে পাই সেই কিছির মিছির ডাক।
Related Articles
Sochi Winter Olympics opens amidst highest security
President Vladimir Putin has invested time and money to make the Winter Olympics successful in Sochi beginning on 7-23 February,
তালপট্টি কাহিনী
সমুদ্র জয়ের ঘটনা না ঘটলে দক্ষিণ তালপট্টি কাহিনী অথবা কেলেংকারি এভাবে খোলাসা করে জানা যেতোনা! বঙ্গোপসাগরের ভারত-বাংলাদেশের বিরোধপূর্ণ এলাকায় জেগে
মেলবোর্নের চিঠি – ১
বিশেষত প্রবাস জীবন বেঁছে নেয়ার পিছনে থাকে কিছু টুকরো গল্প। সুখ-দুঃখ গল্পগাঁথা ছাপিয়ে শুরুতে কেবল একটা আশা বা প্রত্যাশার ভেলায়