ব্যান্ড-এইড
– বাবা তোমার পেপার কতদূর?
-কেন রে?
– বারে তুমি প্রেজেন্ট করবে না?
সারা বছরই এই প্রশ্নগুলো ঋভুর কাছ থেকে শুনতে হয়। আমি চুপ করে থাকলে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার পাবলিকেশন কয়টা?’
আমার মনের দুষ্টামিগুলো এবার আহলাদে গলে যায়, ‘প্রায় ২০ টা তো হবেই।’
ঋভুর চোখ কপালে উঠে, ‘আর সাইটেশন?’
আমি হাসতে হাসতে বলি,’প্রায় হাজার খানেক।’
ওর বিশ্বাস হয় না। ‘ইম্পসিবল। তুমি আমাকে দেখাও।’
আমি খাতা কলম নিয়ে ওকে হিসাব করে দেখাই।
– এই দেখ, মঞ্চ নাটক প্রায় ২০ টি করেছি। তার মধ্যে চারটি নাটকের একশতম প্রদর্শনী করেছি। মানে মোট চার’শ। আর বাকি সবগুলো নাটক যোগ দিলে তো হাজার রজনীর কাছাকাছি হবে। ‘
– তুমি একটা পাগল। আমি নাটকের কথা জিজ্ঞেস করিনি। আমি তোমার সাইকোলজি রিসার্চ পেপার এর কথা জিজ্ঞেস করছি।
– কেন রে ? প্রতিটা নাটকই তো একটা রিসার্চ। আর প্রতিটি শো হচ্ছে সাইটেশন।
– বাবা আসল কথা বল। তোমার প্রেজেন্টেশন কবে?
– অক্টোবরে। কেন?
– ওহ! আমি তো তখন লন্ডনে থাকবো। দেখতে পারবো না।
বৃদ্ধ বয়সে মনে হলো – গবেষণা করলে কেমন হয়? মানুষের মন নিয়ে এতো নাড়া -চাড়া করি। আর এই মনের গল্পগুলো না বললে কি হয়? দুটা পেপার তৈরি হলো। চোখ বুঝে একটি কনফারেন্স এ পাঠালাম। ও মা। ওরা দুটা পেপারই খপ করে ধরে ফেললো। এখন আমাকে একগাদা রাঘব -বোয়ালের সামনে এই দুটা রিসার্চ নিয়ে কথা বলতে হবে।
আমি একা একা হিসাব করি। সেই ১৯৯৫ তে এমন এক কনফারেন্স এ পেপার প্রেজেন্ট করেছিলাম। তারপর আর ওই দিকে তাকাই নি। এর পর তো নাটক করেছি, নাটকের খ্যাপে গিয়েছি আর রিহার্সাল করেছি। হঠাৎ এই বৃদ্ধ বয়সে মনে হয় ‘মতিভ্রম’ হয়েছে। নতুবা খাল কেটে এমন বিপদ নিয়ে আসবো কেন? আমার বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ শব্দ টের পাই। আমি জানি এই শব্দের অর্থ কি!
ঘড়ির কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করি। মন যত দ্রুত দৌড়ায়, কাজ যেন কিছুতেই তার সাথে তাল মেলাতে পারে না। আমি কেবল আটকে যাই। মনে হয় কত কিছু করা হয় নি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই হাসি। আয়নার ওই পাশের মানুষটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেশ করি, ‘কি বুড়ো – টুরো হয়ে যাচ্ছ নাকি?’
দরজায় হালকা নক করে ঋষিতা জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, তুমি কি একা একা কথা বলছো?’
– না রে মা।
– ডোন্ট লাই। আমি শুনতে পেয়েছি। আর ইউ ওকে ?
আমি মেয়েটিকে বলতে পারলাম না, ‘নারে, মা। আমি ‘ওকে’ না। আমার কেন জানি অস্থির লাগছে। এতদিন পর এতগুলো মানুষের সামনে দাঁড়াতে – অস্বস্তি লাগছে। আমি পারব তো ?’
