মেলবোর্নের চিঠি – ৬
এয়ারপোর্ট আসলে শুধু একটা স্থান না, যেন অনুভবের সাত রঙের আধার। যেখানে মানুষ খুব কাছ থেকে দেখতে পারে, অনুভব করতে পারে নিজেদের বা অন্য কারো জীবনের বিশুদ্ধ কিছু আবেগ গাঁথা। দেখতে পারে কাছের মানুষকে ঘিরে থাকা মানুষের সেই অনুভবের বর্ণীল প্রকাশ।
এয়ারপোর্ট এ দেখা যায় সব রকম মানুষের জীবন। দেশ ছেড়ে যাওয়া বা ফিরে আসা মানুষ, তাদের ঘিরে থাকে একটা জীবনের আয়োজন। এ যেন প্রিয় মানুষকে ঘিরে কাছের মানুষদের হৃদ স্পন্দনের এক ক্ষণিক মায়াভুবন।
একটা বিষয় লক্ষণীয়, যেকোন দূরত্বের প্লেন জার্নিই হোক না কেন, খুব কম মানুষই আছে যারা উদ্বিগ্ন হননা। এমনিতে খুব ধর্মপ্রাণ না হলেও এমন অনেকেই আছেন প্লেন জার্নির পুরোটা সময় স্রষ্টার নাম জপে জপেই শেষ করেন সেটা। আমি খুব কাছ থেকেই এমন দু একজনকে দেখেছি।
বিশেষ করে প্রথম আকাশ ভ্রমন অবশ্যই অন্যরকম। বাংলাদেশ থেকে প্রথম ভিনদেশে যাওয়া মানেই, এয়ারপোর্ট ফর্মালিটি। বাংলাদেশ ছেড়ে অন্য কোন দেশে যাওয়া হচ্ছে মানেই পাসপোর্ট, ভিসা, কাস্টমস, লাগেজ পত্র, ইমিগ্রেশন বিষয়গুলোর মাঝে পড়া।
জীবনের প্রথম পরিবারের খুব কাছের ক’’জন এবং বন্ধুকে বিদায় দিতে গিয়ে এয়ারপোর্ট যাওয়া হয়েছে আমার। নিজে প্রথম দেশের বাইরে যাই পাশের দেশ, ভারত এবং সড়ক পথে। পাসপোর্ট ভিসা ইমিগ্রেশন কাস্টমস ফর্মালিটির মুখোমুখি হলেও আকাশের অভিজ্ঞতা হয়নি।
সম্ভবত ২০০২ এ মালয়েশিয়া এয়ারের একটা প্যাকেজ ট্যুর ব্যাঙ্কক মালয়েশিয়া ৬ রাত ৭ দিন এই জাতীয়, পারিবারিক তিন বন্ধু পরিবার নিয়ে যাওয়া। সেই প্রথম বিমান ভ্রমনের অভিজ্ঞতা। জেনেছিলাম অল্প বিস্তর হলেও বিদেশ ভ্রমণ বা নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে এয়ার পোর্ট পার হয়ে গেলে কি ধরণের ব্যাপার স্যাপারের মুখোমুখি হতে হয়। সে এক ট্যুর বটে, এক সাথে অনেক অভিজ্ঞতা, ৩/৪ দিন কাটিয়ে মালয়েশিয়া থেকে থাইল্যান্ড যাবো, ১ টায় ফ্লাইট, আমরা বেলা এগারোটার পর পর বাচ্চাকাচ্চা সহ ১০ জনের টিম পৌঁছেই শুনি আমাদের ফ্লাইট চলে গেছে। টিম লিডার ১১ টাকে ১ টা দেখেছিলেন। তারপর সে এক বিরাট ইতিহাস।
আজ তবে এয়ারপোর্টেই ফিরে আসি আবার, একটা মানুষ যেতে পারে পরিবার পরিজন, বন্ধুর সাথে বা একা। বাংলাদেশে প্রথমবারের এয়ার পোর্ট অভিজ্ঞতা খুব কম জনেরই বোধ হয় খুব নির্ভেজাল বা কাঙ্খিত হয়। ২০০৯ থেকে ২০১৭ অনেকটাই বলতে গেলে বদলেছে ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের আভ্যন্তরীণ নিয়ম কানুন। তারপরও যেটি সব সময় ছিল এখনও আছে, কেউ একজন বাইরে যাবে সবার আগেই খোঁজ এয়ার পোর্টে কে আছে। জব করে, এমন কোন না কোন ভাই-বোন বন্ধুকে খুঁজে বের করা এবং তার বা তাদের হেল্প নিয়ে যতটা ফেবার নেয়া যায়।
কোন একটি ছেলে বা মেয়ে পড়তে যাচ্ছে তাকে বিদায় দিতে যেয়ে যখন পরিবারের সবাই আসে সেই দৃশ্যপট বা যে মানুষটি কাজের জন্য মধ্যপ্রাচ্য বা অন্য কোন দেশে যাচ্ছে সেই দুই মানুষদের ঘিরে থাকা মানুষ নিয়ে যে দৃশ্যপট দুটো একটু আলাদাই বটে।
এটা খুব স্বাভাবিক এয়ারপোর্টে কাউকে সি অফ বা রিসিভ করতে সব সময়ই কেউ না কেউ যেয়ে থাকেন সাথে। এই সময়ে এসে কিছুটা নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলেও কোন একটা নিদৃষ্ট জায়গা পর্যন্ত এখনও যাওয়া যায়। লাগেজ চেক ইন করে অনেকেই আবার শেষ আরো কিছু সময় আত্মীয় পরিজনের সাথে আরো কিছুটা সময় কাটান। ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলে আর আসা যায়না, এটা জানা নেই এমন অনেককেই দেখা যায় অল্প সময়ের জন্যে হলেও যে দেখাটা হলোনা, তাই নিয়েই হয়তো আফসোস নিয়ে বিমানের দিকে আগাতে থাকেন।