ঋভুর কথা খুব মনে হচ্ছে। ওর পরীক্ষার সময় হাতে একটি ব্যান্ড-এইড লাগিয়ে দিতাম। ফিস ফিস করে বলতাম, ‘আমি তোমার সাথে তোমার ক্লাসে বসে থাকবো। যদি আটকে যাও – আমাকে জিজ্ঞেস করবে। আর আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিব। তুমি চোখ বুঝে আবার ভাববে। তারপর ফিস ফিস করে আমি উত্তরটি বলে দিব।’
ঋভু ব্যান্ড-এইড হাতে লাগিয়ে পরীক্ষা দিতে যেত। স্কুল ছেড়ে ইউনিভার্সিটি গিয়েছে কিন্তু অভ্যাসটি বদলায়নি। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষার সময়ও ইমেইল এ ব্যান্ড-এইড এর ছবি পাঠাতাম। ছেলে আমার ঠিক বুঝে নিত।
আজ আমার অমন একটি ব্যান্ড-এইড ভারী দরকার। কিন্তু ওটা কেবল ঋভুর কাছেই আছে। আমি চুপ করে ঋভুর ঘরে বসে থাকি। ওর বিছানা, কাপড়, চেয়ার ছুঁয়ে দেখি।
বাচ্চাটি আমার লন্ডনে। এইচআইভি ক্লিনিকে রোগী দেখছে। সেই ১৯৯৫ তে আমিও প্রথম পেপার পড়েছিলাম এইচআইভি’র উপর। তখনও এমন রাঘব-বোয়ালেরা বসে ছিল। আমার বুক কেঁপেছিল। রাঘব-বোয়ালদের জন্য নয়। ঋভুর প্রথম হাসির মুহূর্তটি নিয়ে। ও কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে?
ছেলে আমার অপেক্ষা করেছে – আমার প্রেজেন্টেশন পর্যন্ত। তারপরই জানান দিয়েছে,’বাবা আমি এসে গেছি।’
সেই বাচ্চাটি এখন ডাক্তার হবে। কিছুদিন আগে ও একটা পেপার তৈরি করেছে। ওর মায়ের কাছে আমার প্রস্তুতির খোঁজ নেয়। মা লিখে, ‘বাবা খুব স্ট্রেস করছে।‘
লন্ডন থেকে ঋভু টেক্সট পাঠায়, ‘বাবা চিন্তা করো না। সব ঠিক মতো হবে। আমি আছি না? ‘
আমি লিখি, ‘নারে বাবা। আমার বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দ বেড়ে যাচ্ছে। দুটা পেপার তো! ‘
ঋভু লিখে, ‘তুমি একটা পাগল। তোমার একহাজার সাইটেশন আছে না? তোমাকে কে আটকাবে?’
সকালে ট্রেন, বাস ধরে কনফারেন্স এ পৌঁছে যাই।
আজ ঘড়ির কাটা এতো দ্রুত চলছে কেন?
আমার বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দ কি সবাই শুনতে পাচ্ছে? আমি লাউঞ্জে একা একা বসে স্লাইড গুলতে চোখ বুলিয়ে নেই ।
হোটেলের জানালা দিয়ে সমুদ্রের ঢেউ দেখি। একজন বললো, ‘আজকের ঢেউ গুলো বেশ বড়। খেয়াল করেছো?’
আমি বলতে চাই, ‘ওগুলো আসলে ঢেউ না।’
ঘড়ির কাটা টিক টিক করে এগুচ্ছে। আমার নিঃশ্বাসের গতি বাড়ছে। আমি উঠে এক গ্লাস পানি নিয়ে বসলাম।
– নাও আই উড লাইক তো ইনভাইট আওয়ার নেক্সট প্রেজেন্টার……
আমি লিস্টে তাকিয়ে দেখি আমার নাম।
ঘর ভর্তি মানুষ। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দ বেড়ে যায়। আমি সারা ঘরে ঋভুকে খুঁজি।
মাইক্রফোনে একজন মিষ্টি করে বলল, ‘ইউর টাইম স্টার্টস নাউ।‘
সামনে মনিটরে দেখছি ঘড়ির কাটা উল্টো দিকে ঘুরছে। মোট সময় দশ মিনিট। এর মধ্যেই সব কথা বলতে হবে। তারপর পাঁচ মিনিট ঝালাই-ধোলাই।
আমার চোখ তখন খুঁজছে একজনকে।
হঠাৎ চোখ আটকে যায় পিছনে। আমার ব্যান্ড-এইড পিছনের চেয়ারে বসে মুচকি হাসছে।
অটো পাইলটিং এর মতো গড় গড় করে বলে ফেললাম। তারপর সবাই আমাকে বারবিকিউর মতো পুড়ালো। আমি দিব্যি বেঁচে গেলাম।
কেউ কেউ বললো,’মোস্ট এন্টারটেইনিং প্রেজেন্টেশন। ‘
সবার সাথে কথা শেষ করে আমি তখন আমার ব্যান্ড-এইড খুজছিলাম।
ওটা তো এখানেই ছিল। আমি কাগজ ঘাটা-ঘাঁটি শুরু করলাম। পরের প্রেজেন্টার জিজ্ঞেস করলো, ‘হ্যাভ ইউ লস্ট এনিথিং?’