এয়ারপোর্টে যাত্রীর সাথে কতজনের যাওয়া উচিত, আদৌ যাওয়া ঠিক কিনা, সাথে গেলেও কোন সীমানায় যেয়ে থেমে যেতে হবে অনেকেরই জানা নেই। বিশেষ করে প্রথম বারের মতন দেশের বাইরে যাচ্ছেন তাদের জন্যে তো বটেই। তবে দিন বদলেছে, বাংলাদেশের প্রায় সব পরিবারের কেউ না কেউ বাইরে যায় বা প্রবাসী কেউ না কেউ আছেনই।
এয়ারপোর্টে ঢোকার পর প্রথম কাজটি হচ্ছে লাগেজ চেক ইন। এয়ার লাইন্সের বেঁধে দেয়া ওজন নিয়ম অনুযায়ী লাগেজ স্ক্যান করে দিয়ে দেয়া। আমাদের মাঝে খুব কম জনকেই পাওয়া যাবে যে বা যারা লাগেজ গুছাতে গিয়ে ওজনের বিষয়টা ঠিক ঠাক মেনে চলেন। ইনফ্যাক্ট জানেন বা জানার পরও তা মাথায় রেখে গুছান।
এয়ারপোর্টে এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে দেখা যায়, সেই দেশের স্টাফ ছাড়াও কাজ করেন অনেক বাংলাদেশীও। খুবই ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে ওজন সমস্যায়ও অনেকে এয়ারপোর্টে কাজ করা কারো না কারো লিঙ্ক দিয়ে পার পেয়ে যেতে চান এবং অনেককেই দেখেছি সেটা করে ফেলতে একটা সময় পর্যন্ত, জানা নেই এই মুহুরতের হালচাল। নিজে করিনি, করার চেষ্টাও করিনি।
যাত্রী হিসেবে আপনি কোন দেশটিতে যাচ্ছেন সেই দেশের এয়ারপোর্ট কাস্টমস অনুযায়ী যা নেয়া যাবেনা তা অবশ্যই নেয়া উচিত না, সমস্যায় পড়বেন। এমন হতেই পারে আপনি না জেনে এমন কিছু লাগেজ বন্দি করেছেন। গন্তব্যের এয়ারপোর্টে অবতরণের আগেই বিমানেই পেয়ে যাবেন ডিক্লারেশন ফর্ম, উল্লেখ করুন যা নিচ্ছেন সাথে লিখে দিতে পারেন প্রয়োজনীয় নোটস, যেমন মেডিসিন হলে, অনলি প্রেস্ক্রাইবড মেডিসিন।
ব্যাক্তিগত কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে বলি, যে যেখানেই যাননা কেন, সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সাথে থাকা লাগেজটি রাখুন ৫/৭ কিলোর মাঝে। ল্যাপটপ বা ক্যামেরার ওজন আলাদা তবে যদি এগুলো সাথে থাকে এমন লাগেজই নেবেন যেটি বহন করা খুব সহজ হয়। ট্রানজিট থাকলে তা যেন স্বাচ্ছন্দ্য হয়, আপনি সেই এয়ারপোর্টে ঘুরে বেড়াতে চাইলে, হাঁটতে চাইলে তা যেন লাগেজ বহনের জন্যে প্যারাময় না হয়।
সাথের লাগেজে কোন অবস্থাতেই ছুড়ি, কাচি, চাকু, নেইলকাটার নিবেননা বা ১০০ গ্রামের বেশি কোন প্রসাধনী নিলে সেটা স্ক্যানিং এ ফেলে দেয়া হবে সেটি বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট পার হয়ে এলেও।
বেশীর ভাগ এয়ার লাইন্সের পারমিশন থাকে ৩০/৪০ কেজি ওজনের। কেউ সেটা একটা লাগেজেই নিতে চাইলে কিন্তু সমস্যা। বিশেষ করে ৪০ হলে অবশ্যই দুইটা আলাদা লাগেজ নিন। কাছের এবং দুরের অনেকের এই বিষয়ক নানান তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। আর যা ওজন আপনার টিকেটে আছে অবশ্যই তার চেয়ে বেশি নেয়ার চেষ্টা করা ঠিক না, বরংচ পারলে ১/২ কেজি কম রাখুন, নিরঝঞ্জাট হোক আকাশ ভ্রমণ।
লাগেজের বিষয়টি শেষ হয়ে যাওয়ার পরই আসে, ইমিগ্রেশন। ঢাকা বিমান বন্দরে খুব বেশিই যাত্রী থাকে যারা কাজ করতে যাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতন দেশে। আর এমন সম্মানিত যাত্রীর অনেকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা যথেষ্ট থাকেনা প্রয়োজনীয় ফর্মটি ফিল আপ করার। প্রথম যাচ্ছেন এমন অনেককেই দেখা যায় চোখ মুখ কাচুমাচু করে এদিক সেদিক তাকাতে। কেউ না কেউ সাহায্য করেন বলেই তারা সেটা করতে পারেন। তবে এই নিয়ে ডিউটিরত অফিসারদের কাছে হেনস্তা হননা এমন উদাহরণ বেশ কমই মনে হয়েছে একটা সময় পর্যন্ত।
তিক্ত অভিজ্ঞতা দেখেছি কাছ থেকে, শুনেছি প্রচুর। অনেকবার মনে হয়েছে আহা যে মানুষটি দেশ ছেড়ে যাচ্ছে তার জন্যে স্বদেশের এই বিমানবন্দর সময়টুকু সবারই কেন খুব কাংখিত আর ভালোবাসাময় করা যায়না। এই বিষয়টিতে আন্তরিকতা এবং বাস্তবায়ন কি খুব কঠিন!!!
অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশ গেছি, দ্বিতীয়বার ফিরছি। এয়ারপোর্ট ইমিগ্রশনে তখন বাংলাদেশের পুরোনো পাসপোর্টের সাথে নুতন ডিজিটাল পাসপোর্ট করেছি এবং একসাথে স্টেপল করে নিয়েছি। পুরোনোটাতে ভিসা স্টিকার, নুতনটাতে আগেরটার নাম্বার রেফারেন্স আছে যথারীতি তাই এক সাথে রাখা। আমি ও আমার ছেলে ইমিগ্রেশন স্বাভাবিক ভাবে পার পেলেও আমার পাশের কাউন্টারেই আমার ছেলের বাবাকে দেখলাম রীতিমত নাজেহাল হতে এই একই কাজের জন্যে!!!
আজ তবে থামি, এয়ারপোর্টে নববিবাহিত যে স্বামী বা স্ত্রী এসেছে তার সঙ্গীকে বিদায় দিতে, এসেছে যে মা-বাবা প্রিয় সন্তানকে বিদায় জানাতে, বা যে প্রিয় বন্ধুটি এসেছে বন্ধুকে বলতে এবার বিদায়, সবগুলো মানুষের চোখেই থাকে বিশুদ্ধ একটা টান, একটা আকুতি, যা বলে ‘তোমাকে মিস করবো প্রিয় আমার’। তারপরও তখন শুধুই বুকের মাঝের দীর্ঘশ্বাসে বা চোখের জলে থাকে একটাই চাওয়া ‘নিরাপদ একটা আকাশ ভ্রমন’!!!
যাত্রীবেশে যে মানুষটি সেইপ্রিয় মুখের ছায়া বুকে গেঁথে নিয়ে বিমানে উঠে বসে হঠাৎ যেন একটা অস্থির সময়, একটু এলেমেলো একটা ক্ষণ। অল্প কিছু সময় যেন জাগতিক পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। প্লেনের জানালা দিয়ে দুরের মেঘ বা কুয়াসায় তাকিয়ে হারিয়ে যাওয়া একটা সময় ডাক দিয়ে যায় অন্য ভুবনের।
এয়ার পোর্ট নিয়ে অনেক অনেক কোটেশন আছে, কেউ চাইলেই গুগুল সার্চে দেখে নিতে পারেন। তারই একটি দিয়ে আজ শেষ করি। ‘’Airports see more sincere kisses than wedding halls. The walls of hospitals have heard more prayers than the walls of churches.’’!!!
বেঁচে থাকলে চিঠি ৭ এ ফিরবো বিমান ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য নিয়ে, সেই পর্যন্ত হ্যাভ আ নাইস এন্ড সেইফ ট্রিপ, এই চিঠি পড়ে যারা এর মাঝেই আবার উড়তে যাচ্ছেন আকাশে।
নাদেরা সুলতানা নদী
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
Related Articles
Foreign Secretaries meeting in New Delhi
There is a saying that one can choose friends but not neighbours. Bangladesh and India are neighbours and they cannot
বৈদেশিক বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনাময় দেশ
বাংলাদেশ বৈদেশিক বিনিয়োগের একটি অপার সম্ভাবনাময় দেশ। গত সাড়ে পাঁচ বছরে যেভাবে দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ শক্তিশালী হয়েছে তাতে এদেশে বৈদেশিক
ওম
ত্রিবেণী সিন্ধুর জলে উড়ে যায় উত্তরীয় তোমার— চিৎকারের শব্দে ওড়ে বাদুর; আকুল সুখে বাঁচাও… বাঁচাও… (বাতাসে ওড়ে কর্পূর! কিন্নরী তৈরি
Thank you for Letter.
খুব সুন্দর লিখা নদী l ভালো লাগলো l