– ইয়েস। এ ভেরি ইম্পরট্যান্ট ……
– ইজ দিস ইওরস?
আমি দ্রুত ওর কাছ থেকে ওটা নিলাম।
-হ্যা। এটা আমার। কোথায় পেয়েছো?
– এট দ্যা ব্যাক।
অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
– হোয়ের ডিড ইউ ফাইন্ড ইট?
– এট দ্যা ব্যাক। ইট অওাজ অন দ্যাট চেয়ার ।
তাকিয়ে দেখলাম। পিছনের সেই চেয়ারটি খালি। চেয়ারে কেউ নেই।
আমি হেটে চেয়ারটির কাছে গেলাম। আলতো করে ছুঁয়ে দিলাম। আমার পা ভারী হয়ে উঠলো। মনে হলো কেউ একজন এই চেয়ারে বসেছিল। যে আমার ভারী পরিচিত। আমি চেয়ারে বসে পড়লাম। লোকটির দেয়া সেই জিনিসটি আস্তে আস্তে খুলে দেখলাম। হঠাৎ চোখ আটকে গেল। একটি ব্যান্ড-এইড। আর সেই ব্যান্ড-এইডে কাঁচা হাতে লেখা, ‘আমার বাবা চ্যাম্পিয়ন। ‘
আমার বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দ থেমে গেল। নিঃশাস হালকা হয়ে এলো। কি এক আদর আর আস্থার চাদর আমাকে ঘিরে রাখলো। জগতের কি এক আশ্চর্য খেলায় বাবা আর ছেলে কেবল জায়গা বদল করলো। কেউ টের পেল না। সমুদ্রের ঢেউ গর্জন করে বলল, ‘আহারে …….’
——————————
জন মার্টিন, সিডনি, অক্টোবর, ২০১৭
Related Articles
Unilateral construction of Tipaimukh Dam: A Serious Breach of Trust
The visit of Prime Minister Sheikh Hasina to New Delhi in January 2010 is considered to have unfolded a new
তোমার জন্য মুগ্ধ!
একটা গানের এলবাম হাতে এসেছে, গত সপ্তাহে। শুনবো শুনবো করে, আজই প্রথম শুনার সময় পেলাম। প্রকৃত পক্ষে গান শোনার জন্যে
Foreign Secretaries meeting in New Delhi
There is a saying that one can choose friends but not neighbours. Bangladesh and India are neighbours and they cannot
মোহাবিস্টের মতো পুরো লেখাটা এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। আমি এই ভেবে পুলকিত হই, মার্টিন দা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। ‘সাঈদ
দাদা, বেশ কিছুদিন আগে আপনার এই লেখাটি আমার ফেসবুক পেজ এ আসে। ওপেন করেও পড়তে পারি নাই ব্যস্ততার কারণে। কিন্তু অবচেতন মন টিক টিক করছিল লেখাটি পড়ার জন্য, সময় বের করতে পারছিলাম না। আজ অফিস থেকে ফেরার পথে যখন জ্যাম এ আটকে আছি তখন পড়েই ফেললাম। আমি আপনার লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত। হিংসা করি ঋভুকে যে সে আপনার মত বাবা পেয়েছে। আমাদের একমাত্র সন্তান রিশান বয়স ৩ বছর ৫ মাস। আপনার মত ব্যান্ড -এইড যেন হতে পারি আমার সন্তানের। ভালো থাকবেন সবাই